দুর্ঘটনার পরের দিনই গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে, মেডিক্যাল টিম পাঠিয়েছেন, আহতদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করেছেন, রাজ্যের একদল দক্ষ আমলাকে এই কাজে নামিয়েছেন, তাঁরা কাজ করছেন দিনরাত। তারপরেও দার্জিলিং সফর বাতিল করে মমতা আবার কটকে যাচ্ছেন আহতদের দেখতে। সেখান থেকে চলে গিয়েছেন মেদিনীপুর সদর হাসপাতালে, সেখানেও আছেন বেশ কিছু আহত যাত্রী, তাঁদের সঙ্গেও তিনি দেখা করেছেন। এটা কি নিছক মমতা, দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষজনের পাশে থাকা? নাকি রাজনীতি। নিজের পুরনো ইমেজকে আবার শানিয়ে নেওয়া? সেই মমতা যাঁর কাছে এক কৃষক এসে বলেছিলেন, আমার জমিতে আমাকে ধান রুইতে পর্যন্ত দিচ্ছে না। সেদিন মমতা বলেছিলেন আমি ধান রুইব, একদিকে সিপিআইএম ক্যাডার, একদিকে পুলিশ প্রশাসন, অন্যদিকে মাত্র কিছু মানুষ, সামনে মমতা। সে এক সময় যখন গ্রামবাংলায় শেষ কথা বলার অধিকার ছিল কেবল সিপিআইএম-এর। হ্যাঁ, কাদায় পা ডুবিয়ে সেদিন ধান রুয়েছিলেন মমতা, সেই প্রথম আজকালের ফ্রন্ট পেজে সেই ধান রোয়ার আট কলমের ছবি। সেদিন ওটা কী ছিল? রাজনীতি? বাংলায় কংগ্রেস দলে আর কেউ ছিল না? আচ্ছা ভাবুন তো এই রাজনীতিটা অন্য আরেকজন করলেন না কেন? বা বলা যাক করতে পারলেন না কেন? কারণ এ ধরনের রাজনীতি করতে ধক লাগে। সিঙ্গুরে যে ভাবে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন, তা কি অন্য কেউ পেরেছে? সিঙ্গুরের একটা মানুষও কি বলতে বাকি রেখেছিল, হ্যাঁ একেই বলে লড়াই, ধন্যি মেয়ে মমতা। হ্যাঁ, মানুষের সামনে যখন তিনি হাজির হন তখন সরে যায় রাজনীতি, নির্বাচন, সম্মোহিত মানুষ দেখেন এক আপনজনকে। কিন্তু পিছনে? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, মমতা আবার কটকে, রাজনীতি না মমতা?
রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি তো করবেন, সেই অর্থে গান্ধীজির নোয়াখালি যাত্রার পিছনে কি রাজনীতি ছিল না? ছিল বই কী, কিন্তু সে রাজনীতি ছিল মানুষের আস্থা জেতার রাজনীতি। গান্ধীজি অনশনে বসেছেন কলকাতায়, যতক্ষণ একজন হিন্দু একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে আঘাত করার কথা ভাবছে, যতক্ষণ এক মুসলমান যুবক কেবল হিন্দু বলেই একজনকে আঘাত করতে উদ্যত, ততক্ষণ ওই প্রৌঢ় মানুষটি খাবেন না। মানুষের কাছে সেই আবেদন পৌঁছেছিল, দুই সম্প্রদায়ের মানুষ অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন। হ্যাঁ এটাই রাজনীতি, কিন্তু মানুষের জন্য রাজনীতি। এসব করার মধ্য দিয়েই গান্ধীজি তখনও তাঁর রাজনৈতিক ঘুঁটি সাজিয়ে যাচ্ছেন, দেশের দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের একসঙ্গে থাকা কেবল নয়, তাঁর নির্দেশ আর ইচ্ছে অনুযায়ী গ্রাম সুরাজ গঠন করতে বাধ্য হবে তারা, এটাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তাঁর নেতৃত্বেই তা হবে, সেটাও তিনি সুনিশ্চিত করতে চাইছিলেন, মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এই কাজ করে গেছেন। প্রতিপদে বিব্রত হয়েছেন প্যাটেল, নেহরু, গোটা মন্ত্রিসভা। তাঁরাও কি টের পাননি গান্ধীজির এই রাজনীতি? বেশক পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন বলেই তাঁরা গান্ধীকে আটকাননি, আটকাতে পারেননি।
আরও পড়ুন: Aajke | সুভদ্রার তিন ছেলে ফিরল না ঘরে
গান্ধীর পরে সেই রাজনীতিই করেছেন ইন্দিরা, সেই রাজনীতিই করছেন মমতা। মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে, মানুষের আবেগের ওপর ভর দিয়ে বিশুদ্ধ রাজনীতি। যে রাজনীতি তাঁকে প্রতিবার প্রতিটা পীড়িত মানুষের কাছে নিয়ে যায়। যে যন্ত্রণা, যে লড়াইয়ের কথা দেশ ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে, সেই মানুষদের কাছে হাজির হয়ে প্রচারের সবটুকু আলো তিনি শুষে নেন আর ওইখানেই তাঁর রাজনীতির জিয়নকাঠি। মোদি সরকার কোনদিক থেকে তাঁকে ঘেরার চেষ্টা করছে? তাঁর দলের কিছু দুর্নীতি, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের ধরে একটা সাধারণ ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, খানিকটা তৈরিও হয়েছে, মমতার সরকার বহু বহু দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আর মমতা তার পাল্টা বাজি বা বোমা যাই হোক না কেন, আহত মৃত মানুষদের ঘরে চলে যাচ্ছেন। যে কুস্তিগির মহিলারা যৌন নির্যাতনের শিকার তাঁদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে পড়লেন। দুর্ঘটনা হয়েছে, তিনি ঘটনাস্থলে, দু’দিন পরে আবার হাসপাতালে। যে বার্তা তিনি দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তা ছড়িয়ে যাবে হু হু করে। দিদি এসেছিলেন, আমি যখন বিছানায় পড়েছিলাম, দিদি বলেছেন সঙ্গে থাকবেন। এটাই যথেষ্ট। হ্যাঁ এই বার্তাই থাকবে, ভেসে বেড়াবে নির্বাচনের সময়, মমতা সে কথা ভালো করেই জানেন, জানেন বলেই ওনার রাজনীতি এক লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট-এর মতো। তিনি কোনও চাহিদা নিয়ে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান না, কিন্তু তাঁর এই সমস্ত উপস্থিতিই তাঁকে জননেত্রী করে তোলে। রাজ্যে বিরোধী নেতানেত্রী কি কম পড়িয়াছে? তাদের কেউ কেউ তো গেছেনও, কিন্তু মমতা যে পরশপাথর ছুঁয়ে এলেন, তা কি তাঁদের হাতে ছিল? ছিল না। ছিল না কারণ তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। এই হুট বলতে ঝুট ঘটনা ঘটলেই মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা কি মমতার নিছক রাজনীতি? নাকি ওটাই তাঁর রাজনীতির ইউএসপি? মানুষ কী বলছেন শুনুন।
খেয়াল করে দেখুন তিনি অনায়াসে অশ্বিনী বৈষ্ণবের পাশে দাঁড়িয়েই রেল দুর্ঘটনার তদন্ত চাইতে পারেন, রেলের গাফিলতিকে চিহ্নিত করতে পারেন আবার সাফ জানিয়ে দিতে পারেন, এখন রাজনীতি করার সময় নয়, আমরা রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ ইত্যাদি কিছুই চাইছি না। অনেকের মনে হয় বিচ্ছিন্ন, উলটোপালটা, মাথামুণ্ডু নেই, কী যে সব বলেন ইত্যাদি। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন প্রত্যেকটা কথা মাপা, প্রত্যেকটা কথার নির্দিষ্ট মানে আছে এবং আবেগ ইত্যাদি যাই থাকুক তা কিন্তু পিওর পলিটিক্স, বিশুদ্ধ রাজনীতি।