অবিজেপি দলগুলোর প্রথম বৈঠক বসবে পাটনায়, রাত পোহালেই। প্রথম হার্ডলটা পার করতে পেরেছেন আহ্বায়ক নীতীশ কুমার। রাহুল গান্ধী বিহীন এক অসম্পূর্ণ বৈঠক ডেকে লোক হাসানোর কাজটা করেননি। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, বৈঠক হবে না, রাহুল গান্ধীকে থাকতে হবে, এমনকী মল্লিকার্জুন খাড়্গেও যে যথেষ্ট নয়, তাও বুঝিয়েছিলেন। কংগ্রেসের তরফেও খানিক স্বস্তির ব্যাপার হল, বিরোধীরা রাহুলকে ছাড়া বৈঠকে বসতে পারলেন না, মানে বিরোধী জোট নিয়ে যে যাই বলুক কংগ্রেস ছাড়া বিরোধী ঐক্যের কোনও মূল্য নেই, তা প্রমাণিত হল। অতএব কংগ্রেস থেকে সায় মিলেছে, রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়্গে তো যাবেনই, প্রিয়াঙ্কাও যাবেন কি না তা নিয়ে কথা চলছে। অনুপস্থিতির তালিকায় ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, অন্ধ্রপ্রদেশের জগন রেড্ডি, চন্দ্রবাবু নাইডু, তেলঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও আছেন। নবীন পট্টনায়ক এক্কেবারে সরকার তৈরি হলে মাঠে নামবেন এবং যদি কোনওভাবে তাঁর দলের উপরেই সরকার গঠন নির্ভর করে, তাহলে তিনি বিজেপিকেই সমর্থন করবেন, কিন্তু বিরোধীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে অনায়াসে বিরোধী জোটে চলে আসবেন, এটাও সবাই জানেন। চন্দ্রবাবু নাইডু আর জগন রেড্ডি জল মাপছেন, বিজেপির দিকে কে থাকছে, সেটা বুঝেই অন্য শিবিরের কথা ভাববেন অন্যজন। বিজেপি প্লাস জগন রেড্ডি প্লাস চন্দ্রবাবু নাইডু কোনওদিনও হবে না। এবং এই হিসেব মোদি–শাহ জানেন, তাঁরাও জল মাপছেন। তেলঙ্গানার নির্বাচনে জেতার পরেই কে চন্দ্রশেখর রাও আবার বিরোধী জোট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবেন, আপাতত রাহুল, মল্লিকার্জুন খাড়্গের সঙ্গে মঞ্চ ভাগাভাগি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে এই চার বিরোধী নেতার অঙ্কে দুই দুই হয়ে থাকল। কিন্তু কোনওভাবে তেলঙ্গানায় কংগ্রেস অনেকটা ভালো ফল করলে, ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেললে, চন্দ্রশেখর রাও বিজেপির হাতও ধরতে পারেন, কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাকি দেশের বিরোধী দলগুলোর নেতারা বৈঠকে থাকবেন, এটা নিশ্চিত।
অর্থাৎ বহুদিন পরে আবার এক বড়দলকে পাশে নিয়ে আরও বড় এক বিরোধী ঐক্যের শুরুয়াত হতে চলেছে। নীতীশ কুমার বলেছেন, কম সে কম মিলনা জুলনা তো শুরু হুয়া, অব কহতে শুনতে বাতোঁ বাতোঁ মে প্যার ভি হো জায়েগা। তাহলে আমরা, সাংবাদিকরা এই বৈঠক থেকে কী আশা করছি? ৪৫০টা আসনে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী ঠিক করা হবে? এক কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম লেখা হয়ে যাবে? বিরোধীদের সম্মিলিত প্রধানমন্ত্রী মুখ ঠিক হয়ে যাবে? এর একটাও হবে না। বহু জটিলতা আছে, একের সঙ্গে একের বৈঠক, সম্মিলিত বৈঠক, একজনের মধ্যস্থতায় দু’ তিনজনের বৈঠকের পরেই এসব ঠিক হবে বা ঠিক করার চেষ্টা হবে। কিন্তু ওই একের বিরুদ্ধে একের ফরমুলাটা যতটা কার্যকর করা যাবে, ততটা বিজেপিকে হারানোর ক্ষমতা বাড়বে, এই তত্ত্বে সম্ভবত সায় পড়বে। আপাতত এই তত্ত্বের বিরোধী কারা? মূলত সিপিএম, তাদের বক্তব্য তারা আজ নয় তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই পাশ করিয়ে রেখেছে, কিছু ইস্যু নিয়ে বিরোধী দলের নেতৃত্বের সম্মিলিত প্রচারের ভিত্তিতেই বিজেপিকে হারানো যাবে, বিরোধী ঐক্য তারভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে। এটা সিপিআইএম-এর ঘোষিত সিদ্ধান্ত। এর বাইরে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে আবার কেন্দ্রীয় কমিটিকে ডাকতে হবে, সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটাও কি বোঝা গেল? আপনি বুঝতে পারলেন? ধরুন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ধর্মের ভিত্তিতে দেশে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা, অর্থনীতির খাস্তা অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে বিরোধীরা এক বক্তব্য তৈরি করলেন, এবং তা নিয়ে দেশজোড়া প্রচার করলেন, মানে আমরা আমাদের রাজ্যে সম্ভবত ব্রিগেডে এক বিশাল জমায়েতে কংগ্রেস, বাম, আপ, সমাজবাদী দল, আরজেডি এবং তৃণমূল নেতৃত্বকে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে শুনলাম। ভাষণ শেষ হল, সেই মঞ্চের তক্তা খোলার আগেই বহরমপুরে অধীর চৌধুরী, মহম্মদ সেলিম রায়গঞ্জে এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডায়মন্ড হারবারে একে অন্যকে হারানোর জন্য আবার সেই জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে শুনলাম। কী রকম হবে ব্যাপারটা?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | না মাননীয় রাজ্যপাল, আমরা মায়ের মৃত্যুতে ব্যান্ডপার্টি ভাড়া করি না
আসলে প্র্যাগমাটিজম, বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সিপিআইএম-এর নেই, ঐতিহাসিক ভূল করাটাই তাদের ঐতিহ্য। কিন্তু এবারের বিরোধী ঐক্য ইত্যাদিতে তাদের ভূমিকা তেমন নেই, কারণ তারা মাটিতে নেই, কেরলের বাইরে যে এক আধটা আসন তারা পেতে পারে তা নির্ভর করছে বা করবে আঞ্চলিক দলের সমর্থনের ওপর। কাজেই যে রাহুল গান্ধী মার্কসবাদ এক অচল ধারণা বলে জানিয়েই দিয়েছেন, তাকে সামনে রেখেই বিরোধী বৈঠকে তারাও হাজির। সম্বল? অত্যন্ত সৎভাবে বিজেপির বিরোধিতা, নিখাদ বিরোধিতা। অন্যদিকে নীতীশ থেকে মমতা, অখিলেশ থেকে উদ্ধব ঠাকরে, স্তালিন থেকে এমনকী কেজরিওয়ালও একের বিরুদ্ধে এক, মানে বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রার্থী দেওয়ার পক্ষেই কথা বলছেন। এবার তাহলে প্রশ্ন তোলাই যায়, ৫৪২টা আসনেই কি সেটা সম্ভব? না তো, সম্ভব তো নয়, সেটা তো বিরোধীরাও সব্বাই জানেন। সেই জন্যই তো ওই ৪৫০টার মতো আসনকে বেছে নিয়ে এই একের বিরুদ্ধে একের ফরমুলা কার্যকর করার কথা উঠছে, যা নিয়ে অবশ্যই এই বৈঠকে কথা হবে। কিন্তু এই একটা বৈঠকেই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। আর নিশ্চয়ই কথা হবে এক পাল্টা ন্যারেটিভ নিয়ে, ধর্ম নিরপেক্ষতা, জণগণের জন্য কল্যাণকর প্রকল্প, গরিব মানুষদের আরও বেশি সুযোগ সুবিধে দেওয়া, জাতিগত গণনা এবং কর্পোরেট লুঠ নিয়ে। এই বিষয়গুলো নিয়েও এক বিবৃতি সম্ভবত এবারেই জারি করা হতে পারে। তৈরি হতেই পারে এক কমিটি যারা এক কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এক খসড়া তৈরি করবে, যা আগামী বৈঠকে পেশ করা হবে। না, এবারেই বিরোধী প্রধানমন্ত্রী মুখ ইত্যাদি নিয়ে সিদ্ধান্ত তো দূরস্থান, কোনও আলোচনাও হবে না। কংগ্রেস তো এই আলোচনা এ বছরের আগে করতেই রাজি নয়, বছর শেষের আগেই বেরিয়ে আসবে চার রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল, তা কংগ্রেসের পক্ষে যাবে বলেই ধরে নিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব, এবং অন্তত তাঁরা চান ওই ফলাফল হাতে রেখেই বিরোধীদের নেতার মুখ বেছে নেওয়া হোক। অন্য বিরোধী দলেরাও এ নিয়ে আলোচনা করতে নেমে বৈঠক বানচাল করার রাস্তায় যাবেন না। কিন্তু কতগুলো কমিটি তৈরি হবে, পলিটিক্যাল ড্রাফট, কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম, ওয়ান টু ওয়ান কনটেস্ট ইত্যাদি নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার জন্য। এবং একজন কনভেনরকে এই বৈঠকেই বেছে নেওয়া হবে। দুই কি তিনজন জয়েন্ট কনভেনরের নামও আসবে। তার মানে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ওই কনভেনরের নাম নিয়ে, যিনি বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী মুখ নন, কিন্তু চেয়ারম্যান, ইউপিএ থাকাকালীন সোনিয়া গান্ধী যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, খানিকটা সেইরকম।
সেই নামের জন্য কে কে আছেন? মানে দাবিদার কারা? হতেই পারতেন লালুপ্রসাদ যাদব, কিন্তু তিনি জেল খেটেছেন, অভিযুক্ত নয়, ঘোষিত অপরাধী হিসেবে। তাহলে আর চারটে নাম পড়ে থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমার, মল্লিকার্জুন খাড়্গে আর শরদ পাওয়ার। সম্ভাবনার খেলায় কোনজন এগিয়ে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৬৮ বছর বয়স, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা প্রচুর, কেন্দ্রে মন্ত্রী, রাজ্যে তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সমস্যা হল কংগ্রেস তাঁকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকবে আর বামেরা তাঁর ঘোর বিরোধী। তিনি নিজেও এই পদে আসতে চান না। তাঁর নজর আরও উপরে। এরপর নীতীশ কুমার, বয়স ৭০, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা প্রচুর, সব দলের সঙ্গে যোগাযোগও আছে কিন্তু তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বহু বহু প্রশ্ন আছে, তিনি রাজনীতিতে পল্টুকুমার নামেই পরিচিত। এবং তাঁরও একটা চোখ যে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সির দিকে নেই, তাও তো নয়। মল্লিকার্জুন খাড়্গে, জীবনে একবার নির্বাচনে হেরেছেন এই কর্নাটকের কংগ্রেসি নেতা। রাজ্যে মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে কতটুকুই বা ভূমিকা। এখনও তাঁর গা থেকে কর্নাটকের গন্ধ যায়নি। বয়স ৮০। হিন্দিতে সড়গড় নন। যোগ্যতা গান্ধী পরিবারের অনুগত। শেষের নাম শরদ পাওয়ার। উনি কি জানেন যে উনি জাতীয় রাজনীতিতেই আসছেন, তাঁকেই এই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হবে? তা না হলে নিজের দলের রোজকার কাজ থেকে তিনি আগেভাগেই ছুটি নিয়ে রাখলেন কেন? বয়স ৮২। কিন্তু যোগাযোগ? দেশের যে কোনও রাজনৈতিক নেতা এবং শিল্পপতিদের সঙ্গে তিনি ফোন তুলেই কথা বলতে পারেন, হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও। আজন্ম নাস্তিক এই নেতার ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। বিজেপির সঙ্গে লড়াই মানে এক বিরাট ফান্ডের প্রয়োজন, সে সমস্যার চাবিকাঠি ওঁর হাতে আছে। না কংগ্রেস না আপ না তৃণমূল না নীতীশ-লালু, কারও কোনও আপত্তি থাকবে না এই শরদ গোভিন্দরাও পাওয়ারকে নিয়ে। সেই কারণেই সম্ভবত তিনিই হতে চলেছেন বিরোধী সম্ভাব্য জোটের কনভেনর, আহ্বায়ক। এবং এইটুকু প্রাপ্তি হলেই এই বৈঠক অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে বলে আমার ধারণা। বিরোধী দলগুলোর দ্বিপাক্ষিক ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য তৈরি কমিটির মাথায় নীতীশ কুমার থাকলে অবাক হব না। জয়েন্ট কনভেনর হিসেবে প্রত্যেক বিরোধী দল থেকে একজনের নাম চাওয়া হলে সেই তালিকায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম থাকা সম্ভব। তবে আর কিছু হোক না হোক, আমার নীতীশ কুমারের ওই কথাটা বেশ মনে ধরেছে, বৈঠক হচ্ছে, আপ, কংগ্রেস, তৃণমূল বাম এক মঞ্চে আসছেন, এটাই তো যথেষ্ট। এরপরে অব কহতে শুনতে বাতোঁ বাতোঁ মে প্যার ভি হো জায়েগা। প্রেম, যুদ্ধ আর রাজনীতিতে সব, সবই সম্ভব।