শুদ্ধিকরণ আদতে ছিল এক ধর্মীয় প্রথা। হিন্দু ধর্মের মধ্যেই ব্রাহ্মণদের বিচার মতো কিছু কাজ ছিল অনাচার, দুরাচার, অধার্মিক। ধরুন গোহত্যা, মনে না পড়লে মহেশ গল্পটা আরেকবার পড়ে নেবেন। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত গোহত্যার দায়ে দোষী হলে, শূদ্রদের ঠাঁই দিলে, বাবা-মা ইত্যাদির পারলৌকিক কাজে বিঘ্ন ঘটলে, বিদেশ ভ্রমণের পরে ব্রাহ্মণরা শুদ্ধিকরণের দাওয়াই দিতেন। সে দাওয়াইয়ের সবটাই ব্রাহ্মণদের লাভ। যেমন ধরুন পঞ্চগব্য খেতে হবে, মানে দুধ ঘি দই গোবর ও গোমূত্র, এই পাঁচটা খেতে হবে কাকে? যার শুদ্ধিকরণ হবে, এরপর বস্ত্র দান, কে পাবে? ব্রাহ্মণ। গো দান, কে পাবে? ব্রাহ্মণ। দক্ষিণা থেকে চাল কলা মুলো সবই ওই ব্রাহ্মণ পাবে তবে গিয়ে যনি অন্যায় করেছেন, তাঁর শুদ্ধিকরণ হবে। মানে যাঁর শুদ্ধিকরণ হবে তাঁর কপালে পঞ্চগব্য, গোচোনা, গোবর, বড়জোর নিজেরই গ্যাঁটের পয়সায় কিনে আনা পুজোর প্রসাদ মিষ্টি আর যিনি শুদ্ধিকরণ করাবেন, তিনি পাবেন চাল, কলা, মুলো, গামছা, কাপড়, বাসন-কোসন, দক্ষিণা, তেমন তেমন লোককে শুদ্ধিকরণ করলে দুধেল গরুও। এ শুদ্ধিকরণের ফলে ১০০ শতাংশ লাভবান হতেন শুদ্ধিকরণ যিনি করাচ্ছেন, একথা বলাই বাহুল্য।
এর বহু পরে শুদ্ধিকরণ কথাটা শোনা গেল কমিউনিস্টদের মুখে, সিপিআইএম দল শুদ্ধিকরণের ডাক দিল, কেন? কারণ এদিক সেদিক থেকে নানান কমরেডের নানা দুর্নীতি বের হয়ে আসছে, অভিযোগ আসছে, সেসব সামলাতে ২০ বছর শাসনের পরে সিপিআইএম শুদ্ধিকরণের ডাক দিল। মাথায় রাখুন সিপিআই বা আরএসপি বা ফরোয়ার্ড ব্লক কিন্তু এই শুদ্ধিকরণের ডাক দেয়নি। তো ডাক তো দিল, শুদ্ধিকরণ হল কি? সেই সব মাতব্বরেরা যাঁরা প্রতিটা মানুষের প্রতিটা ব্যাপারে কেবল নাক গলানো নয়, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কাজ করছিলেন, যাঁদের সময়ে শুরু হল ইঁট বালি চুন সুরকির সিন্ডিকেট তাদের শুদ্ধিকরণ? অনিল বসু বা লক্ষণ শেঠের শুদ্ধিকরণ? দুলাল দাসের শুদ্ধিকরণ? না, হয়নি। সরকার পড়েছে মাথাদের অপদার্থতার জন্য তো বটেই কিন্তু প্রতিটা অঞ্চলে এই মাতব্বরদের বিরুদ্ধেও মানুষ ভোট দিয়েছিল। এল তৃণমূল জমানা, ওই মাতব্বরদের ৮০ শতাংশ দল বদলালেন, আবার মাতব্বরি, আবার তৃণমূল স্তরেই দুর্নীতি। এ যেন রিলে রেসের ব্যাটন হাতে ছুটে চলা, কিন্তু সেটাও ১০ বছরের মধ্যেই। কাজেই এবার তৃণমূলের শুদ্ধিকরণ, ডাক দিয়েছেন দলের দু’ নম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঝুঁকি আছে, প্রবল ঝুঁকি আছে, তবুও ডাক দিয়েছেন যুব নেতা। জনজোয়ারের ডাক। শুদ্ধিকরণের ডাক।
আরও পড়ুন: Aajke | তৃণমূল জমানায় নাট্যোৎসবে ছবি নেই মমতার?
২০২২ এর ডিসেম্বরে কাঁথির জনসভায় দাঁড়িয়েই দলের প্রধান উপপ্রধান, অঞ্চল সভাপতিকে ১২ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন, এবং সেই পদত্যাগের পরে একটা ছিটেফোঁটা হেলদোল হয়নি দলে। এরপরে চাকদহের টাটলা এক নম্বর পঞ্চায়েত প্রধান পার্থপ্রতিম দে-কে পদত্যাগ করতে বলেন, টুঁ শব্দটিও না করে তিনি পদত্যাগ করেন। এবং এসব নির্দেশ গোপনে নয় সরাসরি মিডিয়ার সামনেই দিচ্ছেন অভিষেক। ক’দিন আগেই কোচবিহারের সিতাইয়ের গোসিনমারিতে মানুষের ভোটে পঞ্চায়েত প্রার্থী নির্বাচনের ভোটে ব্যালট বাক্স ভাঙা হয়, শুদ্ধিকরণ ডাকের, জনজোয়ারের প্রথম দিনেই এই অঘটন। বিরোধীদের টিটকিরির মাঝেই অভিষেক সাফ জানিয়ে দেন, তাঁর নজরে আছে, ওই একই জায়গায় আবার ভোট হবে, এবার ভোট হল। তিন আদিবাসী মহিলাকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ঘটনার পরে তাঁদেরকে দণ্ডি কেটে প্রায়শ্চিত্ত করে তৃণমূলে ফেরানো হয়েছিল। অভিষেক তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন, সেদিনই বালুরঘাট পুরসভার চেয়ারম্যান, মহিলা তৃণমূলের জেলা সভাপতি প্রদীপ্তা চক্রবর্তীকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। এসব ঘটনা এক সদিচ্ছের কথা প্রমাণ করে বইকী। দল করব পয়সা কামাব, এই সরল নিয়ম তো রাজনীতিতে লাগু হয়েছে সেই কবে, ত্যাগব্রতের যাবজ্জীবন তো আর কারোরই আদর্শ নয়। বাবার টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি অনায়াসে এক কমিউনিস্ট নেতা চড়তেই পারে, হাতে রাখতেই পারে অ্যাপল ওয়াচ, আবু সুফিয়ানের জাহাজ বাড়ি হতেই পারে কিংবা ভাঙড়ের জলের জাগ ছোড়া নেতার প্রাসাদ, এসবই যখন প্রায় দিনের আলোর সত্য ও স্বাভাবিক, তখন এক যুবনেতার এই শুদ্ধিকরণের ডাকের দিকে মানুষের নজর থাকবে বইকী। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক মানুষের কাছ থেকেই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই শুদ্ধিকরণ এই নতুন তৃণমূল গড়ার কাজ কি সফল হওয়া সম্ভব?
ডারউইনের থিওরি পড়ানো বন্ধ করতে চায় বিজেপি সরকার, বাঁদর থেকে আমাদের পূর্বপুরুষের উদ্ভব এ সত্য তাদের কাছে বিষের মতোই ঠেকবে। কিন্তু তাতে তো বিজ্ঞান পাল্টে যায় না। বিবর্তনের ফলেই আধুনিক মানুষের উদ্ভব কেবল নয়, এখনও সেই বিবর্তন জারি আছে। সেই বিবর্তনের মধ্যেই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, অ্যাডাপ্টেবিলিটি। খুব দ্রুত নিজেকে শুধরে না নিতে পারলে, সময়ের সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পারলে তাকে ডোডো পাখির মতো, ডাইনোসরের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হয়। যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে তৃণমূলের অন্দরে তা থেকে মুক্ত না হতে পারলে দল ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে একটা কথা তো বলতেই হবে পারবে কি না জানা নেই, এ অসুখ সারবে কি না তাও জানা নেই, তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অসুখটাকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, তাই বা কম কী?