আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার আমিকে চিরদিন-এই বাংলায় খুঁজে পাই। আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর, আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে, হেঁটেছি এতটা দূর, বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ, আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।
আজ আমরা শহীদ দিবসকে যে ২১শে ফেব্রুয়ারি বলে অভিহিত করি, বঙ্গাব্দ ধরলে সেটা কেউ বলতে পারবেন। অতটা দূরে যেতে হবে কেন, আজকের বাংলা সন-তারিখটা না ভেবে বলুন দেখি! এটা আসলে আমাদের চরম একটা অনাগ্রহ। আর ঔপনিবেশিক দাসত্বের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য। এটা ঠিক, আজকের দিনে ইংরেজি যেভাবে আমাদের রান্নাঘর থেকে শোওয়ার ঘরে গ্যাঁট হয়ে বসে গিয়েছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসাধ্য। কিন্তু, এটাও স্বীকার করতে হবে, বাংলাকে আত্মস্থ করতে আমাদের দুর্বলতা, কুণ্ঠা বা লজ্জাবোধ তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে।
আরও পড়ুন: International Mother Language Day: বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্যে অমর একুশে, সচেতনতার অমর দলিল
একুশে ফ্রেব্রুয়ারি ছিল খ্রিষ্টীয় বর্ষের একটি দিন। যে ভাষার জন্য এত বলিদান, সেই ভাষার জন্য লড়াই করার দিনটি যে বাংলা সন ও তারিখের বিচারে কবে, সেটাই ৯৯% বাঙালি জানেন না। তারিখটি হচ্ছে ৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ। আসল কারণ হচ্ছে, যে ভাষার জন্য এত আন্দোলন, এত আত্মত্যাগ, এত অহংকার, সেই ভাষার মূল্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটুকু? বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব তাদের জীবনে কতটুকু পড়েছে কখনও ভেবে দেখেছি? এ যুগে এ মাসের ইতিহাস জানা নেই অধিকাংশের কাছে, শিশুদের মধ্যে অনেকে বাংলা বর্ণই চেনে না।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং জীবনযাপন এখন পুরোপুরি পাশ্চাত্যমুখী। এই প্রবণতা বেশি তরুণ প্রজন্ম ও শিশুদের মধ্যে। বিদেশি ভাষা শিখতে গিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে এককথায় ধ্বংস করছি। অন্য ভাষা রপ্ত করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ হল কই! বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে একটা বংরেজি ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে।
‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। অনেক চড়া দামে কেনা স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সাক্ষী হয় আওয়ামি লিগ এবং বামপন্থী দলগুলোর মধ্যকার অন্তর্কোন্দল। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করার আগে পূর্ব পাকিস্তানকে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে যায়। তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের পক্ষে কেন, পৃথিবীর কোনও দলের পক্ষেই এত অল্প সময়ে সম্ভবপর হতো না। কিন্তু, বামপন্থীরা দেশের এই দুরবস্থা মেনে নিতে না পেরে এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্ব না পেয়ে দেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বিরোধী কাজে নামে। পুরোপুরি না হলেও প্রগতিশীল এই ২ দলের লড়াইয়ের ফসল ঘরে তোলে মৃতপ্রায় ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী দলগুলো।
মানুষ ক্রমশ ভুলতে থাকে স্বাধীনতার কথা, সাম্যবাদের কথা, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের কথা, শোষণ-মুক্তির কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, আধুনিকতার কথা। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ চেতনা তাদের মধ্যে প্রবলভাবে গেড়ে বসে। ছদ্ম-বামপন্থীরা ক্ষমতা লাভের নেশায় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে মানুষের মনে পরধর্মবিদ্বেষ এবং পরজাতিবিদ্বেষ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের জায়গায় বামপন্থীরা বসিয়ে দেয় ভারতকে। যে ভারত যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ১৭ মার্চ বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লোভে বামপন্থীরা দেশের মানুষের মধ্যে সুকৌশলে ভারতভীতি ও ভারতবিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেয়।
এই কী একুশের চেতনা ছিল? তা বোধহয় ছিল না। একটা ভাষাকে আঁকড়ে ধরে একটা দেশ স্বাধীন হওয়ার নজির বোধ করি আর কোনও দেশে নেই। কিন্তু, পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র সেই ভাষাকে জিততে দেয়নি। আজ হয়তো অনেক দেশে বাংলা নিয়ে পড়াশোনা-গবেষণা হয়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্তু তারপর। বলা হয়, ভাষা নাকি নদীর স্রোতের মতো। এগিয়ে চলে। কিন্তু, বাংলা ভাষা কি পেরেছে নদী হয়ে সাগরে মিলিয়ে যেতে! আমরাই তাকে মজা নদীতে পরিণত করেছি। সে কারণে মাতৃভাষাকে হত্যার দায় বাঙালিদেরই স্বীকার করে নিতে হবে।