হ্যাঁ, এটাকেই মাস্টারস্ট্রোক বলে, বিরোধী জোটের নাম ইন্ডিয়া কে দিলেন, কার মাথা থেকে এল? কে প্রথম ভালবেসেছে গোছের আলোচনা নাই বা করলাম, বহু পরে কোনও এক দিন এই সত্য তো বের হবেই, আলোচনাতেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যাঁর বা যাঁদের মাথা থেকেই বের হোক এটা মাস্টারস্ট্রোক। অনেকগুলো কারণের প্রথমটা হল এই অ্যাক্রনিম নিয়ে বিরোধিতা করতে গেলেই বিপত্তি সামনে এসে দাঁড়াবে। ইন্ডিয়ার নেতারা করাপটেড, বলতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি? বলতে পারবেন কর্মীদের, শপথ লো, ইন্ডিয়া কো হম হরায়েঙ্গে? ইন্ডিয়া কো কিসি ভি কিমত পর হারাও, বলতে পারবেন? কাজেই এটা হল প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হল তাঁদের আপাতত বাপকেলে সম্পত্তি দেশপ্রেমের গিনতি শেষ। মুচলেকা প্রেমী সাভারকরের শিষ্য যাঁরা এক দিনের জন্যেও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেননি, উলটে সাভারকর, গোলওয়ালকর থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, শ্যামাপ্রসাদের পুলিশ ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা চালিয়েছে, তাদেরই উত্তরসূরি আজ হঠাৎ বিরাট দেশপ্রেমী। যাঁরা স্বাধীনতার পরে ৩৫ বছর তাঁদের দফতরে দেশের পতাকাই তুললেন না তাঁরা ফাঁকতালে দেশপ্রেমিক বনে গেছেন। সেই তাঁরা দেশের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে ক্রমাগত দেশদ্রোহী দেশদ্রোহী বলেই চলেছেন, এবার সেই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেল। এক জাতীয়তাবাদী চেহারা তুলে ধরল এই বিরোধী জোট। এবার আসবে অন্য ইস্যুগুলো, বা বলা ভালো আসল ইস্যুগুলো, যা আমাদের প্রতিদিন ভাবাচ্ছে। প্রতিদিন যার ফলে দেশের মানুষ ক্রমশ গরিব হচ্ছে, আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে এবং বিজেপি সরকারের দিশাহীনতার ফলে এক অর্থনৈতিক অরাজকতার জন্ম দিচ্ছে। হ্যাঁ, এই জন্যই ট্যাগলাইন, লড়বে ইন্ডিয়া, জিতবে ভারত, জুড়বে ভারত, জিতবে ইন্ডিয়া। এই মুহূর্তে বিরোধী দলগুলো অন্তত একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ তৈরি করার সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে, একটা অসাধারণ অ্যাক্রনিম তৈরি হয়েছে, ট্যাগলাইন জবরদস্ত। কিন্তু তাতেই চিঁড়ে ভিজবে না, বেঙ্গালুরু বৈঠক আর ইন্ডিয়া নাম হওয়ার পরেই দেশের মানুষ মোদিজিকে হারিয়ে দেবেন না। তার জন্যও লড়তে হবে। এবার সেই লড়াইয়ের রাস্তায় কতটা সফল হবে এই জোট সেটা দেখার।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এই বিরোধী জোটকে এক জায়গায় আসতেই হবে তা হল নরেন্দ্র মোদির সরকার অর্থনীতি ধসিয়ে দিয়েছে, বেরোজগারি বেড়েছে, মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, ইডি সিবিআইকে দিয়ে বিরোধীদের শায়েস্তা করার কাজ চলেছে, সমস্ত বিরোধিতাকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার কাজ করেছে মোদি সরকার, এসব ঠিক আছে, কিন্তু এই জোট এসে সেই সব সমস্যাগুলোকে কীভাবে দেখবে? কীভাবে সামাজিক আর্থিক বৈষম্য কমাবে? কীভাবে মূল্যবৃদ্ধি কমাবে? কীভাবে চাকরির ব্যবস্থা হবে? কীভাবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লুঠ বন্ধ হবে? কীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা হবে? ৩৭০ ধারা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থাটা কী হবে? সিএএ, এনআরসি নিয়ে কী করবে এই ইন্ডিয়া জোট? ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে কীভাবে চলবে তাদের সরকার? এইসব বহু বিষয় নিয়ে তাদের একমত হতে হবে, এবং সেগুলো মানুষকে জানাতে হবে। আমরা তো জানি নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ নিয়ে এই জোটের মধ্যেই বহু পস্পরবিরোধী মতামত আছে, সেগুলো মিটবে কী করে? মানুষকে তো বলতে হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যে ব্যবসায়ীরা বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের নিয়ে কী করা হবে? কীভাবে ফেরত আনা হবে সেই টাকা? কেবল নরেন্দ্র মোদির সরকার খুউউউউব খারাপ বললেই মানুষ জোটের পক্ষে ভোট দেবে না, সে তার নাম ইন্ডিয়াই হোক বা ভারতই হোক। এই জোট তৈরি যে আসলে অনেক বৃহত্তর এক লড়াইয়ের সূচনা তা মানুষকে বোঝাতে হবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইন্ডিয়া বনাম এনডিএ
এ লড়াই নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নয়, এ লড়াই অমিত শাহের বিরুদ্ধে নয়, এ এক আসুরিক দর্শনের বিরুদ্ধে, যে দর্শন আমাদের দেশের ভাবনার বিপরীত। আমরা বলেছি বৈচিত্রের কথা, নানা ভাষা, নানা বেশ, নানা পরিধানের কথা, আমরা বলেছি সেই বৈচিত্রের কথা যেখানে প্রত্যেক ধর্মের মানুষের সহাবস্থান সম্ভব। আমরা বলেছি মানুষের ফ্রিডম অফ স্পিচ, বাক স্বাধীনতার কথা, ফ্রিডম অফ প্রোটেস্ট-এর কথা, আমরা বলেছি আপ রুচি খানার কথা, আমাদের দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে মানুষের খাদ্যাভ্যাস এক নয়, মানুষের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতেও হাজার ভাগ, আবার সেই ভাগের ভিত্তিতেও যে খাবার এক তাও নয়। উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণরা আমিষের কথা ভাবতেও পারে না, আমাদের বাংলার ব্রাহ্মণেরা মাছ মাংস অনায়াসেই খায়, দক্ষিণে কেউ খায় কেউ খায় না, এক্কেবারে পশ্চিমেও তাই। ভাষা আলাদা, ভাষা এক হলেও ডায়ালেক্টস আলাদা, এত শত বৈচিত্র নিয়েই এক বাগানের নাম হল ইন্ডিয়া, ভারতবর্ষ। সেই বাগানকে তছনছ করতে চায় এই বিজেপি আরএসএস এবং এটা তারা করতে চায় এক দর্শনের ভিত্তিতে, যেখানে তারা এক হিন্দুরাষ্ট্রের স্থাপনাকেই তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেই রাজনীতি করতে নেমেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই, কেবল ভোট কোথায় দিলেন, কাকে দিলেন? কে সরকারের কোন মন্ত্রী হবে সেটা ঠিক করার জন্য নয়। ২০২৪-এর নির্বাচন আমাদের দেশের বৈচিত্র্যকে, আমাদের দেশের মূল ধারণাকে আমাদের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে রক্ষা করার লড়াই। এই আরএসএস–বিজেপি শেখাচ্ছে মুসলমানরা ছিল বিদেশি, তারা দেশের দখল নিয়েছিল, তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে তারা আমাদের মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে নতুন স্বাধীনতা আনার কথা বলছে। ভুলিয়েই দেওয়া হচ্ছে মুঘল বংশের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সামনে রেখে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ ছিল আমাদের প্রথম স্বাধীনতার লড়াই। হিন্দু-মুসলমান বাউল-ফকির, সিপাহি এবং আম আদমি মিলে লড়াই শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার লড়াই, ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আজ মুসলমান বা সংখ্যালঘুদের মারা হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তাদের ধর্মস্থান ভাঙা হচ্ছে, হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলছেন সাংসদ, ভণ্ড সন্ন্যাসীরা। তাদের জেলে পোরা হচ্ছে না, তাদের মঞ্চে গিয়ে হাজির হচ্ছেন বিজেপির নেতামন্ত্রীরা। এসব লুকিয়ে লুকিয়ে হচ্ছে না, হচ্ছে প্রকাশ্যে। মানুষের পেটের লড়াই, বাসস্থানের লড়াই, চাকরির লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্যই ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেশের হাতে গোনা কিছু পুঁজিপতির জন্য কর্পোরেট হাউসের ১১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মাফ করে দেওয়া হল। ৫০ জন শিল্পপতি, যাদের আবার বেশিরভাগই মোদিজির বিশেষ পরিচিত, তারা ৬৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল। দেশের খেলাধুলোর জন্য বাজেট কত? যাঁরা দেশের জন্য সোনা রুপো আনেন তাঁদের জন্য বাজেট কত? ৩ হাজার কোটি টাকা, শিক্ষার বাজেট কত ৪৭ হাজার কোটি টাকা। আর ৬৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালাল শিল্পপতিরা। গত পাঁচ বছরে দেশের থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ গেছেন বিদেশে, দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে, যাঁরা মোদিজি বিদেশে গেলেই হাজির হন মোদি মোদি বলে চেল্লান, কিন্তু দেশে ফেরেন না। মোদিজি বলেন আমরা বিশ্বগুরু হয়ে গেছি। আমাদের পাশেই এক পুঁচকে দেশ দিল্লির জনসংখ্যার চেয়েও কম, সেই সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীর ১৯২টা দেশে যাওয়া যায়, তার মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স আছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের পয়সায় এসব দেশে যান, সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আমাদের পয়সায় কোটি কোটি টাকার উপহার দেন, কিন্তু আমাদের দেশের পাসপোর্ট নিয়ে সেদেশে ঢুকতে গেলে যে কড়াকড়ি আছে, যে নিয়ম পালন করতে হয়, তা অসন্মানজনক, এদিকে মোদিজি মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার হয়ে বসে আছেন। ডিএইচএফএল নামের এক কোম্পানি ৪২৮১৭ কোটি টাকার স্ক্যামে জড়িত, ১৭টা ব্যাঙ্কের পয়সা লুঠ করেছে, তারা বিজেপিকে ২৯ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। এটাই হচ্ছে বিজেপি। এইরকমই আরেকটা কোম্পানি এবিজে শিপ ইয়ার্ড ২৩ হাজার কোটি টাকার ঘাপলায় জড়িত, ২৮টা ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করেছে, তারা জেলে নেই। চিটফান্ড কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত এক শিল্পপতি ২০১৭ সালের এক ঘটনার উল্লেখ করে অভিযোগ করলেন, আমাদের চ্যানেলের সম্পাদককে ইডি গ্রেফতার করল। মানে তুমি লক্ষ কোটি টাকার ঘাপলা করো, আমাদের চাঁদা দাও, ব্যস, সব দোষ মাফ। আর বিরোধিতা করলেই ইডি।
এইরকম এক স্বৈরাচারী সরকারকে সরাতে হলে বিরোধী ঐক্য দরকার, সেই বিরোধী ঐক্যের সূচনা হয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে বসেছেন, পলিসি ঠিক করবেন, আগামী দিনে কীভাবে চলবে দেশ তা ঠিক করবেন, সেসব নীতি মেনে চলবে এই দলগুলো। কিন্তু এই চলা কি অতটাই সহজ? সহজ নয় কারণ এই জোটের মধ্যেই বসে আছেন জোট বিরোধীরা, যাঁরা জোটটাকে তাঁদের সারভাইভালের জন্য, টিকে থাকার জন্যই ব্যবহার করছেন। এই এরাই জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সময় সঙ্গে ছিলেন না, এই এঁরাই বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোট তৈরি করেছিলেন, তাঁদেরই প্রতিনিধি কাল সপাটে বলেই ফেললেন, আমাদের দলের নীতি বেঙ্গালুরুতে, কোনও বিরোধী বৈঠকে ঠিক হয় না, আমরা আমাদের দলে আলোচনা করেই আমাদের নীতি ঠিক করি। মানে খুব পরিষ্কার, বেঙ্গালুরু বা মুম্বই বা পাটনা বা দিল্লিতে বসে বিরোধী দলের মধ্যে যে আলোচনা হবে তার ভিত্তিতে নয়, ওনারা ওনাদের দলের মধ্যের আলোচনার ভিত্তিতেই চলবেন। তাহলে মহম্মদ সেলিমকে প্রশ্ন তো করাই যায় যে তাই যদি হয়, তাহলে এই বৈঠকে যাবার ভণ্ডামিটা করছেন কেন? আপনারা আপনাদের দলে বসেই ঠিক করুন, বৈঠকে বসবেন, বন্ধ দরজার ওপাশে আলোচনা করবেন, আলোচনায় যা হবে তা মানতেও পারেন আবার নাও মানতে পারেন এই শর্তে কি জোট সম্ভব? এনাদের এক উকিলবাবু আছেন, যিনি প্রশ্ন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস নিয়ে, তো সেই উকিলবাবুকে তো প্রশ্ন করাই যায় যে আপনিই বলুন না, কেন জয়প্রকাশের আন্দোলনে আপনারা শামিল হননি? কেন আপনারা এবং বিজেপি মিলে সমর্থন করেই চালিয়েছিলেন এক অকংগ্রেসি সরকার? কেন এতদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে ঘর করা নীতীশ কুমারের সঙ্গে মহা গঠবন্ধনে আপনাদের কোনও সমস্যা নেই? কারণ কি ঘুরপথে আবার রাজ্যসভার আসন? কত মধু গুড় পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে? কাম স্ট্রেইট, যা চান, স্পষ্ট করে বলুন। একটা বিরোধী রাজনৈতিক জোট হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন মতামত থাকবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই ঐক্য বৈঠকে যা হবে তা মানতেও পারি, নাও মানতে পারি এমন স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে বিরোধী ঐক্যের কথা বলা বন্ধ করুন। হ্যাঁ, আমাদের মনে আছে আপনারাও বিজেপির মতোই ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেননি, মস্কোর কথায় সেদিন আপনারা ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আবেদন করেছিলেন আপনাদের সমর্থকদের। কাজেই ইতিহাসের আলোচনা করতে হলে আরেকটু আগে থেকেই করুন, আর সেটা করলে আপনাদের দেউলিয়া চেহারা সামনে এসেই যাবে। আরএসএস–বিজেপির বিরুদ্ধে সার্বিক ঐক্য হোক, ইন্ডিয়া লড়ুক ভারত জিতুক, অসংখ্য গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের ইচ্ছে এটাই, কিন্তু ভেতরের ফিফথ কলামনিস্ট দের চিহ্নিত করে রাখাটাও সমান প্রয়োজনীয় কাজ।