Fourth Pillar | ইন্ডিয়া বনাম এনডিএ
প্রথম দৃষ্টিতেই প্রেমের মতন অনেক সময় কিছু একটা শোনার পরে, গভীরে গিয়ে আলোচনা না করেও মনটা ভালো হয়ে যায়। কোনও একটা ঘটনা, হঠাৎ চলে আসা কোনও তথ্য হঠাৎই আগের হতাশা, আগের গড্ডালিকা প্রবাহের উল্টোদিকে ঝর ঝর ঝরণার মত নেমে আসে নতুন আশা, নিউ হোপ। ঠিক সেরকম কাল দুপুরেই যখন খবর পেলাম বিজেপি বিরোধী এই রাজনৈতিক ঐক্যের নাম হয়েছে ইন্ডিয়া, তখন তা এক মূহুর্তে চিন্তা ভাবনাগুলোকে অন্য খাতে বইয়ে দিল। বিজেপির হাতে দুটো প্রবল তুরুপের তাস হল এক, হিন্দুত্ব, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, হিন্দুদের এক জায়গায় আসতে হবে, সনাতনীদের ভোট এক জায়গায় জড় করতে পারলেই ভোটে জিতে যাওয়া যাবে, মুসলমানরা ঔরঙ্গজেবের আওলাদ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষাক্ত প্রচার। কিন্তু মজার কথা হল বহু বহু চেষ্টা করেও, বিজেপি এখনও সেই অর্থে হিন্দু ভোটারদের ৪০% ও নিজের দিকে আনতে পারেনি, এখনও পর্যন্ত পারেনি। ওদিকে রাম মন্দির হয়ে গেছে, একটা মন্দির উদ্বোধন করে আবেগের বন্যা বইয়ে দেওয়া যাবে না। দুনম্বর অস্ত্র হল, জঙ্গী জাতীয়তাবাদ। আমরাই দেশপ্রেমী, আমরাই দেশকে ভালোবাসি, এমন একটা ন্যারেটিভ যেখানে বার বার করে বলা হবে ঐ বিরোধীরা দেশ বিরোধী, ভারত বিরোধী, ইন্ডিয়া বিরোধী। এবার এই দ্বিতীয় অস্ত্রের শান কমিয়ে দিল বিরোধীরা, ইন্ডিয়া ইন্ডিয়ার বিরোধী, এরকম আহাম্মকের মত কথাবার্তা বলার জায়গাটা কমে গেল। এবং এ নিয়ে যে হাজারো বোকামি করবে বিজেপি, তার প্রমাণ, কাল রাতেই ইন্ডিয়ার এক বর্ণনা দিয়েছেন কাঁথির খোকাবাবু।
ইন্ডিয়া মানে নাকি ইনকম্পিট্যান্ট, ন্যফারিয়াস, ডাইনাস্টিক, ইমমরাল, অ্যালায়েন্স। এটাই উনি টুইট করেছেন। মানে বিরোধীদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। উল্টোদিকে ডেরেক ও ব্রায়েন টুইট করেছেন, চক দে ইন্ডিয়া, রাহুল লিখেছেন ইন্ডিয়া জিতবে বিজেপি হারবে। হ্যাঁ অন্তত পারসেপশনের দিক থেকে ইন্ডিয়া এনডিএ-র থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গ্যালো। এরপর নিশ্চই এক ত্রিবর্ণ পতাকা, সঙ্গে সংবিধানের ছবির পাশে ইন্ডিয়া লেখা একটা লোগো বেরিয়ে আসবে, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু কাল তো একটা বৈঠক হয়নি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে এই প্রস্তুতি পর্বে দুই শিবিরই নেমেছিল, একইদিনে, একদল দিল্লিতে, অন্যদল বেঙ্গালুরুতে। সেই কবেই বেঙ্গালুরুর দিন ক্ষন জানিয়ে দিয়েছিল বিরোধীরা, থুড়ি ইন্ডিয়া, এবং অন্তত বিরোধীরা এক জায়গায় বসে পড়েছে সেটা দেখেই নি জার্ক রি অ্যাকশন বিজেপির। মোদি জামানায় এনডি-এর কোনও গুরুত্ব ছিল না, এনডিএ থেকে একে একে বেরিয়ে গিয়েছিল আকালি দল, শিব সেনা, জে ডি ইউ, শেষ পর্যন্ত ওই অপনা দল আর মহারাষ্ট্রের আটাওয়ালের মত কয়েকজন পড়েছিল, গুরুত্ব হারিয়েছিল এনডিএ। সেই কারণেই বিজেপি রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে এনডিএ র কোনও বৈঠক ডাকেনি, গুজরাট জয়ের পরে এনডিএ-এর মূখ্যমন্ত্রীদের এক ডিনারে ডাকা হয়েছিল, সেটা এনডিএ-এর বৈঠক ছিল না। আসলে এনডিএ-এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছিল বিজেপির কাছে। অন্তত বছরখানেক আগে ভেঙেছে শিবসেনা, সেই একনাথ সিন্দের শিবসেনা কে নিয়ে কোনও বৈঠক করেছে এনডিএ? করেনি। পাটনার বৈঠকের পরে হঠাৎই মোদি – শাহ বুঝতে পেরেছেন ইডি সিবিআই দিয়েও কাজ হচ্ছে না, বিরোধীরা এক জায়গায় বৈঠ করকে তো দিখাও, বিরোধীরা কেবল বসেনি, সেদিনের ১৬ দলের বদলে ২৬টা দল নিয়ে বেঙ্গালুরুতে বসে পড়ল, এক নতুন ইন্ডিয়ার জন্মও দিল।
কাজেই এতদিনের প্রো অ্যাকটিভ বিজেপি এবার রি অ্যাকটিভ মোডে এসেছে। এতদি বিজেপি একটা কিছু করতো, বাকিরা সেই কিছু নিয়ে তাদের মতামত দিতেন বা ব্যবস্থা নিতেন। এবারে খেলাটা উলটো, বিরোধীরা বৈঠকে বসছেন, বিজেপি এনডিএ-এর বৈঠক ডাকছে, বিরোধীরা ইন্ডিয়া তৈরি করছেন, কাঁথির খোকাবাবু এ বাংলায় ইন্ডিয়াকে নিয়ে তামাশা করছেন। বিজেপি কেবল এনডিএ-এর বৈঠক ডেকেছে তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সব চোরেরা এক জায়গায় বসেছে, নাড্ডাজি জানিয়ে দিয়েছেন ওরা ২৬? মাত্র ২৬? আমরা ৩৮। একেই বলে নি জার্ক রি অ্যাকশন। কারা আছেন এই ৩৮ টা দলে? সে এক দিন ছিল যখন বিজেপির ছিল ৩০৩, শরিকদের ৫৫, সব মিলিয়ে এন ডি এর ছিল ৩৫৮ জন সাংসদ। এখন? বিজেপির ৩০১ জন, আর শরিকদের ২৮ জন, সেটাও শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে আসা ১৩ জন সাংসদ, এনসিপি ভেঙে বেরিয়ে আসা প্রফুল্ল প্যাটেলকে নিয়ে। অন্যদিকে ইন্ডিয়ার কাছে আছে ১৫৭টা আসন। বিজেপির ভোট পার্সেন্টেজ ৩৭.৭৬% আর আপাতত যাঁরা বিজেপির সঙ্গে আছে, তাদের মিলিত ভোট পার্সেন্টেজ হল ৭%। মানে এই মূহুর্তে এনডিএ-এর সম্মিলিত ভোট হল ৪৪.৭৬%। বিজেপিকে বাদ দিলে ওই ৩৭ টা দলের ৯ টা দল গত লোকসভায় একটা আসনেও প্রতিদন্দ্বিতা করেনি। ১৬ টা দল প্রতিদন্দ্বিতা করেছিল কিন্তু কোনও আসন পায়নি। মানে ৩৮ থেকে ২৫ বাদ হয়ে গ্যালো। রইল বাকি ১৩ টা দল। ৭টা দল আছে যারা ১টা করে আসনে জিতেছিল, তাহলে রইল বাকি ৬। তাদের মধ্যে বিজেপি এখন ৩০১, লোক জনশক্তি পার্টির দুটো ভাগ, কাকা পারস আর ভাইপো চিরাগের, দুই গোষ্ঠিই এনডিএ- তে আছে, তাদের ৬ জন সাংসদ আছে, শিবসেনা সিন্দে গ্রুপের কাছে আছে ১৩ টা আসন আর অপনা দলের কাছে আছে ২ টো আসন, সব মিলিয়ে ৩২৯। অর্থাৎ ৩৮ টা দলের ২৫ টা দল দুধুভাতু? না একদম তা নয়, এরা ছোট দল, রাজ্যে সামান্য ভোট বা সমর্থন আছে, বিজেপি তাদেরো সঙ্গে রাখার চেষ্টা করছে, ডুবতে হুয়ে কো তিনকে কা সাহারা চাহিয়ে।
অন্যদিকে ইন্ডিয়ার ভোট পার্সেন্টেজ কত? ৩৮.৭২। এবং এই ইন্ডিয়ার দলগুলোর বাকি শরিকরা যথেষ্ট বড় দল, একটা আধটা ওই দুধুভাতুদের মধ্যে পড়ে। এবার আপনার মনে হতেই পারে যে ৪৪% আর ৩৮ % এর মধ্যে কি আর লড়াই হবে? না ভোটের ক্যালকুলেশন ওরকম হয় না, এবার মূল শিবির দুটো, কাজেই মাত্র ৪% ভোট এনডিএ থেকে ইন্ডিয়াতে এলেই এনডিএ ৪০, ইন্ডিয়া ৪২ হয়ে যাবে, ৩% কমলে এন ডি এ ৪১, ইন্ডিয়া ৪১ হয়ে যাবে, ২% কমলে এনডিএ ৪২, ইন্ডিয়া ৪১, মানে ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলবে। হ্যাঁ সেখানেই খেলা জমে উঠেছে। আরও তথ্য আছে, বিজেপি এই মূহুর্তে ১২ টা রাজ্য শাসন করছে, তারমধ্যে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্যও আছে, আবার অন্যদিকে উত্তর প্রদেশও আছে। কিন্তু ইন্ডিয়া ১১ টা রাজ্য শাসন করছে এবং তাদের রাজ্যগুলোও ছোট নয়, সবকটাই বড় থেকে মাঝারি, কেবল হিমাচল প্রদেশ ছোট, এমন কি দিল্লিতেও ৭ টা আসন আছে। আর একটা অন্যভাবেও দেখা যায়, বিজেপি বা এনডিএ শাসিত ১২ টা রাজ্যে মোট ২১৯ টা আসন আছে, অন্যদিকে ইন্ডিয়া শাসিত ১১ টা রাজ্য থেকে নির্বাচিত হন ২৪৩ জন সাংসদ। কাজেই চাপ আছে কাকা, চাপ আছে। কিন্তু এই ক্যালকুলেশনে সবচেয়ে বড় অংশটা আপাতত লুকিয়ে আছে এনডিএ আর ইন্ডিয়ার বাইরে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আকালি দল এন ডি এ তে নেই, আকালি দল ভেঙে এক পুঁচকে দল তৈরি হয়েছিল আকালি দল সম্যুক্ত, তারা এনডিএ তে আছে। এদিকে পঞ্জাবে বিজেপির ২ টো আসন আছে। আকালি দলের সমর্থন ছাড়া বিজেপির জেতা অসম্ভব, তাই আকালি দল কে আনার চেষ্টা চলছিল, আকালি দলও রাজী হচ্ছিল, মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেই ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বললেন তখনঈ গোটা শিখ সম্প্রদায় রেগে গ্যালো, উত্তর পূর্ব সমেত ভারত বর্ষের আদিবাসীরা রেগে গ্যালো। কাজেই দেখুন ওই কথা বলার পরেই বিজেপি ব্যাকফুটে, আর ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে কথা বলছে না, ২০২৪ এর আগে বলবেও না। কিন্তু আকালি দল লিখিত প্রতিশ্রুতি চাইছে, সেটা বিজেপি দিতে পারবে না। উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি কী করবে, সেটা তো ঐ দলের নেত্রী মায়াবতীও বলতে পারবেন না, বিজেপির ধারে গেলে সমস্ত মুসলমান ভোট চলে যাবে, ইতিমধ্যেই বিজেপি নন জাটভ দলিত ভোটে থাবা বসিয়েছে, অন্যদিকে অখিলেশের সঙ্গে কংগ্রেস, বহেনজীর নাপসন্দ। অন্য ফল্ট লাইন হল তেলেঙ্গানায় কে সি আর, বিজেপি বিরোধী ফ্রন্ট গড়তে নীতিশের কাছে চলে গেলেন, মমতার কাছে চলে এলেন, কিন্তু তারপর বুঝতে পেরেছেন যে তেলেঙ্গানাতে তাঁর প্রতিপক্ষ বিজেপি নয়, কংগ্রেস, কাজেই নির্বাচনের আগে তিনি কোনও কথাই বলবেন না, নির্বাচনের ফল বের হবার পরে যা খুশি তাই হতে পারে, উনি এন ডি এ না ইন্ডিয়া যে কোনও জায়গাতেই যেতে পারেন, কেবল ওনার রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় থাকলেই হল। অন্ধ্রতে জগন রেড্ডিও ২০২৪ এর নির্বাচনের পরেই শিবির বাছবেন, কিন্তু তার আগে উনি দেখে নেবেন ওনার প্রতিদন্দ্বী চন্দ্র বাবু নাইডু কোনদিকে? একই সমস্যা চন্দ্র বাবু নাইডুর, এককালে এন ডি এর মুখ, পরবর্তিতে বিরোধী জোটের মুখ চন্দ্রবাবুও দুবিধায়। রয়েছেন বিজু জনতা দলের নবীন পট্টনায়ক। যদি দেখেন লোকসভা ভোটে ওনার সমর্থনে সরকার তৈরি হবে, তখন উনি শিবির নিয়ে দর কষাকষি করবেন, আর তাঁর সমর্থন ছাড়াই যদি কেউ দিল্লিতে সরকার তৈরি করে, উনি নির্দ্বিধায় তাকে সমর্থন করবেন, সে সরকার মমতা, মেহেবুবা মুফতি, রাহুল গান্ধী, শিবু সোরেন বা এম কে স্তালিন যার খুশি হোক, তিনি সরকারের পক্ষে থাকবেন। এবং লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট জনতা দল সেকুলার, দেবেগৌড়ার দল, দেশের একমাত্র দল যাঁরা দেবেগৌড়া পরিবারের কম করে ১৩/১৪ জন কে নির্বাচনে প্রার্থী করে, যাঁরা বিজেপি কংগ্রেস, অবিজেপি অকংগ্রেস সবরকমের জোটে থেকেছেন, তাঁরা এবারে বিজেপির সঙ্গে যেতে চান, কিন্তু বিজেপি জল মাপছে, কেবল আত্র ভোক্কালিগাদের ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে এই দল এলে যেটুকু লিঙ্গায়েতরা আছে তারাও সরে যাবে না তো? এবং দেবেগৌড়ার এই দল বিজেপির সঙ্গে গেলে কর্ণাটকের বচাখুচা উসলমান ভোটও চলে যাবে কংগ্রেসের দিকে। কাজেই এই বিচ কা খিলাড়ি, মধ্যের খেলোয়াড়েরা খুব গুরুত্ব পূর্ণ, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আগামী ছ মাসের মধ্যে হবে এমন ৫ টা রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল, বিজেপি এই পাঁচটাতে হারলে খেল খতম, ইন্ডিয়া জিতবেই, এন ডি এ হারবেই। চাকা ঘুরছে এবার ইন্ডিয়ার জেতার পালা।