১৪০ কোটির যে ভাগ্যবানেদের ঘরে টিভি আছে, পেটের অন্ন জোগানোর জন্য যা যা করার তারপরেও খানিক সময় বের করে দেশের সেই সব মানুষ দেখল, চন্দ্রযান ৩ থেকে বেরিয়ে আসা বিক্রম চাঁদের মাটি ছুঁল। যার ভেতর থেকে এই লেখার বহু আগেই বেরিয়ে এসেছে প্রজ্ঞান। এবং এক সর্বব্যাপী উল্লাস ছড়িয়ে গেল দেশের সর্বত্র। দেশের এমন উল্লাসের সময় বিজ্ঞান, যুক্তি, তর্ক এসবের অবকাশই নেই, কাজেই উল্লাস জোহানেসবার্গ থেকে শ্রীহরিকোটাই নয়, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ছড়িয়ে গেল যাঁরা সজ্ঞানে নিজেদের ভারতবাসী বলেন, তাঁরা উল্লসিত হলেন, গর্বিত হলেন। এই বিরাট অ্যাচিভমেন্ট কাদের জন্য এল, কাদের হাত ধরে এল? প্রাপ্তির পরেই এ প্রশ্ন আসে, আসবেই। যে কোনও জয়, যে কোনও প্রাপ্তি, যে কোনও বুলস আই হিট-এর পরেই এ প্রশ্ন আসে, আসাটা স্বাভাবিক। এর কৃতিত্ব কি চন্দ্রযান ৩-এর টিমের সদস্যদের? ইসরোর বৈজ্ঞানিকদের, ইসরো পরিচালন কর্তৃপক্ষের? সম্মিলিত ভক্তকুলের উল্লাস এ জয় মোদিজির জয়, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। উল্টোদিকেও স্বর শোনা যাবে, জওহরলাল নেহরু থেকে দেশের মহাকাশ গবেষণায় প্রত্যেক পদক্ষেপের সম্মিলিত জয়। কিন্তু এ সবই আংশিক সত্য। হ্যাঁ, এটা নরেন্দ্র মোদির জয়, ডিমনিটাইজেশনের মতো আহাম্মক সিদ্ধান্ত তিনি এখানেও নিতে পারতেন, বলতেই পারতেন এসব করে লাভ নেই, বলেননি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়নি। হ্যাঁ, দেশের স্বাধীনতার পরে যে নেহরু বিজ্ঞান সংস্থা গড়েছেন, মহাকাশ গবেষণা সংস্থার শুরুয়াত করেছেন, এ জয় সেই নেহরুর থেকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের, প্রতিটি সরকারের। এই চন্দ্রযান নামটাই তো দিয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।
কিন্তু আমি এই কৃতিত্বকে এত ছোট করে দেখছি না। যে মানুষ তখনও ভাষা শেখেনি, কিন্তু আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, যে মানুষ সম্ভবত আকাশের চাঁদ দেখে গোলাকার চাকা আবিষ্কার করেছিল, সেই নিরন্তর অনুসন্ধিৎসা, আরও জানতে চাওয়া, আরও প্রশ্ন করা মানব সভ্যতার সম্মিলিত ফল এই জয়, এই অ্যাচিভমেন্ট। দেশে দেশে বহু কিছু নিয়ে স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, গোপন গবেষণাগারে চলে জীবনদায়ী ওষুধের গবেষণা, কারণ তা এনে দিতেই পারে লক্ষ কোটি বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। ততধিক গোপন গবেষণা চলছে মারণাস্ত্র নিয়ে, এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় গোটা একটা দেশ, তার গবেষণাও চলে সঙ্গোপনে। মহাকাশ গবেষণাও ততধিক গোপনেই শুরু হয়েছিল, কোল্ড ওয়ারের সময় রাশিয়া তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল একের পর এক মহাকাশযান পাঠিয়ে, যদিও তাদের টেক্কা দিয়ে ৭২ এ আমেরিকার নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখলেন। ৬৯-এ পাকিজা ছবির গান তখন বেজেছিল আবার নতুন করে, চলো দিলদার চলো, চাঁদ কে পার চলো। কিন্তু সেই অসহযোগিতা বা গোপন গবেষণার দিনগুলোতে সাফল্যের হার ছিল খুব কম, ৫০ শতাংশের তলায়। বহুবার অসফল হয়েছে বহু অভিযান। কিন্তু সে সব ব্যর্থতার থেকে পৃথিবী বুঝেছিল, মহাকাশ গবেষণা কেবল একার বিষয় নয়, ইতিমধ্যে কোল্ড ওয়ার থেমেছে, শুরু হয়ে গেল এই মহাকাশ গবেষণা নিয়ে একে অন্যের সহযোগিতা। ব্যর্থতার হারও কমে এল। আমেরিকা চীনকে সহায়তা করছে, ভারত জাপানকে, জাপান আমেরিকাকে, আমেরিকা ভারতকে। এক দেশ অন্য দেশের স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, এক দেশ তার ব্যর্থতার যাবতীয় তথ্য শেয়ার করছে অন্য দেশের সঙ্গে। চন্দ্রযান ৩-এর বেশ কিছু অংশে নাসার বৈজ্ঞানিকদের প্রত্যক্ষ সাহায্যও ছিল, বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য ছিল, বিভিন্ন দেশের গবেষণার নির্যাস কাজে লেগেছে, এবং সব মিলিয়ে সফলতা। ঠিক দক্ষিণ মেরু নয়, তার অনেকটা কাছাকাছি আলতো করে, বৈজ্ঞানিক ভাষায় সফট ল্যান্ডিং করল বিক্রম, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল প্রজ্ঞান।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এক ডজন চুরির তথ্য বলছে চৌকিদার চোর হ্যায়
৩.৮ বিলিয়ন বছর কত হবে গুগল করে দেখে নিন, ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে তখন পৃথিবী জেলির মতো থকথকে, তাতে এসে ধাক্কা মারল প্রায় মঙ্গল গ্রহের আকারে এক বিরাট মহাজাগতিক তারকা, থিয়া, পৃথিবীর কিছু অংশ ছিটকে গেল, যে অংশটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল না, সে পাক দিতে থাকল পৃথিবীর চারপাশে, ঠান্ডা হল, সেই উপগ্রহই আজকের চন্দ্রমা, যেখানে বার বার মানুষ যাওয়ার চেষ্টা করছে, গিয়েছে, নেমেছে। কিন্তু আবার যাওয়ার চেষ্টা করছে কেন? দেখা তো হয়ে গেছে, পৃথিবীর যে সব দেশে মহাকাশ, পৃথিবীর ইতিহাস, ধাতু ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা হয়, তাদের প্রত্যেকের গবেষণাগারে চাঁদের পাথরের টুকরো আছে। তাহলে কোন দরকারে আবার চাঁদে যাওয়া? কারণ এর আগের বেশিরভাগ অভিযান হয়েছে চাঁদের আলোকিত দিকটাতেই, এবার সেই ছায়াচ্ছন্ন দিকে মানুষের চোখ যেখানে হয়তো জমে রয়েছে জল, বরফ হয়ে। নজর আরও কিছু ধাতুর ভাণ্ডারের দিকে যা পাওয়া গেলে মানব সভ্যতা আরও খানিক এগিয়ে যাবে। কিন্তু জল নিয়ে হবেটা কী? আর চাঁদের বুকে খনন? তাহলে তো সেখানে থাকতে হবে। হ্যাঁ, এইখানেই এই চন্দ্র অভিযানের গুরুত্ব, এইজন্যই মানুষ বার বার যাচ্ছে চাঁদে, এরপরে চীন যাচ্ছে, জাপান যাচ্ছে, ভারতের কারিগরি সহায়তা নিয়ে আমেরিকার আর্টেমিস–৩ ২০২৫-২৬ নাগাদ চাঁদের এই ছায়াচ্ছন্ন দিকে মানুষ পাঠাচ্ছে, তাদের ট্রেনিং চলছে। জাপানের লুপেক্স প্রজেক্ট-এও ভারতের ল্যান্ডার ব্যবহার করা হবে, এ নিয়ে কথা চলছে। কারণ মানুষ যদি জানতে পারে চাঁদে আছে জল, তাহলে সেই জলই হবে তাদের জ্বালানি, সেখান থেকেই অক্সিজেন হাইড্রোজেনকে তারা ব্যবহার করবে জ্বালানি হিসেবে। চাঁদে তৈরি হবে নতুন রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র, সেখান থেকে মানুষ যাবে আরও দূরের গ্রহে, আর চাঁদের মাটির তলা থেকে নিয়ে আসতে পারবে জরুরি ধাতু। তাই মানুষ বারবার চাঁদে যাচ্ছে।
আচ্ছা এই চন্দ্র অভিযানে ভারত ঠিক কোথায়? ভারতের ক্রায়োজনিক রকেট সায়েন্টিস্ট নাম্বি নারায়ণের হাত ধরে অনেকটাই এগিয়েছে, আজ বিশ্বের সবথেকে হালকা কেবল নয় সবথকে কম খরচে আমাদের এলভিএম-৩ থেকে উড়ে যাচ্ছে মহাকাশযান, যেখানে লিকুইড নয়, সলিডিফায়েড অক্সিজেন, হাইড্রোজেন জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা আরএসএলভি, জিএসএলভি ১, জিএসএলভি ২ পার করে এলভিএম ৩ নিয়ে এগোচ্ছি। এইবারের চন্দ্রযান ৩-এর মোট খরচ হয়েছে ৬১৫ কোটি, যেখানে আমাদের দেশের দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের খরচ হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ২৫০ কোটি টাকা, মানে তিন কিলোমিটারের কম খরচে আমরা চাঁদে বিক্রমকে নামিয়ে দিয়েছি। এর ফলে বিশ্বের বহু ছোট দেশ আমাদের দেশের রকেট প্রক্ষেপণ ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে তাদের স্যাটেলাইট পাঠাবে। দেশের আবহাওয়া বিজ্ঞান গবেষণার যন্ত্রপাতি পাঠানো যাবে, আগের থেকে অনেক অ্যাকিউরেট আবহাওয়ার খবর পাচ্ছি আমরা, আরও নির্ভুল আবহাওয়ার আগাম খবর পেলে আমাদের অনেক লাভ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন হবে, মোবাইল নেটওয়ার্ক ভুলে যান, আর কিছুদিন পর থেকে স্যাটেলাইট ফোন মানুষের হাতে হাতে ঘুরবে। এবং আজ থেকে ৭৪ বছর আগে যখন চন্দ্র অভিযান, মহাকাশ অভিযান শুরু হয়েছিল, তখন থেকে মাত্র পাঁচ বছর আগেও এই ক্ষেত্রে টাকা ঢেলেছে রাষ্ট্র, আমেরিকা, চীন, জাপান, জার্মানি, ইজরায়েল, ভারত প্রত্যেকে, আমার আপনার পয়সা সেখানে গিয়েছে। গবেষণা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, এইবার ফসল ধরছে, অমনি শকুনের দল নেমে আসছে দলে দলে, আমেরিকা, ভারত, নাসা, ইসরোর আর্টেমিস প্রজেক্টে বিরাট বিনিয়োগ ইলন মাস্কের, ইতিমধ্যেই আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গেছে সেই ব্যক্তিগত পুঁজির বিনিয়োগ। এবারের চন্দ্রযান ৩-এর ক্ষেত্রেও কিছুটা হলেও আছে। এই ৭৪-৭৫ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফল নিতে তারা এগিয়ে আসছে, তারাই আগামী দিনে দখলদার, তারাই খাবে বহু পরিশ্রমের ফসল।
এটা যেমন একটা দিক, অন্যদিকটা আরও করুণ। প্রান্তিক মানুষজন যদি বা জেনেও থাকে এই সাফল্যের কথা, তাহলেও প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পরেই তাদের প্রশ্ন ছিল, এতে আমাদের কী লাভ? এমন প্রশ্ন বিজ্ঞান গবেষণা শুধু নয়, ইতিহাস, ভূগোল, গণিতের গবেষণা বা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়েও ওঠে, কারণ পূর্ণিমার চাঁদ যে কোনও সময়েই এক ভুখা মানুষের কাছে ঝলসানো রুটি হয়েই থেকে যায়। দিন আনি দিন খাই মানুষজন এই প্রশ্ন করবেই, সেই কবে আমরা স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি, আজ টেলিভিশন থেকে শুরু করে জিপিআরএস সিস্টেম, বহু জায়গা থেকে লাভ তো আসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে তার কতটা পৌঁছচ্ছে? এটা বড় প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে। তারই সঙ্গে যোগ হয়েছে অবিজ্ঞান, কুসংস্কার, আর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির নানান ইনপুট। শিক্ষিত মানুষজন, লিখছেন সফট ল্যান্ডিংয়ে সফল আমরা এবার এই প্রযুক্তি বিক্রি হবে, কেউ লিখছেন মহাকাশের মার্কেটের ২ শতাংশ আমাদের ছিল তা এবার বেড়ে যাবে, কেউ আবার আরও একধাপ এগিয়ে এই চন্দ্রযান সাফল্যের সঙ্গে মিসাইল পাঠানোকে জুড়ে দিয়েছেন। দিতেই পারেন, কোথাও না কোথাও এসবের এক যোগাযোগ তো থাকেই, কিন্তু এগুলো হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য অন্তত যাচাই করুন, তারপর শেয়ার করুন। আসলে বস্তু থেকে চেতনা আর চেতনা থেকে বস্তু, এই দুটো বিরাট বৈজ্ঞানিক আর দার্শনিক বিষয়ের দ্বন্দ্ব বহুকালের, বিজ্ঞানের প্রতিটা পদক্ষেপ বস্তু থেকে চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কোনও মন্ত্রপাঠে, কোনও পুজোয়, কোনও শান্তি স্বস্ত্যয়নে বা কোনও ভগবান আল্লা গডের পক্ষে চন্দ্রযান ২কে হার্ড ল্যান্ডিং থেকে বাঁচাতে পারেনি, ল্যান্ডিংয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সেদিনের পরে মন্ত্র পড়ে ভগবান আল্লাহ গডের কাছে প্রার্থনা করে নয়, আগের ভুল শুধরে নিয়েই বিক্রম নেমেছে চাঁদে। এটাই বিজ্ঞান, যার প্রতিটা অগ্রগতি যুক্তিবাদকে আলৌকিকতা, আধ্যাত্মিকতা থেকে আলাদা করে, প্রতিষ্ঠা করে। এক্কেবারে শেষের কথা, কী আশ্চর্য, এবারেও চন্দ্রযান ৩-এর ল্যান্ডারের নাম বিক্রম, তার থেকে বেরিয়ে আসবে যে যন্ত্র তার নাম প্রজ্ঞান, প্রজ্ঞা নয়, তাপসী নয় বিক্রম। হ্যাঁ, অবচেতন হলেও পুরুষপ্রধান সমাজের মানসিকতা কাটানো আজও গেল না, তবুও আশা করব, এরপর তাপসী নামবে মহাকাশে, তার পেট থেকে বেরিয়ে আসবে প্রজ্ঞা, অর্ধেক আকাশের সে ইচ্ছেও নিশ্চয়ই পূরণ হবে একদিন।