কোভিডের সময়েই তিনি যা একটু আটকে পড়েছিলেন, ভারি দুকখু ছিল মনে, দেশ ঘোরা হচ্ছে নে কো। হ্যাঁ, আমাদের চৌকিদার কাম চায়ওলার কথাই বলছি। তো কোভিড শেষ, তিনি নেমে পড়েছেন দেশ ঘুরতে, দেশ ঘোরা আর শিল্পপতি বন্ধুদের বাণিজ্যে সাহায্য করা, মানে রথ দেখা আর কলা বেচা আর কী। তো এবার গেলেন আমেরিকায়, যেখানে সেই কবেই স্বাধীনতা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেও এক লোকদেখানো গণতন্ত্র আছে, নাকি ইংরিজিতে সেই গণতন্ত্রের ব্যাখ্যানও আছে। তো সে দেশে গিয়েই এবার আমাদের মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার অফ পাওয়ার এক নতুন কাণ্ড ঘটালেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন নিলেন, একটাই নিলেন, পালটা প্রশ্ন অ্যালাউ করা হয়নি। কারণ প্রশ্নের উত্তরে উনি নির্ভেজাল মিথ্যে বলে যাবেন, এবং স্বাভাবিকভাবেই সেসব মিথ্যে শুনে যদি ফাদার অফ পাওয়ারকে কেউ পালটা প্রশ্ন করে বসেন, তাহলেই তো কেলো। কাজেই একটাই প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়েছে, সেও একজন পাকিস্তানি অরিজিনের আমেরিকান নাগরিককে, যাতে বলাই যায়, পাকিস্তানে ডেমোক্রেসি আছে নাকি? তাদের প্রশ্ন করার অধিকারটাই তো নেই। যাই হোক প্রশ্ন এল, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার আপনার দেশে নাকি গণতন্ত্রই নেই, গণতন্ত্রহীনতার বহু প্রমাণ উঠে আসছে, তো আপনি এই গণতন্ত্র ফেরাতে কোন পদক্ষেপ নেবেন? মানে মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার অফ পাওয়ারকে শিল্প নিয়ে প্রশ্ন নয়, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন নয়, চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন নয়, এবারের আমেরিকা ভ্রমণে তাঁর প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন গণতন্ত্র নিয়ে। তো মোদিজি এমনিতে বিদেশে গেলে খানিক ইংরিজিই বলেন, কিন্তু এদিন তিনি জানেন মাতৃভাষায় অনায়াসে যে মিথ্যে বলা যায়, তা তো ইংরিজিতে গুছিয়ে বলা যাবে না, তাই উনি হিন্দিতেই বললেন। গলায় খানিক ঝাঁজ আর আশ্চর্য মিশিয়ে তিনি বললেন, তাই নাকি? আরে আমাদের দেশে তো গণতন্ত্রই আছে, আমাদের ডিএনএ-তে গণতন্ত্র আছে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো সেই গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন, তাঁরাই একটা সংবিধান দিয়েছেন, যে সংবিধান হাতে নিয়েই আমরা চলেছি।
খি খান্ড? মোদিজির মুখে ভারতের সংবিধান, যারা মনুস্মৃতিকে সংবিধান বানাতে চায় সেই আরএসএস প্রচারক ঠেলায় পড়ে সংবিধানের কথা বলছেন। অবশ্য বিদেশে বলছেন, বিদেশে গিয়ে এরকম ব্যতিক্রমী কাজ উনি করেই থাকেন, সৌদি রাজার জন্মদিনে চলে যান, মিশরে তো এবার এক মসজিদেও চলে গেলেন। তো সেরকম এক ব্যতিক্রমী কাজের মতোই আমাদের ফাদার অফ পাওয়ারের মুখে সংবিধানের কথা শোনা গেল, যে সংবিধান শুরু হয়েছে উই দ্য পিপল দিয়ে, এদিকে আমাদের মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার অফ পাওয়ার কিংবা তাঁর সাকরেদদের জানাই নেই উই দ্য পিপল কারা। মানে কারা এই দেশের নাগরিক? যাঁরা ভোট দিয়ে তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়েছে, এটা জানার জন্য তাঁরা এনআরসি এনেছেন, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করেছেন, এবং সেই বিল পাশ হয়ে যাওয়ার তিন বছর পরেও সেই আইনকে কার্যকর করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারেননি। সেই মোদিজি আমেরিকায় একঘর সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরার সামনে জানালেন না যে তাঁর নেতৃত্বে সরকারে একজনও সংখ্যালঘু মন্ত্রী নেই, যে দেশে সংখ্যালঘুরা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, তিনি জানালেন না তাঁর দলের ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে একজনও সংখ্যালঘু নেই। তিনি জানালেন না যে আগামী লোকসভার নির্বাচনে ৫৪২টা আসনের একটাতেও কোনও সংখ্যালঘুকে দাঁড় করানোর কোনও পরিকল্পনা তাঁদের নেই। এটাই তাঁদের সবকা সাথ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস, যা এক বিশুদ্ধ বাওয়াল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পাটনায় বিরোধী দলের বৈঠক কি অশ্বডিম্ব প্রসব করল?
তিনি যখন এই কথা বলছেন, তখন আমাদের দেশের এক প্রান্ত জ্বলছে, মণিপুরে ক’দিনের জাতিদাঙ্গায় মারা গেছেন ১০০-র বেশি মানুষ, যে মণিপুরে চলছে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। যে জাতিদাঙ্গার পরে ৫৯ দিন কেটে গেল, আজ পর্যন্ত তিনি একটা বিবৃতি দেননি, শান্তি ফিরিয়ে আনার আবেদনও করেননি। যে ছোট্ট রাজ্যের নির্বাচনের প্রচারে তিনি অন্তত চারবার গিয়েছিলেন, অজস্র মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন, তৈরি করেছিলেন এক স্থায়ী ক্ষত, এক জাতি ঘৃণার প্রেক্ষাপট, যার থেকে বের হতে কত সময় লাগবে তা আমাদের জানা নেই। সমতলে মহিলারা হাতে মশাল নিয়ে রাত পাহারা দিচ্ছেন, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধের সামনে দাঙ্গায় অভিযুক্ত ১২ জনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে আর পাহাড় জঙ্গলে প্রশাসন বলে কিছুই নেই। কেবল হিন্দু ভোট পাওয়ার নোংরা রাজনীতি আজ এই আগুন জ্বালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হোয়াইট হাউসে বসে পোর্টাবেলা মাশরুম খাচ্ছেন, বাইডেন পত্নীকে ২৮ কোটি টাকা দামের হিরে উপহার দিচ্ছেন, সেই তিনি নিজে বিবাহিত এই খবরটাই চেপে রেখেছিলেন ২০১৪ পর্যন্ত। তো সেই মাদার অফ ডেমোক্রেসির আসল ছবির কিছু নমুনা, আসুন দেখে নিই। আমাদের চৌকিদার কাম চায়ওয়ালা যখন আমেরিকায় গণতন্ত্রের বাওয়াল দিচ্ছেন, তারপরের রাতের ঘটনা। পুলওয়ামার জাদুরা গ্রামে মাঝরাতে ৫০ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর জওয়ানেরা এসে হাজির হয়। ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন জাদুরা নাগরিক সমাজের চেয়ারম্যান আলতাফ ভাট এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা। সেই জওয়ানেরা আসতে গ্রামের লোকজন মনে করে নিশ্চয়ই এঁরা কোনও উগ্রপন্থী ইত্যাদির খোঁজ পেয়ে এসেছে, কাজেই যে যাঁর ঘরে ঢুকে পড়েন। কিন্তু তাঁদের ডাকা হয়, জওয়ানদের কমান্ডার বলেন, এই এলাকায় নতুন এক বাহিনী এসেছে, তারা উগ্রপন্থা দমন কীভাবে করা যাবে তা শেখাতেই এসেছে। গ্রামের মানুষরা বলেন, তাহলে দিনের বেলায় আসুন, মাঝরাতে কেন? এরপর তর্কাতর্কি, গ্রাম থেকে ছেলেদের পেটাতে পেটাতে বার করা হয়, দশ জনকে ধরে বেধড়ক মারা হয়, লাঠি আর বেল্ট দিয়ে, তাদের রক্তাক্ত ছবি তাঁরা প্রেসের কাছে দিয়েছেন। এখানেই থামেনি, জওয়ানেরা এদেরকে বেঁধে স্থানীয় মসজিদে নিয়ে যায়, ততক্ষণে ফজরের নমাজের সময় হয়ে গিয়েছে, যিনি আজান দিতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ওই মাইকেই জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করে জওয়ানেরা, এরপর ওই দশজন যুবককেও জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করে ওই কমান্ডার এবং জওয়ানেরা। এতদিন যে অত্যাচার চালাচ্ছিল বজরং দল বা হিন্দু সেনা ইত্যাদিরা, এখন সেই দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে দেশের সেনাবাহিনী। ৫০ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর মতো বাহিনী এবং ১৮৩ সিআরপিএফ ব্যাটেলিয়নের সৈন্যরা। যে সেনাবাহিনী আমাদের পয়সায় দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে, তাঁরা আদতে জঙ্গি হিন্দু সংগঠনে রূপান্তরিত হচ্ছে, এটাই আপাতত ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের চেহারা। একদিকে এই বাহিনী ভয়ে কুঁকড়ে উগ্রপন্থী সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া ১০ জনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কারণ তাদের ঘিরে ধরেছিল মেইতেই মহিলারা। অন্যদিকে তারাই মসজিদে গিয়ে নিরস্ত্র যুবকদের বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে জয় শ্রীরাম বলাচ্ছে, ভোরবেলায় কাশ্মীরের এক গ্রামের মানুষ শুনছেন তাঁদের মসজিদের মাইকে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার অফ পাওয়ার তার আগের রাতে বলেছেন, আমাদের শিরায় ধমনীতে নাকি গণতন্ত্র বইছে এবং সেই গণতন্ত্র তিনি ডেলিভার করছেন। এর থেকে নিখাদ বাওয়াল আর কোনওদিন শুনেছেন?
এবার চলুন কানপুরে, সেখানে মোদিজির চেয়েও আরেক কাঠি সরেস আদিত্যনাথ যোগী আছেন। যিনি নাথ সম্প্রদায়ের কনফোড় যোগী, যে নাথ সম্প্রদায় আসলে হিন্দু সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ধর্ম হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু সে সব তো ইতিহাস, আর কে না জানে ইতিহাসে বড্ড অনীহা ওই ভক্তদের। সেই কানপুরে আকবরপুরের শাহজাদপুর গ্রামের এক খ্রিস্টান স্কুলের প্রাঙ্গণে তৈরি হচ্ছিল এক চার্চ। খানিকটা নিজেদের প্রাঙ্গণ বলে, খানিকটা এক প্রত্যন্ত অঞ্চল বলেই স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুমতি ইত্যাদি নেননি, তো কিছু মানুষ এই চার্চ তৈরিতে বাধা দেন, প্রশাসনের তরফে নোটিস দিয়ে চার্চ তৈরি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় ১৬ জুন। এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল, কারণ সংখ্যালঘু বলেই আইন মানব না তা তো হয় না। কিন্তু ২৪ তারিখ বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বেশ কিছু লোকজন এসে সেই নির্মীয়মাণ চার্চ ভেঙে চুরমার করে সেখানে জয় শ্রীরাম প্ল্যাকার্ড টাঙিয়ে দিয়ে যায়, সে প্ল্যাকার্ড এখনও ঝুলছে। না, প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বজরং দলের জেলা আহ্বায়ক গৌরব শুক্লা আর নেতা অজিত রাজ প্রশাসনকে বলেছিলেন, ওই চার্চ ভাঙতে হবে, নাহলে আমরা ভাঙব, তো ভেঙে দেখিয়ে দিলেন। সংক্ষেপে এটাই হল আপাতত আমাদের দেশের গণতন্ত্র, দেশের সেনাবাহিনী মসজিদে মানুষকে জয় শ্রীরাম বলাচ্ছে, আর বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা প্রশাসনের চোখের সামনে ভেঙে দিচ্ছে চার্চ। ওদিকে মাদার অফ ডেমোক্রেসির ফাদার অফ পাওয়ার আমেরিকাতে বসে গণতন্ত্রের বাওয়াল দিচ্ছেন।