৬০-৭০ দশকে মানুষের মুখে মুখে ঘুরত সিআইএ আর কেজিবির গল্প। শুনেছি কালোদার চায়ের দোকানের নিয়মিত খদ্দের পঞ্চুদা একবার বলেছিল, বেশি বেড়ে খেলো না সিআইএ লেলিয়ে দেব। আমেরিকার সিআইএ কেন যে বেহালার পঞ্চুদার কথায় ছুটে আসবে তা জানা ছিল না কিন্তু সিআইএ যে এক বিষম বস্তু তা জানা ছিল। এখন সেই জায়গাতে এসেছে সিবিআই আর ইডি। মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলেছেন কদিন আগেই, মোদি সরকার কে দো ভাই, ইডি আউর সিবিআই। তো সেই সিবিআই এবার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির পিছনে কার্যত রাজ্য মন্ত্রিসভাই দায়ী, এরকমটা বলল। সিবিআই বা ইডির রকম সকম হল খানিকটা অরণ্যদেবের মতো, তারা হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়, তারা হঠাৎই আবির্ভূত হয়। তারা যদি মনে করে আপনাকে ধরবে, তাহলে ধরে, যদি না মনে করে, তাহলে ধরে না। যদি মনে করে আপনাকে কিচ্ছুটি জানাবে না, তাহলে আপনি জানতেও পারবেন না ইডি বা সিবিআই কী করছে, কিন্তু সবটাই জানতে পারবেন, যদি ওরা সেটা জানাতে চায়, এক্কেবারে অরণ্যদেব। তো আজ তারা এক খামবন্ধ রিপোর্ট জমা করেছে সুপ্রিম কোর্টে যা কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদমাধ্যমের হাতে পৌঁছেছে, আমাদের হাতেও। যেখানে এই দুর্নীতির মাথায় বসানো হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের মাথায় বসা মানিক ভট্টাচার্যকে। এবং এই দুর্নীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাজ্য প্রশাসন এবং সরকারকে। আজ সেই প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই-এর রিপোর্টই হল বিষয় আজকে।
২৮ পাতার এই সিবিআই রিপোর্ট অত্যন্ত নিপুণভাবে সাজানো হয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে, পালাবদলের পরে বাম জমানার অবসানের পরে তৃণমূল জমানা আসার কিছুদিনের মধ্যেই, মানে মে মাসে সরকার এসেছে। জুলাই মাসেই এই মানিক ভট্টাচার্যকে পর্ষদের সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়, সেই সময়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য বসু। এরপরে সিবিআই-এর রিপোর্টে আছে কীভাবে এই পর্ষদের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এই মানিক ভট্টাচার্য। এরই মধ্যে ২০১৪তে প্রাথমিকে নিয়োগের কাজ শুরু হয়, এরই মধ্যে ৩ এপ্রিল ২০১৭তে পর্ষদের বৈঠকে এক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্ত পেপার ডকুমেন্ট ডিজিটাইজ করার পরে নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। পর্ষদের বাকি সদস্যরা নাকি সিবিআইকে জানিয়েছেন এসব তাঁদের অজান্তেই করা হয়েছে। এরপর সিবিআই-এর রিপোর্টে কেমন করে এই নিয়োগ দুর্নীতি করা হয়েছে এবং সেই দুর্নীতিতে মানিক ভট্টাচার্যই যে কিংপিন ছিলেন তাও বলা হয়েছে। তার প্রমাণ স্বরূপ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | মিছিলে মিলেছি কেন না আমরা…
এরপর এসেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই মানিক ভট্টাচার্যকে ২০১১তে কেবল নিয়োগ নয়, ২০২২ পর্যন্ত তাঁকে কীভাবে ওই পদে রেখে দেওয়া হয়েছে তাও জানানো হয়েছে। প্রথমে তাঁকে ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত এক্সটেনশন দেওয়া হয়, অর্থাৎ তাঁর কার্যকাল বাড়ানো হয়, কিন্তু ৬২ আর কতদূর? কিন্তু ৬২ হবার আগেই পর্ষদ সভাপতির পদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৬৫ করা হল, কীভাবে? পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা আইন ১৯৭৩-এর সংশোধনী এনে, মানে? মানে হল রীতিমতো ক্যাবিনেট বৈঠক ডেকে এই আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে, পদের ঊর্ধ্ব বয়স সীমা ৬২ থেকে ৬৫ করা হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়, আবার এই ৬৫ পার করতে চলেছিলেন মানিক ভট্টাচার্য, তাই আবার আইনের সংশোধনী এনে ৬৫কে ৬৮ করা হয়েছিল, মানে এরপরে তা নিশ্চয়ই ৭০,৭২,৭৫ পর্যন্ত যেত, কিন্তু তার আগেই দুর্নীতির চেহারা বাইরে চলে আসায় ২০২২-এ তাঁকে সরে যেতে হয়। সেই কারণেই সিবিআই প্রাথমিক শিক্ষা দুর্নীতির তদন্তের পরে এই ২৮ পাতার রিপোর্টের ২৬ নম্বর পাতায় বলছে, Thus, the above facts afford reasonable ground to believe that there was well orchestrated design on the part of Government of West Bengal administration with avowed oblique motive to accommodate Shri. Manik Bhattacharya as the President of West Bengal Board of Primary Education. মানে এইভাবে মানিক ভট্টাচার্যের কার্যকালের সময় বাড়াতে থাকাই প্রমাণ করে যে এই দুর্নীতিতে সরকার, প্রশাসনের হাত ছিল।
একটা জিনিস তো ঠিকই, দুর্নীতি তো হয়েছে। হ্যাঁ, সিবিআই বিজেপির কোনও দুর্নীতি দেখতেই পায় না, হ্যাঁ, দুর্নীতি করে বিজেপিতে চলে গেলে তার বিচার হয় না, হ্যাঁ, বিজেপি এক ওয়াশিং মেশিন যেখানে গেলেই দুর্নীতি সাফ হয়ে যায়। এ সবই সত্যি, তেমনই সত্যি এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দূর্নীতি তো হয়েছে, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিই শুধু নয়, মেধার অপমানও এক বড় ব্যাপার, মেধাবী ছাত্ররা কেন দুর্নীতির কাছে হেরে যাবেন? এ প্রশ্ন তো সবার। এ নিয়ে রাজ্য সরকারের দায় নেই? অবশ্যই আছে এবং সিবিআই কিছু করার আগেই এই সব দুর্নীতিবাজ মানুষদের, ওই মানিক ঘনিষ্ঠদের চিহ্নিত করা হোক, আরও কারা আছে এই দুর্নীতিতে তাদের বের করা হোক। এ দাবি তো আমাদের থাকবেই, কেন সাধারণভাবেই সরকার তার একটা স্বচ্ছ চেহারা নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হতে পারে না? এ প্রশ্ন তো আমাদের থাকবেই।