বার্লিন: যদি জানতে চাওয়া হয়, বলুন তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে কবে? উত্তর দিতে সময় লাগবে না। কিন্তু, যদি প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা ৯০ বছর আগে ১৯৩৩ সালের ১০ মে কী ঘটনা ঘটেছিল। তাহলে অনেকেরই গলা শুকিয়ে যাবে। ইতিহাসবেত্তারাও মাথা চুলকোতে থাকবেন। ঠিক তাই, এই দিনটিতেই তিলেতিলে জার্মানির একচ্ছত্র নায়ক হয়ে ওঠা অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনী ২৫ হাজারের বেশি অ-জার্মান বই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। বিশ্বের তাবড় প্রখ্যাত লেখক-দার্শনিকদের গ্রন্থদাহনের যজ্ঞ চলেছিল দেশজুড়ে।
ইহুদি জ্ঞান-দর্শনবাদকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে এবং নাৎসি চিন্তাভাবনার পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বইগুলিকে চিহ্নিত করে এদিন পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে করে হিটলার-বাহিনী দেশের বুক থেকে নাৎসি বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবতীয় সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনের বই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নারকীয় উল্লাসে মেতে ওঠে। ইহুদি লেখকদের বই, যেগুলিতে ব্যক্তি স্বাধিকার, শারীরিক বাধা এবং যুদ্ধের ক্ষতিকর দিকের সমর্থনে লেখা রয়েছে, সেগুলিকে মুছে দেওয়ার লীলায় মাতে নাৎসি বাহিনী।
আরও পড়ুন: Madhyamik Result | ১৯ মে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ, টুইট করে জানালেন শিক্ষামন্ত্রী
কারা ছিলেন নাৎসিদের নিশানায়? হেলেন কেলার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জ্যাক লন্ডন, সিনক্লেয়ার লিউইস এবং ইহুদি মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস, বার্টোল্ট ব্রেশট, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও হেনরিখ হেইন। পরবর্তীকালে এরিক জনসন এবং কার্ল হেইনজ রব্যাঁ লিখিত হোয়াট উই নো টেরর, মাস মার্ডার অ্যান্ড এভরিডে লাইফ ইন নাজি জার্মানি বইয়ে সেদিনের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। লিলিয়ান টি মোয়ার নামে জার্মানিতে বসবাসকারী এক মার্কিনের বর্ণনা অনুযায়ী, আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিলাম। ওরা যখন প্রথমে একটি বইয়ে আগুন লাগাল তখন মনে হচ্ছিল জীবন্ত কারও গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সকলে জানে গোয়েবলসের বিষ এই ঘটনার পিছনে ছিল। এরিখ রিমার্কের লেখা অল কোয়াইট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এর মধ্যে সবথেকে বেশি ধিক্কার কুড়িয়েছিল।
বার্লিনে গ্রন্থদাহন যজ্ঞের শিকার ছিলেন প্রখ্যাত লেখিকা হেলেন কেলার। মাত্র ১৯ মাস বয়সে যিনি একসঙ্গে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারিয়েছিলেন। স্পর্শের মাধ্যমে তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলেন আর এক বিদূষী মহিলা, তাঁর নাম অ্যান সুলিভান। কেলার তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় যে খ্যাতি পেয়েছিলেন তা সহ্য হয়নি জার্মান শক্তির। প্রতিবন্ধকতার সব দরজা ভেঙে আলোর পথ দেখানো কেলার ছিলেন সমাজতন্ত্র, বিশ্বশান্তি এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের সমর্থক ও প্রচারক। তাই তিনি ছিলেন নাৎসিবাদের কাঁটা। সে কারণে তাঁর লেখাও রোষানলে পড়েছিল স্বৈরতন্ত্রের। তারপরেও তিনি তাঁর বইয়ের জার্মান স্বত্বাধিকারের অর্থ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দৃষ্টিশক্তি হারানো সেনাদের তহবিলে দান করেছিলেন।
জার্মান ছাত্রদের উদ্দেশে লেখা তাঁর খোলা চিঠি ছিল এইরকম, তোমরা যদি মনে করো বুদ্ধিবৃত্তিকে হত্যা করা যায়, তাহলে বলি তোমরা ইতিহাস থেকে কিছুই শিক্ষা পাওনি। এর আগে স্বৈরাচারী রাজারাও একই চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিচারবুদ্ধি, চিন্তাশক্তির আবার জাগরণ হয়েছে এবং অত্যাচারী শাসকের ধ্বংস হয়েছে। তোমরা আমরা বই পোড়াতে পারো। ইউরোপের সেরা মানুষদের বইও জ্বালিয়ে খাক করতে পারো। কিন্তু, তাঁদের সকলের চিন্তাভাবনা বা ধ্যানধারণা স্রোতের মতো লক্ষ লক্ষ মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে পৌঁছে গিয়েছে। যা ছড়িয়ে পড়বে আরও মানুষের মনে।