বইয়ের কোনও দিবস হয় না। রাত্রিও। বইয়ের যা হয় তা একটা অপার্থিব সমুদ্র। অবিরাম বিশ্রামহীন ঢেউয়ের আদিমতম সংলাপ। অনন্ত নক্ষত্রবীথি। মহাসিন্ধুর স্বরূপে আকাশে আকাশে চেতনার ঝরনা-স্ফুরণ। সেই বই আঁকড়ে ধরে ভাষার কল্পনায় ডুবে যাওয়া এক নীরব কিশোরের দূরতম কোনও জানলা।
অক্ষর চিনে নেওয়ার প্রথম বইটির কথা আবছা মনে আছে। স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ । বর্ণপরিচয়। শোনা যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় কোনও এক পালকিযাত্রার পথে ‘বর্ণপরিচয়’ লিখেছিলেন। সংস্কৃতের খটমট নিগড় থেকে ভাষাশিক্ষার শৈশবকে মুক্তির বাংলা দিয়েছিলেন। মনে আছে ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ নামের একটি বিশাল পুস্তকের কথা। যার পাতায় পাতায় অনেক দেশের নাম। আর তাদের রাজধানী। একেবারে মাঝের পাতায় চ্যাপ্টা মত অতিকায় পৃথিবীর ছবি। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ, বিষুবরেখা, কর্কটক্রান্তিরেখা, মূল মধ্যরেখা।
শৈশবে যে বইটি না পড়লে ছোটবেলা মিথ্যে হয়ে যেত বলে আজও মনে হয়, তার নাম ‘সহজপাঠ’। এত সহজ করে বাংলাভাষা আর কেউ শেখায়নি। শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, রূপকথার রামধনু মেশানো ছোটবেলার যে কল্পনার জগত। যে জগতে কল্পনায় ডানাওলা সাদাঘোড়াগুলো মেঘ পেরিয়ে ভেসে ভেসে আসত তার সুতো বাঁধা ছিল সহজপাঠের পাতায়। ‘ওইখানে মা পুকুর পাড়ে/ জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে/ হোথায় হব বনবাসী/ কেউ কোত্থাও নেই…রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে/ মারবে উঁকি আড়ে আড়ে/ দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি/ ধনুক নিয়ে হাতে’… হারিকেনের আলোয় পড়তে পড়তে মনে হত সত্যিই জিয়ল গাছের আড়ালে রাক্ষস-খোক্কসেরা উঁকি মারছে। ‘বাদল করেছে। মেঘের রং ঘন নীল। ঢং ঢং করে ন-টা বাজল। বংশু ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? ও যাবে সংসারবাবুর বাসায়। সেখানে কংস-বধের অভিনয় হবে।’ এই যে একটা বাক্য লিখলেন। মাত্র দুই শব্দের ‘বাদল করেছে’। শেখালেন ‘মেঘের রং ঘন নীল’। এতেই এক কিশোরের কতকিছু অজানা দিগন্ত খুলে গেল। যেখানে আকাশ ঝুঁকে আছে। যেখানে এক বাদলবেলার সন্ধেয় গ্রাম্য পালাগান শুরু হবে। মাথায় কাপড় জড়িয়ে ত্রিপলের আসনে বসে সেই কিশোর। ক্ল্যারিওনেট বাজছে। চড়বড়ি বাজছে। লেখার নীচে নন্দলাল বসুর রেখাচিত্র। কংসবধের ছবি। মাটিতে পড়ে কংস। তার বুকের উপর তরবারি হাতে বিক্রম দেখাচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ।
আরও পড়ুন- Poila Baisakh: বৈশাখে রচিত এক দুপুরে থেমে যাওয়া দেওয়াল ঘড়ি
এক-একটা বইয়ের বুকের ভিতর এক এক সময়ের কাহিনি। অধ্যায়
শৈশব কেটে যায়। কল্পনার ঝুলিতে ততদিনে এসেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। ততদিনে সে জেনে গিয়েছে অতল সায়রের নীচে রাক্ষসের প্রাণ বন্দি আছে বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখা এক কালো ভ্রমরে। তেপান্তরের মাঠ। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সংসার। বুদ্ধু আর ভুতুমের দুখি মায়েদের জীবনগাথা। কুঁচবরণ কন্যার মেঘবরণ কেশ।
ঠাকুরমার ঝুলির ভিতর অগুনতি বিকেল-সন্ধে-রাত্রির জপমালা ঘুরে চলে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, অবন ঠাকুর, জুলে ভার্ন, নটিলাসের ক্যাপ্টেন নিমো, হ্যারিয়েটের ‘আঙ্কল টমস কেবিন’। চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অফ টু সিটিস’। শিশু ভোলানাথ। লীলা মজুমদারের ‘সব ভুতুড়ে’। মাটিতে রাখা লন্ঠনের নিভু আলো। তার ছায়া এসে পড়েছে মেঝেয়। সেভাবেই শৈশবের মায়া কাটিয়ে একদিন কিশোরের হাতে এসে পড়ে নিকোলাই অস্ত্রভস্কি। ইস্পাত। বরিস পলেভয়ের ‘মানুষের মত মানুষ’। কিশোর মাউজার পকেটে গরিব মানুষের জন্য দুনিয়া পালটে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
আরও পড়ুন- Lata Mangeshkar: ছোটবেলার একটা ঢাউস রেডিও আর লতা মঙ্গেশকর
মাঝ মধ্যেই ভাবি বই আমাকে কী কী দিয়েছে? জীবনে বিকেল এসেছে অনেক আগেই, সাঁঝবেলাও দোরগোড়ায়। যে ঘরে থাকি তার চারদিকে শুধুই বইয়ের কথা বলা। বিরাম বিশ্রামহীন ঢেউয়ের আদিমতম সংলাপ। অনন্ত নক্ষত্রবীথি। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি। ধুলো ঝেড়ে দিই। পাতা উলটোই। এক-একটা বইয়ের বুকের ভিতর এক এক সময়ের কাহিনি। অধ্যায়। পাতায় পাতায় কত সম্পর্ক শুরু আর ঝরে পড়ার হেমন্তবেলা। আমি তার শরীরের গন্ধ শুঁকতে থাকি।