সেই কবেকার অনুরোধের আসরে বৃষ্টি পড়ছে , আর পড়েই চলেছে। মফস্সলের ঝিল ঘেঁষা বাড়ি। ঘুলঘুলির জাফরি দিয়ে বাতাস বইবার সময় গা ছমছমে সোঁ-সোঁ শব্দ। ঝড়বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। হারিকেনের আলোয় পড়া শিখতে শিখতে ভেসে আসছে গান (Lata Mangeshkar)। বাড়িতে একটা ঢাউস রেডিও (Radio)। বাবার কোনও পরিচিত বন্ধু বোধহয় তৈরি করে দিয়েছিলেন। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মা বিবিধ ভারতী দিয়েছে। কেউ গাইছেন (Lata Mangeshkar Song), ‘অন্ধ খনির অন্তরে থাকে যে সোনা সবাই, জানে তারই কথা…বুঝবে না, কেউ বুঝবে না কি যে মনের ব্যথা…’
এ ভাষা বোঝার বয়স তখনও হয়নি। কিন্তু সুর আর স্বরের মোহ মায়ায় কি একটা ভাললাগা তৈরি হত। নাকি শুধু ভাললাগাই নয় হয়ত ব্যাখ্যার বাইরে কোনও এক অপার্থিব অনুভূতি বোধ। ‘সোনালী বিকেলে গাছের ছায়ায় মুখোমুখি বসে নীল সন্ধ্যায়, জীবনানন্দ তুমি তো শোনাতে’…মা গুনগুন করে গাইত। সেই প্রথম জীবনানন্দের নাম শুনলাম। জানতাম না তিনি একজন বাংলাদেশের মাটি-মাখা কবি। ভাবতাম জীবনানন্দ নামের কোনও এক চরিত্র নীল সন্ধ্যায় মুখোমুখি বসে আছেন।
পুজোর আগে গান বেরতো। নতুন, পুরনো শিল্পীদের অ্যালবাম। রেডিওয় একটা দু’টো করে আসত সেই সব গান। ‘কেন কিছু কথা বলো না, শুধু চোখে চোখ চেয়ে যা কিছু চাওয়ার আমার’…বাবা সলিল চৌধুরীকে দাদা বলে সম্বোধন করতেন। সুরের চলন শুনেই বলে দিতেন এটা সলিলদা’র সুর। এ রকম চলনেরই একটা গান রেডিওয় খুব বাজত। ‘পা মা গা রে সা, তার চোখের জটিল ভাষা…’
কয়্যারের লোকজনও বাড়িতে আসতেন। ইয়ুথ কয়্যার না ক্যালকাটা কয়্যার। কল্যাণ সেন বরাট। সুব্রতকাকু। পুরো নাম ভুলে গিয়েছি। ব্যাংকে চাকরি করতেন। শম্ভু জ্যেঠু, মানে শম্ভু ভট্টাচার্যও বোধহয় এক দু’বার এসেছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা সলিল চৌধুরীর সুরে, কয়্যারেরই একটা অনুষ্ঠানে শম্ভু ভট্টাচার্যের পারফরমেন্স দেখলাম। ‘রানার রানার, ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল/ আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে কবে এই দুঃখের কাল…’ এই গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর দু’জনেই গেয়েছেন।
আরও পড়ুন Lata Mangeshkar Passes Away: জারা আঁখ মে ভর লো পানি
পুজোয় মামার বাড়ি গিয়ে এক আশ্চর্য যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় হল। গোল চাকতির রেকর্ড প্লেয়ার। তাতে হাতলে লাগানো পিন বসিয়ে দিলে গান বাজতে থাকে। গোল চাকতির দুটো পিঠেই গান বাজে। একই গান বারবার বাজানো যায়। সে বছর মাদার ছবির গান খুব হিট। মামার বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ারে ‘বাজত হাজার তারার আলোয় ভরা চোখের তারা তুই স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোকে কান্না দিয়ে ধুই।’
এক অসুখের বিকেলে। মনখারাপের এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। নাগরিক বেলুনওলার হাতছুট বেলুন উড়ে গিয়েছে আকাশে। আমি দেখছি এই বাড়ির কার্নিস টপকে, মাঠ পেরিয়ে রাস্তার দিকের হলুদবাড়ির ছাদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কতদূর কোথায় চলে যাচ্ছে। জানলার গ্রিলের বাইরে মনে মনে আমিও যেন উড়ে চলেছি শহরের এক দিক থেকে আর এক প্রান্তে। অসুখ আর মনখারাপের বিকেলে রেডিওয় গান বাজছে ‘যারে উড়ে যারে পাখি ফুরলো গানের পালা শেষ হয়ে এলো বেলা…’