‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’ সপ্তপদী সিনেমার এই গান ও দৃশ্যটি বাঙালির চোখে ও মনে ক্যানভাসের মতো সেঁটে আছে। মনে আছে, এনফিল্ড রয়্যাল বুলেটে চড়ে উত্তমকুমার-সুচিত্রার স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানোর ইচ্ছের কথা। কিন্তু সেটা ১৯৬১ সাল। লিটার প্রতি পেট্রোলের আনুমানিক দাম ছিল— ৭২ পয়সারও কম। কারণ ১৯৬৩ সালে মাদ্রাজে ৫ লিটার পেট্রোলের দাম ছিল ৩ টাকা ৬০ পয়সা। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ সিনেমায় যে গাড়িটিকে বোম্বে কাঁপাতে দেখা গিয়েছিল ’৬২ সালে তাতে তেল ভরা হয়েছিল ৮৬ পয়সা লিটারে। আর আজ তা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দিয়ে দেশবাসীর কপালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাকেও এই ‘অগ্রগতি’র দৌড়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে ৫৬ ইঞ্চির মানচিত্র। কেননা, পাকিস্তানে পেট্রোলের দাম— কমবেশি ৫১ টাকা ১৪ পয়সা। শ্রীলঙ্কায় যার মূল্য ভারতীয় টাকায় ৬০ টাকার কাছাকাছি। অন্যদিকে, বাংলাদেশে তেল কিনতে হয় ৮৯ বাংলাদেশি টাকায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, দামবৃদ্ধির এই পারদ চড়ার শেষ কোথায়? দেখা যাচ্ছে, গত দু’মাসে এ নিয়ে ৩৫-তম দামবৃদ্ধি ঘটল পেট্রোল-ডিজেলের। যা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পাম্প মালিকরাও। তাই এর প্রতিবাদে আগামী ৭ জুলাই আধঘণ্টার জন্য পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। গাড়ির জ্বালানিতে আগুন লাগায় বিক্রিতেও টান পড়েছে তাঁদের। আর মধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ী, মাছ, ফুল, বিভিন্ন সামগ্রীর এজেন্ট, যাঁদের রুটিরুজির ভরসা বাইক, তাঁদের পকেট ফাঁক হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সম্প্রতি রান্নার গ্যাসেরও দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশের মানুষ ‘আচ্ছে দিনে’র সঙ্গে লড়াইয়ে বিপন্ন বোধ করছেন। বাজারে বেরলেই মধ্য ও নিম্নবিত্তরা সেকথা টেরও পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: রাফাল ইস্যুতে মোদিকে খোঁচা রাহুলের
কেন এরকম চলছে? এর মুখ্য কারণ হল এদেশে পেট্রোলের আকাশচুম্বী চাহিদা। গাড়ির জ্বালানি ব্যবহারে আমেরিকা ও চীনের পরেই রয়েছে আমাদের দেশ। যেখানে ভারতে প্রায় ৮২.৮ শতাংশ অপরিশোধিত তেলই আমদানি করতে হয়। আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪৫.৩ শতাংশ আমদানি করে দেশকে সচল রাখতে হয়। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এই জ্বালানি-দম্পতির মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেই ভারতের হেঁসেলে অশান্তি বাড়ে। দ্বিতীয়ত, চাহিদা বৃদ্ধি। করোনাকালে বহু লোক নিজ বাহনে যাতায়াত করায় হঠাৎ করে পেট্রোল-ডিজেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধিতেও চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। এর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যের অভাব। টাকা ও ডলারের বিনিময় মূল্যের ওপর নির্ভর করে অপরিশোধিত তেলের ক্রয় ক্ষমতা। টাকার অবমূল্যায়নের জন্যই আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে রোজ হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হচ্ছে।
আরও যে বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে, তা হল— কর কাঠামো। ২০১৪ সালে যেখানে পেট্রোলে এক্সাইজ কর ছিল ৯ টাকা ৪৮ পয়সা। ডিজেলে ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। সেখানে চলতি বছরে সেটা হয়েছে পেট্রোলে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা ও ডিজেলে ৩১ টাকা ৮০ পয়সা। পরিস্থিতি যাইহোক, জ্বালানি তেল হল দেশবাসীর কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের অন্যতম রাস্তা। যার মধ্যে ভারত অগ্রগণ্য জায়গায় রয়েছে। জ্বালানি তেল বাবদ যেখানে জার্মানি ও ইতালি কর বাবদ আদায় করে ৬৫%, ব্রিটেন ৬২%, জাপান ৪৫%, আমেরিকা ২০ %। সেখানে ভারত সরকার আমাদের পকেট থেকে কেটে নেয় প্রায় ২৬০%।
এই অবস্থায় আমরা যাই কোথায়? আমরা সাধারণ মানুষ যেন সমুদ্র মন্থনের সেই পর্বত, যাকে নিয়ে শাসক-বিরোধীরা টানামানি করে চলেছে। শাসক মন্ত্রীরা বলে চলেছেন আন্তর্জাতিক বাজারের কথা। একসময় তাঁরাই জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির জন্য মনমোহন সিংকে কচুকাটা করেছিলেন। কিন্তু, খেটে খাওয়া মানুষের কী হবে?
আরও পড়ুন: রাফাল: বিরোধী কাঁটায় বিদ্ধ মোদি
করোনা অন্তে রাজ্যে পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার কথা থাকলেও সাধারণ মানুষ জানেন রাস্তার পরিস্থিতি কী? তার নেপথ্যেও পেট্রপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। অফিস-কাছারি খুলে গেছে। মানুষকে রোজই কাজের তাগিদে বেরতে হচ্ছে। কিন্তু বাস কোথায়? তাই ব্যাঙ্ককর্মীকেও নির্মাণকর্মীর সঙ্গে ছোটা হাতিতে চাপতে হচ্ছে। পরিচারিকার সহযাত্রী হাসপাতালের নার্স। কোনও পেশাকেই ছোট করছি না! বন্যার সময় যেমন মানুষ ও সাপ একই গাছে ওঠে, বিষয়টি অনেকটা তেমন। ফলে রোজ গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে নিতান্ত কাজ বাঁচাতে মানুষকে প্রাণ বাজি রাখতে হচ্ছে। ভাড়া না বাড়ালে বাসের চাকা গড়াবে না— বলে দিয়েছেন মালিকরা। সেটা হলে আরও একটা খাঁড়ার কোপ পড়বে আমজনতার ওপর।
সুতরাং, কোষাগার বাঁচাতে কেন্দ্রকে অবশ্যই তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে টাকার। শিল্পপতিদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে বকেয়া কর ও ঋণ। অভ্যন্তরীণ সম্পদবৃদ্ধির পরিমাণ বাড়াতে হবে। সরকারি সম্পত্তি বেচে এই ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকা সহ ইউরোপীয় খ্রিস্টান দেশসমূহের তল্পিবাহক হলেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে তেলের ভাণ্ডার আরব দেশগুলির সঙ্গেও। আমেরিকার সুতলি দড়িতে বাঁদর নাচ দেখাতে গিয়েই সর্বনাশ হচ্ছে, এটা বুঝতে হবে। ইজরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্রভিক্ষা করতে গিয়ে আমরা আরব দুনিয়া থেকে বিমান চালানোর রসদ হারাচ্ছি না তো! সুতরাং, দেশকে সচল রাখতে তেলকে বাঁধতেই হবে। নইলে কোষাগারে রাজস্ব বৃদ্ধির ঝোঁকে দেশটাই না থমকে যায় একদিন!