রবিবার দুবাইতে ভারত বনাম পাকিস্তানের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলা নিয়ে উন্মাদনা ছিল চরমে। বিশ্ব কাপ ক্রিকেটে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান কোনো কালেই এঁটে উঠতে পারেনি। স্বভাবতই রেকর্ডের নিরিখে বিশ্লেষক থেকে আম ক্রিকেট প্রেমী জনতা ভারতকে এগিয়ে রেখেছিল। ময়দানের বয়ানে ‘এডভান্টেজ ভারত’। ফল অবশ্য হলো উল্টো। ভারত গোহারা । এত গেল নিছকই ক্রিকেটীয় আলোচনা। এই অনুষঙ্গে কার ব্যাটিং লাইন আপ কেমন। কার হাতে কতজন বোলার। তাদের স্ট্রাইকিং রেট কেমন ,ইত্যাদি প্রভৃতি।
যারা বারোমাস ক্রিকেট চর্চা করেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গলিঘুঁজি ঢুঁরে বেড়ান তাদের কাছে আর পাঁচটা ম্যাচের মতোই ভারত-পাক খেলা। কিন্তু মোটেই বিষয়টা অত সরল নয় খেলাটা ভারত পাক হলে। সে ক্রিকেট বা হকি যাই হোক না কেন। পাকিস্তান উচ্চারনেই অনেকেরই আড্রিনালিনের ক্ষরণ মাত্রা চড়ে যায়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় , যিনি কস্মিন কালেও ক্রিকেট তো দুরস্ত খেলাধুলোর ধারপাশ মাড়ান না,তিনিও ভারত -পাক ম্যাচ শুনলেই তেড়েফুঁড়ে একসা।
খেলাকে যুদ্ধ আর যুদ্ধকে খেলা বানিয়ে তোলা একটা মৌলবাদী ছক। এতে ভারত পাক দুই দেশের মৌলবাদের ইন্ধন রয়েছে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে চলেছি। ভাবা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে জিততে না পারলে দেশের দরজা বন্ধ-এমন ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি অধিনায়ক বাবর আজমকে। তাও আবার সে দেশের প্রেসিডেন্ট যখন ইমরান খান।
আবার পাকিস্তানের কাছে হারার দায় একমাত্র মহম্মদ শামির ঘাড়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে গাল দিচ্ছে দেখছি এক শ্রেণীর নেটিজেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাওড়ার যুবক শামিকে ‘পাকিস্তানের দালাল’,’গুপ্তচর’ কিছুই বলতে বাকি রাখা হয়নি। সবচেয়ে বিস্ময়, ভারতীয় দলে শামির সতীর্থরা কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেন শামী কে নিশানা ? কারন সহজবোধ্য,ওঁর নাম তথা ধর্মীয় পরিচয়। পাকিস্তানে বাবরকে হুমকি আর ভারতে শামী কে আক্রমন দুটোই এক সুতোয় বাধা। এর মধ্যে ক্রিকেট নেই। আছে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী বিদ্বেষ প্রকল্প। আরও খোলসা করে বলা যায়, খেলার মোড়কে বা দেশপ্রেমের অছিলায় এখানে জড়িয়ে রয়েছে মৌলবাদ নির্ভর রাজনীতি।
আরও পড়ুন : লর্ডসের ফিক্সিং নিয়ে আমিরকে খোঁচা ভাজ্জির, দুই ক্রিকেটারের টুইটারাত্তিতে উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া
ব্রিটিশ ইন্ধনে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত ভারতভূমি। ঔপনিবেশিকতার মুক্তি ঘটলেও ধর্মীয় বিভাজন সমাজ গভীরে চাড়িয়ে গিয়েছে। ভারতে সার্বজনীন ভোটাধিকারের সৌজন্যে গণতন্ত্র অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সদর্থক ভূমিকা নিয়ে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে আইনি বৈধতা দিয়েছে সংবিধান। প্রতিবেশী পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র। পাকিস্তানের সে বালাই নেই।
পাকিস্তানের অবস্থান গুনগতভাবে ভিন্ন। সেখানে গণতন্ত্রের চাইতে সমাজে মোল্লাতন্ত্র আর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী নির্ভরতা পাক জনগণের ভবিতব্য নির্ধারক। ফলে মৌলবাদের চাষ যোগ্য জমিও উর্বর। অনেক ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রীয় মদতেই পোক্ত হয়ে চলেছে।
পাকিস্তানের এই কট্টর মৌলবাদী আচরণ সীমানার এপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের পক্ষে প্রতিবেশীর উপর বৈরী মনোভাব জাগাতে সহায়ক হয়েছে, যুগ যুগ ধরে। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকায় আম পাক জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। একাধিক রাজনৈতিক দল সেদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও মিলিটারি ও মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে তালমিল করেই তাদের চলতে হয়। ফলে পাকিস্তানে সরকার গঠন পা পতনে সেদেশের আম জনতার ভূমিকা নগণ্য। দারিদ্র , কর্মহীনতা,রুটি-রুজি নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলনের চাইতে কাঠমোল্লা নিয়ন্ত্রিত জনসমাজে নিরন্তর ধর্মের ধজা ওড়ানোই দস্তুর। সেকাজে পরমত বা ধর্মকে শত্রু ভাবতে হবে। তবেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উৎপাদিত হবে সমাজে। সর্বস্তরে বিধর্মীকে ঘৃণা, তার প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখাটা জরুরি। জরুরি রাষ্ট্রীয় মদত। এই সর্বগ্রাসী বিদ্বেষ যত তীব্র হবে ততই মৌলবাদের জমি উর্বর হবে। রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতে দেশপ্রেমের নামে বিধর্মী প্রধান প্রতিবেশী দেশের নাগরিককে শত্রু ভাবলেই জিহাদের রাস্তা মসৃণ হয়। নিশ্চিত হয় বেহস্ত যাত্রা, মৌলবাদের শিক্ষা এমনই।
ভৌগোলিক বিচারে এক দেশ। কলমের খোঁচায় দুটি পৃথক রাষ্ট্র। কূটনৈতিক স্তরে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাই হোক না কেন দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যদি সাংষ্কৃতিক আদান প্রদান বাড়ানো যায়,তাহলে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি কমবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে দুই তরফের নাগরিক উদ্যোগ দরকার। এই উপলব্ধি থেকে নয়ের দশকে দুই দেশের কিছু উদার মনস্ক বিশিষ্টজন একটা চেস্টা শুরু করেছিলেন। তা অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। কিন্তুএই উপমহাদেশে ভারত-পাক সম্পর্ক ঘিরে যে বিষময় বাতাবরণ, তার বিনির্মানে ওই ধরনের নাগরিক উদ্যোগ জরুরি। ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ ঘিরে পথে ঘাটে কিংবা ডিজিটাল দুনিয়ায় যেসব আলোচনা নজরে পড়ল, তাতে শিহরিত হতে হয়। দেশভক্তির ছলে চলছে মুসলমান বিদ্বেষের উদ্গীরন।
কেননা সীমানার ওপারে মৌলবাদ, যেমন অপর পারের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করে,এপারেও তার পাল্টা বিদ্বেষ জমতে থাকে ততোধিক ক্ষিপ্রতায়। সেটা অবশ্য বরাবরই ছিল। ইংরেজ শাসকের সৌজন্যে। (বর্তমানে ভারতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ রাষ্ট্রের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট) তাই ভারত-পাক খেলা থাকলে শহরের সংখ্যালঘু এলাকার দিকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাতে শিখি আমরা। বলা ভালো শৈশব কাল থেকেই এই শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের। সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এই মুসলিম বিদ্বেষভাবকে পুঁজি করে ভারতে ধর্মীয় বিভাজনের ক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছিল।
বছর সাতেক আগে বিজেপি ক্ষমতায় আসীন হয়। দিল্লিতে ঘোষিত হিন্দুত্ববাদীরা আসা ইস্তক রাজনীতির বয়ানটাই বদলে যেতে চলেছে। দেশের ভবিষ্যৎ কোন দল বা মোর্চার হাতে থাকবে তা গৌণ। কিন্তু ধর্মীয় বিভাজন নির্ভর রাজনীতির পাঠ অবিজেপি দলগুলি আর উপেক্ষা করতে পারছে না। বামেরাও এই প্রশ্নে আপোষের পথ নিয়েছে। গণতন্ত্রের এই অবক্ষয় সমাজের সর্বত্র। বিজেপি থাক বা অন্য কেউ, ভারতীয় রাজনীতির পরিমন্ডলে, সমাজের অন্দরমহলে ধর্মের অনুপ্রবেশ আর আশঙ্কা নয়, বাস্তব। শুনছি বিজেপি সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ ‘ শব্দটাকে তুলে দিতে উদগ্রীব।
আরও পড়ুন : উইলিয়ামসনদের হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ বাবরদের, রবিবার কিউইদের বিরুদ্ধে ডু অর ডাই ম্যাচ ভারতের
পাকিস্তানের মতো এপারেও মৌলবাদের হাতের মোয়া দেশপ্রেম। ওপারে ইসলামী এপারে হিন্দু দেশাত্ববোধ। তাই ‘ অন্ধ সে জন মরে আর মারে’। ক্রিকেট মাঠের বাইশ গজের লড়াই আমাদের কাছে যেন ধর্মীয় মর্যাদায় লড়াই। আড়াইশো বছর শাসন-শোষন করা ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা থাকলে আমাদের এই দেশভক্তদের সেই উন্মাদনা দেখা যায় না। অথচ পাকিস্তানের নাম শুনলেই শরীরের রক্ত যেন টগবগিয়ে ওঠে। খেলার খবর রাখার দরকার হয়না। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান ,ব্যাস ওতেই যথেষ্ট। ক্রিকেট না কবাডি জানার কী প্রয়োজন! খেলাটা তো মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের।
আসলে ওই আবেগ দেশপ্রেমের নয়, ইসলামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের বিদ্বেষ। এখন ভারতে দেশভক্তির একমাত্রিক বৈশিষ্ট্য , তোমার হিন্দুত্বে আনুগত্য কতটা নিখাদ তার প্রমাণ দেওয়া।
কতটা প্রশ্নাতীত সেই সমর্পণ! তাই বালাকোট বা পুলওয়ামা নিয়ে সংশয় বা শামির পাক ম্যাচে বোলিং ব্যর্থতা-সবই দেশ শাসকের জন্য বিরোধিতার নিদর্শন। পাকিস্তানেও তাই, হিন্দুপ্রধান ভারতকে হারাতে না পারলে ইসলামের মর্যাদাহানি! অতএব ভারতের কাছে হারলে বাবরকে দেশে না ফেরার ফতোয়া।