প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আফগানিস্তান। সুন্দর দেশটি একসময় পর্যটকদের কাছে শুধু আকর্ষণীয় ছিল না, সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় শুটিং স্পট ছিল এই দেশ। বলিউডের বেশ কিছু পরিচালক আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বিভিন্ন সময় বলিউড ছবির শুটিংয়ের ঝুঁকি নিয়েছিলেন সে দেশে। সম্প্রতি আফগানিস্তানে আবার তালিবানদের দখল গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। চিন্তায় ফেলেছে সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে। কপালে চিন্তার ভাঁজ খেলেছে ভারতের রাজনৈতিক মহলে। সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র নির্মাতারা, যাঁরা সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে ক্যামেরাবন্দি করে রূপোলি পর্দায় তুলে ধরতেন, তাঁরাও এখন দুশ্চিন্তায়।
আরও পড়ুন: আফগান বংশোদ্ভূত হলিউড অভিনেত্রীর বাইডেনকে প্রশ্ন
৪৬ বছর আগে আফগানিস্তানের প্রথম বলিউড ছবির শুটিং হয়েছিল। ছবির নাম ‘ধর্মাত্মা’। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। ছবিটির প্রধান অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন ফিরোজ খান।এক ছবির শুটের জন্য সেখানে ছিলেন ড্রিম গার্ল।একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল কাবুল বিমানবন্দরে স্থানীয়দের সঙ্গে করমর্দন করছেন হেমা ও ‘ধর্মাত্মা’ টিমের অন্যান্যরা। হেমা পরেছিলেন সিফন শাড়ি, চোখে রোদ চশমায় তিনি যেন স্টাইল আইকন। অন্যদিকে ফিরোজ খান পরেছিলেন সেমি-ফরম্যাল স্যুট। ওঁদের দেখতে কাবুল বিমানবন্দরে ভিড় হয়েছিল প্রচুর,তা জানান দিচ্ছে ওই ভিডিয়োই। ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে ড্যানি ডেনজংপাকেও।
ছবিতে আফগানিস্তানের অত্যন্ত দর্শনীয় কিছু স্থান দেখানো হয়েছিল। ছবির একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গান ‘কেয়া খুব লাগতি হো’ র শুটিং হয়েছিল আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তির সামনে।পরবর্তীকালে তালিবানরা মার্কিন সেনা বাহিনীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ঐতিহ্যশালী বুদ্ধমূর্তিটি ভেঙে ফেলে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিককালে সইফ আলি খান ও করিনা কাপুর অভিনীত ছবি এজেন্ট বিনোদ এর একদম শুরুর দৃশ্য তোলা হয়েছিল আফগানিস্তানের মাটিতে। শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১২ সালে। আফগানিস্তানের দস্ত- ই-মারগো জায়গাটির বালুকাভূমি বেছে নেওয়া হয়েছিল শুটিংয়ের জন্য। যা সেই সময় দর্শকদের ভীষণ ভাবে নজর কেড়েছিল।
২০০২ সালে যখন আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত অগ্নিগর্ভ ছিল সেই সময় বেশ ঝুঁকি নিয়েই ফারদিন খান ও সেলিনা জেটলি অভিনীত একটি রোমান্টিক থ্রিলার ‘জানাশিন’ ছবির শুটিং হয়েছিল আফগানিস্তানের মাটিতে। যেটি পরিচালনা করেছিলেন ফারদিনের বাবা ফিরোজ খান। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ফিরোজ খান ব্যক্তিগত উদ্যোগে সে দেশে এই ছবিটির শুটিং করেছিলেন। কারণ সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরোজ খানকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এরপর সঞ্জয় দত্ত-নার্গিস ফাকরিদের নিয়ে বলিউড ছবি ‘তোরবাজ’-এর শুটিং হয়েছিল আফগানিস্তানে। কারণ এই ছবির গল্প ছিল আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে। আফগানিস্তানে শিশু আত্মঘাতী বোমারুদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এ ছবির চিত্রনাট্য। কাজেই খুব স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের মাটিতেই ছবির বেশ কিছুটা অংশ শুটিং করা হয়েছিল। ছবির বাকি অংশের শুটিং হয়েছিল কিরঘিজস্তানে। ১৯৯২ সালের অমিতাভ বচ্চন-শ্রীদেবী অভিনীত জনপ্রিয় ছবি ‘খুদা গাওয়া’ শুটিং হয়েছিল কাবুল ও মাজার-এ-শরিফে। ১৯৯১ সালে আফগানিস্তানে এ ছবির শুটিং চলাকালীন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। রাজনীতি সচেতন মানুষের মনে আছে যে ১৯৯৬ সালে তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করে নাজিবুল্লাহকে নির্মমভাবে পিটিয়ে কাবুলের একটি স্তম্ভে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল মনীষা কৈরালা অভিনীত ‘এসকেপ ফ্রম তালিবান’ ছবিটি। কলকাতার লেখিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের জীবন নিয়ে লেখা ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’বইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দি ছবিটি তৈরি করেছিলেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। ছবির গল্পে উঠে এসেছিল একজন বাঙালি মেয়ের আফগানিস্তান পাড়ি দেবার কাহিনী। কীভাবে তিনি এক কাবলি ওয়ালার সংসারে ঘরনী হয়েছিলেন। সহ্য করতে হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার। প্রতিবাদে মিলেছিল চরম অত্যাচার। তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে একা লড়াই করতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছিল সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে। তালিবানদের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছিল তার।
আরও পড়ুন: আফগানিস্তান নিয়ে চিন্তিত বলিউড
২০০৬ সালে তৈরি হয়েছিল জনপ্রিয় এবং ঘটনাবহুল ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ ছবিটি। জন আব্রাহাম এবং আরশাদ ওয়ার্সি অভিনীত এই ছবির উল্লেখযোগ্য অংশ কাবুলে শুট করা হয়েছিল। ছবিতে আফগান অভিনেতা হানিফ হুম ঘুম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নিজের অভিনয় কেরিয়ার গড়ার জন্য তালিবানরা তাঁকে অপহরণ করে নির্মমভাবে পিটিয়ে ছিলেন।এ ছাড়া ছবিতে একজন মার্কিন অভিনেত্রী লিন্ডা আর্সেনিও অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন কবির খান। পরিচালক সে দেশে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানিয়ে ছিলেন যে, ছবির সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কলাকুশলীরা তালিবানদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। সে সময় ছবির কলাকুশলীরা অবশ্য এ বিষয়ে খুব বেশি মুখ খোলেননি। ছবিটি যখন মুক্তি পেয়েছিল সে সময় আফগানিস্তান থেকে তালিবানদের সন্ত্রাস প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। ছবিটি নির্মাণের জন্য আফগান সরকার কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।
সে সময় আফগানিস্থানে তালিবানি শাসন শেষ হবার পর সে দেশের মাটিতে প্রথম কোন বিদেশি ছবির শুটিং হয়েছিল ‘কাবুল এক্সপ্রেস’। যা দেখে আফগানিস্তানের মাটিতে বেশ কিছু বিদেশি ছবির শুটিং শুরু হয়েছিল তখন। প্রসঙ্গত, সেসময় আফগানিস্তানে সদ্য শেষ হয়েছিল তালিবানি শাসন। তা সত্ত্বেও তালিবানদের কাছ থেকে মৃত্যু হুমকি থেকে শুরু করে সশস্ত্র কমান্ডোরা গোটা ইউনিটকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত কাবুলে বলিউড ছবি ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ নির্মাণ ছিল একটা সমান্তরাল থ্রিলার গল্পের মতো। প্রকৃতপক্ষে পরিচালক কবির খান স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তাঁর ডেবিউ ছবি ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ তৈরির অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে একটি সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করতে চান।