রাজনীতি এক অপূর্ব জাদু, এক শিল্পকলা। এর বহিরাঙ্গ একরকম, অন্তরে তখন কী চলছে দেবা না জানন্তি কুতো মনুষ্য। ধরুন নীতীশ কুমার, ক’দিন আগেও ভেবেছিলেন এরকম ভোল পাল্টাবেন? আমি আপনি তো ছেড়েই দিন, ধুরন্ধর বলে চিহ্নিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও কি বুঝেছিলেন নীতীশ শিবির বদলাতে চলেছেন? না বোঝেননি। বোঝেননি বলেই ওঁকে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ভাষণ দিতে ডেকেছিলেন। চরণ সিংহকে ভারত রত্ন দেওয়া হল, আমরা যখন সবে ভাবছি, এ আবার কী? যে মানুষটা নির্দেশ দিয়ে জনসঙঘের সভা বন্ধ করিয়েছিলেন, যিনি জনতা দলে আরএসএস-এর সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরে জনসঙ্ঘের পুরনো নেতাদের জনতা দল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। তাঁকে এক আরএসএস প্রচারক প্রধানমন্ত্রী ভারত রত্ন দিচ্ছেন কেন? বোঝা গেল যখন রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরি টুইট করলেন মেরা দিল জিত লিয়া, আমরা বুঝলাম ইন্ডিয়া জোটের আর একটা উইকেট পড়েছে। মোদ্দা কথা হল রাজনীতির ঘটনায়, যে দলের সিদ্ধান্ত হোক বা প্রশাসনিক যা চোখে দেখছেন সেটাকে কেবল উপর থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না, গভীরে যাও, গভীরে যাও। তাহলে সে সব মণিমুক্তোর খোঁজ পাওয়া যাবে। বোঝা যাবে চরণ সিংকে ভারত রত্ন দিয়ে আসলে জাঠ বেল্টে বিজেপির ঘুঁটি সাজানো হল। বোঝা যাবে হঠাৎ তিরুপতির মূর্তি নিয়ে ওয়াইএসআর রেড্ডির পুত্র জগন রেড্ডি, যিনি আদতে খ্রিস্টান, সোজা দিল্লি গেলেন কেন? গিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে সেই মূর্তি তুলে দিলেন কেন এবং সেই ছবি অন্য কেউ দেখার আগেই স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি তা টুইট করে দিলেন কেন? এসব বুঝতে হবে, না হলে জানতি পারবেন না, যে তলায় কোন খেলা চলছে। বুঝতে হবে ভগবন্ত সিং মান আর কেজরিওয়াল বউ-বাচ্চা নিয়ে কেন এই সময়ে অযোধ্যা চলে গেলেন, কোন ইকুয়েশনে ধার দিতে। রাজনীতি আদতে এইরকমই, উপর থেকে সবুজ ভিতরে লাল বা উপরে সবুজ ভিতরে কমলা, উপরে লাল ভিতরে গেরুয়া। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, সন্দেশখালি কোন ইশারা করছে?
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলের যে মাঝারি নেতারা আছেন, যাঁরা সেই অঞ্চলের শেষ কথা, যাঁদের হাতে আছে ঠিকেদারি থেকে জব কার্ড, বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে এদের ছাড়া হাতে আসবে না, এদেরকে সমঝে চলে প্রত্যেকে। ভয় এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে, এই দুটো এলিমেন্ট নিয়ে বিপুল ক্ষমতাশালী কিছু মনসবদার প্রতিটা ব্লকেই আছে। এদের সিংহভাগ এককালে ছিল সিপিএম বা সিপিএম-এর মাস্তান, দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এঁরা জার্সি বদলে এখন মা মাটি মানুষ।
আরও পড়ুন: Aajke | মাসের খরচ সামলেও একটু পয়সা বাঁচে? তাহলে একটা কাজ করুন না, ভালো থাকবেন
প্রতিটা গন্ডগোলে এঁদের নাম পাওয়া যায় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে। যেমন ধরুন এই সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান, শিবু, উত্তমের নাম আগে শুনেছেন? শোনেননি। গন্ডগোলের পরে জানা যাচ্ছে, এঁরাই হলেন গন্ডগোলের মাথা, এঁরাই নাকি ওই এলাকার ত্রাস ইত্যাদি। সিপিএম-এর আমলে এঁদের উপরে দলের একটা রাশ ছিল, বেগড়বাই করলেই এলসিতে ডেকে এনে প্রথমে ধমকধামক, তারপর পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই আমলে তাঁরাই লোকাল কমিটি, তাঁরাই জোনাল কমিটি। ওঁদের হাতেই ভোটের ব্যবস্থা। তো সে হেন সন্দেশখালির শাহজাহান ভেসে উঠলেন ইডির সৌজন্যে। এবং তারপরে মানুষের ক্ষোভ শিবু উত্তমের বিরুদ্ধে, উত্তমকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, শিবু শাহজাহান পলাতক। শাহজাহান পালিয়েছে দল আর পুলিশ কেউ কিচ্ছু জানে না এটা বড্ড কাঁচা কথা, বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু এরসঙ্গে এলাকাতে বিক্ষোভের সম্পর্ক কী? এলাকার খাঞ্জা খাঁরা বিপদে পড়েছে, সেই সুযোগে ক্ষমতা দখল? এমনিতেই এসব অঞ্চলের হিন্দু পপুলেশনের সিংহভাগ বিজেপির দিকে ঢলে পড়েছে, বিধানসভা, পঞ্চায়েতের ভোটের রেজাল্ট তো তাই বলছে। এবার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট জমা হলেই কেল্লা ফতে। এবং এরকম এক সময়ে সিপিএম নেতাদের আটকে দেওয়া হচ্ছে, ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকী স্থানীয় প্রাক্তন এমএলএ সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দারকে গ্রেফতারও করা হল। নিরাপদ সর্দার ২০১১তে পরিবর্তনের জোয়ারেও আসন বাঁচাতে পেরেছিলেন। তারপর ২০১৬তে যখন হারলেন তখনও ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ২০২১-এর নির্বাচনে এই আসনে সিপিএম প্রার্থীই দেয়নি, আইএসএফ ভোট পেয়েছিল ৭ শতাংশের কম ভোট। বিজেপির ভোট ১২.৭০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছিল। এবার নির্বাচনের আগেই নিরাপদ সর্দার গ্রেফতার, ধরে নেওয়া যায় ক’দিনের মধ্যেই তিনি ছাড়া পাবেন। কমরেড নিরাপদ সর্দার লাল সেলাম স্লোগান নিয়ে তিনি সন্দেশখালিতে ফিরবেন। ২১-এ বিধানসভাতে পাওয়া তৃণমূলের ৫২ভ শতাংশ ভোট কমবে, কিন্তু তৃণমূল বিরোধী ভোট ভাগ হবে। নিরাপদ সর্দারের নেতৃত্বে ওই অঞ্চলে সিপিএম ১৫-১৮ শতাংশ ভোট পেলেও তৃণমূল লোকসভাতে ড্যাং ড্যাং করে জিতবে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সিপিএম-এর উত্থান নিয়ে কি সত্যিই চিন্তিত তৃণমূল নেত্রী? না। ভোটের হিসেব বলছে সিপিএম-এর খানিক উত্থান তাঁদের আসন দেবে না কিন্তু তৃণমূল বিরোধী ভোটকে ভাগ করে দেবে, ফলে সেই ভাগাভাগির সুবিধে পাবে তৃণমূল। অতএব জেলাতে জেলাতে সিপিএম-এর উত্থান, তাঁদের বিক্ষোভকে তৃণমূলের সরকার কড়া হাতে দমন করবে, সে সব খবর মিডিয়াতে ছাপা হবে, দেখানো হবে। রামে চলে যাওয়া কিছু ভোট বামে ফিরবে, অ্যাডভানটেজ তৃণমূল। কে বোঝেন না? শুভেন্দু বোঝেন না? বিজেপি বোঝে না? আলবত বোঝে, বোঝে বলেই তারাও তাদের গলা চড়াচ্ছে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সিপিএম নেতা-কর্মীদের গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা মুখোমুখি সংঘর্ষেও জড়াচ্ছেন পুলিশের সঙ্গে, তৃণমূলের সঙ্গেও। বামেদের এই উত্থান যদি তাদের ভোট পার্সেন্টেজ বাড়ায়, তাহলে আসলে সুবিধে কার? বামেদের যে ভোট চলে গিয়েছিল রামের কাছে, তার এক অংশ যদি ফেরত আসে, তাহলে সুবিধে কার?
রাজনীতিতে ভারি মজার মজার হিসেব আছে। এক তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি তৈরি হল, বামেরা শূন্য হয়ে গেল। হয় বিজেপি নয় তৃণমূল এই ইকুয়েশনের মধ্যে বামেরা উবে গেল। আবার সেই বাইনারি ভেঙে এক ক্লাসিক্যাল ট্রাই অ্যাঙ্গুলার ফাইট-এ তৃণমূলের ভোট কমলেও আসন কমবে না তো বটেই বরং বাড়িয়েও দিতে পারে। অবশ্যই এ কোনও অজর অমর অক্ষয় নিয়ম নয়, তবে ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের এই ফ্যালাসিগুলো বহু-পরীক্ষিত সত্য। সে সত্যকে আবার বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের ফলাফল আসা পর্যন্ত।