কত দরদ উনিজির মনে, আহা রে। বাংলার এক প্রান্তে ভয়ঙ্কর ঝড়ে, দুর্যোগে ঘর ভেঙেছে, মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন, মানুষ আহত, তাঁদের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী রাতেই ছুটেছেন সেখানে, ত্রাণ পৌঁছনো হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তখন অন্য শহরে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, ওনার ব্যস্ততা মানে বিরোধীরা যে প্রত্যেকে দুর্নীতিবাজ আর দেশদ্রোহী সেটাই বারবার বলতে থাকা। হাতে প্রমাণ নেই, পাগলা মেহের আলির মতো চেঁচিয়েই যাচ্ছেন, সাব্বাই চোর, সব্বাই দেশদ্রোহী বলে। রাঁচির কাঁকেতে পাগলা গারদ আছে, গিয়ে শুনেছিলাম অধিকাংশ পাগলের ধারণা বাকিরা পাগল আর বদমাস, খানিকটা সেরকম সিনড্রোম আছে আমাদের উনিজির মধ্যে। তো সেই তিনি ছুটে ছুটে আসছেন। কেন? খবর নিয়েছেন? ক্ষয়ক্ষতির কোনও অ্যাসেসমেন্ট করিয়েছেন? না। আচ্ছা সাময়িক কোনও ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েছেন? না। উনি আসছেন। আসছেন নৌটঙ্কি করতে, এখানে সেখানে যাবেন তারপর জনসভাতে দাঁড়িয়ে বলবেন কত দেব বলুন? ৫০০ কোটি? ২০০০ কোটি? ৫০০০ কোটি? ঠিক আছে ৮০০০ কোটি টাকা দিলাম। প্রয়াগের মেলার রাজা হর্ষবর্ধন, চাইলে কাপড়চোপড়ও দিয়ে দেবেন কারণ সামনে নির্বাচন। এখনও আয়লার টাকা আসেনি, আম্ফানের টাকা আসেনি, গৃহ যোজনার টাকা আসেনি, ১০০ দিনের টাকা বাকি, উনি ছুটে আসছেন। আহা রে কী দয়ার শরীল! দেশের একটা দুর্যোগের সময়ে উনি গেছেন? একটা দুর্যোগ, যখন সামনে নির্বাচন ছিল না উনি চলে গেছেন, এরকম কোনও উদাহরণ দিতে পারবেন? আর দুর্যোগকে উনি কী মনে করেন? দুর্ঘটনাকে উনি কী মনে করেন? মনে তো আছে আমাদের এই বাংলাতেই এসে এক ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার ঘটনাকে নির্বাচনী ইস্যু করার চেষ্টা করেছিলেন। আজ মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আবার মেকি সহানুভূতি দেখাতে আসছেন তখন অন্য সব প্রশ্ন দূরে সরিয়ে রেখে অন্তত একটা প্রশ্ন তো করাই যায়। মণিপুরে নির্বাচনের প্রচারে কবে যাবেন? মণিপুরে পা রাখার সাহস কবে দেখাবেন? সেটাই বিষয় আজকে, মণিপুর? না। জলপাইগুড়ি? হ্যাঁ। উনিজি আসছেন।
সারা গুজরাত জ্বলছে, অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন, নরেন্দ্র মোদি মানে আমাদের উনিজি তখন মুখ্যমন্ত্রী। সংখ্যালঘু মানুষজনদের লাশ তোলার মানুষ নেই, ওনাকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ, তখনও সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার ছিল, তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনার প্রতিক্রিয়া কী? উনিজি বলেছিলেন, সে তো গাড়ির চাকার তলায় কুকুর মারা পড়লেও আমাদের দুঃখ লাগে। কতটা ক্রূর, অসংবেদশীল মানুষ একবার ভাবুন।
আরও পড়ুন: Aajke | সিপিএম কি আবার ভাঙছে?
সেই উনিজির আজ উথলে উঠেছে দরদ, ছুটে ছুটে বাংলায় আসছেন দুর্যোগ পীড়িত মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আসলে ভোটের রাজনীতি করতে। সেটাই যদি না করার হত, তাহলে অনায়াসেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করতেই পারতেন, ত্রাণ পাঠাতেই পারতেন, উনি বাংলায় আসছে ওই জায়গাগুলোতে প্রথম দফার নির্বাচন আছে তাই, অন্য কোনও কারণে নয়। সারা দেশের মানুষ তো জানে মণিপুরে কী হয়েছে, কী হচ্ছে। এখনও সে আগুন নেভেনি, মহিলাকে ধর্ষণ করে, নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছিল, এক জায়গাতে নয়, বেশ কিছু জায়গায়। অন্য দলের নেতাদের, অন্য ধর্ম বা উপজাতি মানুষদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, ওনার দলের কুকি নেতাকে মেরে আধমরা করে বিছানায় ফেলে রেখেছে, উনি গেছেন? যাননি। কিছু বলেছেন? বলেননি। রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেছেন? করেননি। রাজধর্ম পালন করতে বলেছেন? বলেননি। মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন? দেননি। আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও মণিপুরে যাওয়ার সাহস দেখাননি আমাদের ছপ্পন ইঞ্চ সিনাওলা উনিজি, অপেক্ষা করছেন নির্বাচনের ফলাফলের জন্য। আর এ রাজ্যে মহিলার উপরে অত্যাচার হয়েছে, ওনার বুক ফেটে যাচ্ছে, উনি সাংবাদিক সামনে রেখে ফোন করছেন, আহা উহু করার জন্য ছুটে আসছেন। এসে টেলিপ্রম্পটারের সামনে লিখে দেওয়া বক্তৃতা গলা কাঁপিয়ে পড়বেন, তাতে চোলায় চোলায় বাজবি জোয়ের ভেড়ীর মতো বদ উচ্চারণে রবি ঠাকুরের কোটেশনও থাকতেই পারে, কিন্তু যা করবেন নির্বাচনের জন্য করবেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় জাগতিক যা কিছু উনি করেন, যা যা কিছু সবটাই সম্ভবত নির্বাচনকে সামনে রেখেই করেন। চোখ জল ছলছল যখন দেখেন, মাথায় রাখবেন উনি নেতা কম অভিনেতা বেশি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে প্রধানমন্ত্রী আম্ফানের পরে একবারের জন্য বাংলাতে আসার সুযোগ পেলেন না, এখনও আয়লা, আম্ফানের টাকা বাকি রেখেছেন, সেই প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের আগে উত্তরবঙ্গে দুর্যোগ পীড়িত অঞ্চলে আসার এই দারুণ উৎসাহের পেছনে কি নির্বাচনী অঙ্ক আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সব মনে থাকবে এ বাংলার মানুষদের। হ্যাঁ, রেড ভলান্টিয়াররা সেদিন রাতেই পৌঁছেছিলেন মানুষের কাছে, ছুটে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই দুর্যোগকে নির্বাচনী সুযোগে বদলে নিতে চান, মনে থাকবে। যে মানুষ কৃষক মারা গেলে চুপ করে থাকে, যে মানুষ মহিলাদের উপরে অত্যাচার হলে চুপ করে দেখে, সেই মানুষের সংবেদনশীলতা কতটা তা আমরা জানি। জানি বলেই উনিজির এই নৌটঙ্কি আমাদের মনে কোনও দাগ কাটবে না। আর পাঁচটা নাটকের মতোই আমরা এটাকেও ওনার ভোট প্রচারের অঙ্গ বলেই ধরে নেব। বুঝব, মানুষের অসহায়তাও ওনার কাছে এক সুযোগ, তিনি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন।