শ্যামাসংগীত লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষ্যে হাজারো আলোচনা চলছে। লিটল ম্যাগাজিন থেকে বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনে সত্যজিৎ চর্চা হচ্ছে। কিন্তু তাঁর শ্যামাসংগীত রচনার বিষয়টি তুলনায় অনালোকিত।
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের রচনা অবলম্বনে ১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ মুক্তি পায়। ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন, ওস্তাদ আলী আকবর খান। ছবিতে কালি মন্দিরের দাওয়ায় বসা এক ভক্তের ‘লিপ’এ শ্যামা সংগীতের ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। উল্লেখ্য ,তখনও পর্যন্ত তিনি নিজের ছবিতে সংগীত পরিচালনায় হাত দেননি। সেই নিরিখে দেবী তাঁর শেষ ছবি যেখানে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছবির চিত্রনাট্যের তাগিদে শ্যামা সংগীতের দরকার। প্রচলিত রামপ্রসাদী গান দিয়েই কাজ সারতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো সত্যজিৎ রায়। তাই নিজেই লিখে ফেললেন একটি গান।
যে বলে মা তুই পাষানী/তারে আমি বেকুব মানি/আমি প্রাণে জানি পাষণের কী মহিমা/এবার তোরে চিনেছি মা/ও তোর নামে কালী, মুখে কালী অন্তরে তোর নেই কালিমা। গানে রামপ্রাসাদের প্রভাব থাকলেও ছবির বিষয়বস্তুকে খুব সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করতে সত্যজিতের সেই রচনা সিনেমায় বাড়তি মাত্রা এনে দিয়েছিল।
ছবির সামগ্রিক সংগীত পরিচালনা আলী আকবর করলেও ওই শ্যামা সংগীতের সুরারোপ করেছিলেন সত্যজিৎ স্বয়ং। গানটি গেয়েছিলেন, পৃথ্বীশ মুখোপাধ্যায়। তিনি কোনো পেশাদার গায়ক নন। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী ছিলেন পৃথ্বীশ। তাকে খুঁজে বার করে ওই গান রেকর্ড করানো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন – বাঙালির বটতলাবাজারে ‘সুকুমার’ আর ‘সন্দেশ’ এক অবিশ্বাস্য আলোর ফোয়ারা
বিবেকানন্দ গবেষক ,সাংবাদিক তরুণ গোস্বামী জানিয়েছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নিত্যস্বরূপানন্দ তাঁকে ওই গানের বিষয়টি গোচরে আনেন। ‘বারবার ওই গানটি শুনলে সত্যজিৎ কোন স্তরের ভক্ত ছিলেন,কী গভীর তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা তা টের পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, সত্যজিতের ওই একটিমাত্র শ্যামাসংগীতের গূঢ় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এমনই দাবি করেছিলেন নিত্য স্বরূপানন্দ।
জন্মসূত্রে সুকুমার পুত্র সত্যজিৎ ব্রাহ্ম। তাঁদের পরিবারেও ব্রাহ্ম ধর্মাচারের পরিবেশ ছিল। আশৈশব নিরীশ্বরবাদী আবহেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ব্রহ্মসঙ্গীত চর্চার নিয়মিত রেওয়াজও ছিল রায় বাড়িতে। তাঁর একাধিক লেখা এবং সাক্ষাৎকারে সে কথা বলেছেন সত্যজিৎ। তবে পরবর্তীতে তিনি পুরোপুরী ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন এমন নয়। নিজেই জানিয়েছেন, তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ী। পরিভাষায় ‘আগনস্টিক’। সিনেমায় ধর্মীয় লোকাচার নির্ভর সামাজিক সংস্কারের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠতাকে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
স্বভাবতই ওই শ্যামা সঙ্গীতের পদকর্তার যে আধ্যাত্মিক চেতনার কথা নিত্যস্বরূপানন্দ বলেছিলেন,তা সত্যজিতের অন্যান্য সৃষ্টিকর্মে অধরা থেকে গিয়েছে। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, পুরোদস্তুর ব্রাহ্ম দর্শন তাঁর ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল, তাহলে কোনো প্রকার হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগ বা পৌত্তলিকতায় তাঁর আস্থা না থাকাটাই প্রত্যাশিত। এ হেন সত্যজিৎ রায়ের লেখা শ্যামা সংগীতে কিন্তু ভক্তিভাবের কোনো অভাব ছিল না। পেশাদারি সৃজনশীলতা নাকি ভক্তিরস – কী সেই তাড়না যা সত্যজিৎকে দিয়ে এমন পদ নির্মাণে প্রাণিত করেছিল ? সে তর্ক তোলা থাক গবেষকদের জন্য।