কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: প্রমাণিত হোক আর না হোক, সত্য হোক বা মিথ্যা, বিচারের আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে সামাজিকভাবে ধ্বংস করার প্রবণতা ইদানিং মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে চর্চার শীর্ষে এখন মিডিয়া ট্রায়াল। এবং স্বীকার করে নেওয়া ভালো, এই মুহুর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয়ও বটে এই মিডিয়া ট্রায়াল। আইনি মহলের স্পষ্ট বক্তব্য, অন্য যে কোনও ট্রায়ালের চেয়ে ভয়ঙ্কর মিডিয়া ট্রায়াল৷
মূলধারার কিছু গণমাধ্যম এবং অবশ্যই সামাজিক মাধ্যম পরিকল্পিতভাবে এই খেলায় সামিল৷ এর কারণ, কোনও নির্দিষ্ট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা মিডিয়া ট্রায়ালের স্ক্রিপ্টের আওয়াজ যত জনের কানে ঢোকানো যায়, পরে প্রকৃত আইনি বিচারের পর সেই অভিযুক্ত নির্দোষ প্রমাণিত হলেও, সেই বার্তা ততজনের কাছে পৌঁছায় না। আরও বড় কথা হল, এ ধরণের মিডিয়া ট্রায়ালের প্রভাবে কিছু মানুষ বিশ্বাস করে ফেলেন, যা রটে তার কিছু না কিছু তো বটেই৷ রাজ্যের একাধিক বিশিষ্ট আইনজীবীর অভিমত, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু মিডিয়া পরিণত হয়েছে তদন্তকারী সংস্থা, তা সে রাজ্যের হোক বা কেন্দ্রের, মাইক বা হাতিয়ারে। তদন্তকারী সংস্থার তথ্য যাচাই ছাড়াই মিডিয়া তা ব্যবহার করে৷ অভিযুক্ত আরও কোনঠাসা হয়৷
প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আইনি লড়াই শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণের বালাই নেই, দায়ও নেই৷ প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় নিম্ন আদালতের রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকে সবসময়৷ কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে সে সুযোগ কোথায় ? মিডিয়া ট্রায়াল কারো গায়ে ‘অপরাধী’ লেবেল সেঁটে দিলে, তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই৷
প্রথমে যা বলা হয়, সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার একটা তাগিদ থাকে মিডিয়ার৷ যেন সেই তাগিদেই চালিত হয় মিডিয়া ট্রায়াল৷ এই ক্ষতি কখনই পূরণ হয় না। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা হামেশাই অভিযুক্তকে কঠোর শাস্তি দেয়৷ নির্দোষও বলে অনেক অভিযুক্তকে৷ সেই শাস্তি বা মুক্তি হয় আইনি পথ ধরেই৷ ওদিকে, মিডিয়া ট্রায়ালে নিশানা করা অভিযুক্তকে মারা হয় তিলে তিলে। মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হওয়া একজন নির্দোষ মানুষ আজীবন দোষের গ্লানি বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন, এমন নজির দেশে কম নেই৷
এত বড় অবতরণিকার কারণ অবশ্যই রয়েছে৷ এই মুহুর্তে গোটা রাজ্য উত্তাল একাধিক তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে৷ বেশ কিছু হেভিওয়েট গ্রেফতার হয়েছে, আরও একাধিক নাম নিয়ে জল্পনা চলছে৷ তদন্তকারী সংস্থা যথেষ্টই পরিশ্রম করছে৷ কিন্তু কখনই সংবাদমাধ্যমে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মুখ খুলছে না৷ মুখ খোলা সম্ভবও নয়৷ মুখ খুললে তদন্ত বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
প্রশ্ন উঠেছে এখানেই৷ তাহলে বিশেষ বিশেষ কিছু সংবাদমাধ্যম জানতে পারছে কীভাবে, তদন্তে উঠে আসা ‘বিস্ফোরক’ তথ্য ? কে বা কারা ব্রিফ করছে ?
অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই৷ গ্রেফতারির অন্যতম কারণ যে ‘ তদন্তে অসহযোগিতা’, তা বুঝতে পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু বাকি অভিযোগ ?
বিশেষ বিশেষ কিছু মিডিয়ার তথাকথিত ট্রায়ালে ফলাও করে বলা হয়েছে, অনুব্রতের ৬টি পেট্রোল পাম্প রয়েছে ‘বেনামে’৷ ‘বেনামে’ তাঁর ১০০টি ডাম্পার রয়েছে৷ ‘বেনামে’ অনুব্রত বীরভূমে একটি মেডিক্যাল কলেজের মালিক৷ ১৬টি রাইস মিল রয়েছে বীরভূম এবং বর্ধমান জেলায়৷ এসবও ‘বেনামে’৷ ওই দুই জেলায় অনুব্রত’র ১৩০টিরও বেশি ‘বেনামি’ বালি খাদান রয়েছে৷ এ সব ছাড়াও একাধিক জমি, বাংলো, হোটেল, গেষ্ট হাউস, স্টোন ক্র্যাশার ইত্যাদির মালিক অনুব্রত মণ্ডল এবং এই সবও ‘বেনামি’-ই৷
প্রশ্ন এখানেই৷ মিডিয়া ট্রায়ালে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রচারের ভিত্তি কী ? তদন্তকারী সংস্থা নিশ্চয়ই সাংবাদ মাধ্যমে এসব বলেনি৷ দেখা যাচ্ছে, সব অভিযোগের পিছনেই ‘বেনামি’ বলে একটা শব্দ রয়েছে৷ নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমান থাকলে ‘বেনামি’ শব্দের ব্যবহারই হত না ৷ তাহলে এ ধরণের মিডিয়া ট্রায়াল কার হাত শক্ত করছে ? কার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে ?
প্রতিবেদনে কখনই বলা হচ্ছে না অনুব্রত মণ্ডল নির্দোষ৷ এর কারণ, উনি যে নির্দোষ, সেই ধরণের কোনও তথ্য প্রমাণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে৷ কিন্তু স্রেফ দাগিয়ে দেওয়ার জন্যই যে এক শ্রেণির মিডিয়া কোনও পক্ষের ব্রিফ হাতে তুলে নিয়েছে, সেটাই বা কতখানি যুক্তিযুক্ত ?
প্রশ্ন থাকলেও উত্তর অমিল৷ উত্তর দেওয়ার ঝুঁকি কেউই নেবে না৷