২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯, রাত ৩টের সময় আযোধ্যার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। এবং বিদ্যুতের চেয়েও বেশি বেগে খবর পৌঁছে গেল, “রামলালা নিজেই অবতীর্ণ হলেন তাঁর জন্মভূমিটে।” বাবরি মসজিদকে ঘিরে সেখানকার হিন্দু সাধুদের যে দাবি ছিল তা হয়ে উঠল আরএসএস হিন্দু মহাসভার দাবি। সেই থেকে শুরু মন্দির ওহি বনায়েঙ্গের আন্দোলন। আসল ঘটনা জানার পর পরের দিনেই অযোধ্যা থানার ওসি রামদেও দুবে এফআইআর করলেন যে অভিরাম দাস, রামসকল দাস আর সুদর্শন দাস এবং আরও কয়েকজন মিলে মসজিদে ঢুকে রামালালার মূর্তি বসায়, মসজিদের গায়ে কিছু আঁকিবুকিও কেটে আসে। সেই সময়ে অযোধ্যায় শহর হাকিম গুরু দত্ত সিং, জেলা হাকিম কে কে নায়ার, এস পি কৃপাল সিং এবং বিচারক ঠাকুর বীর সিং এঁরা বৈঠক করেন, রামলালা ভিতরেই থেকে যায়, গ্রেফতার হয় না, দর্শন চলতে থাকে। এই চারজনের প্রত্যক্ষ সাহায্যেই রামলালার মূর্তি থেকে যায়। পরে আদালতের আদেশে দর্শন বন্ধ হয়। এই অযোধ্যার শহর হাকিম গুরু দত্ত সিং ছিলেন রামভক্ত, বাড়ির নাম দেন রাম ভবন। এনার নাতি বিজেপি নেতা শক্তি সিং যিনি গুমনামিকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, এবং এখনও প্রেস মিডিয়াকে ডেকে ২৩ জানুয়ারি গুমনামি সমাধি স্থলে ভাষণ দেন। এই মন্দিরের তালা খুলে দিলেন রাজীব গান্ধী, হিন্দু ভোটের জন্য, মাচানবাবার পা নিলেন মাথায়, শাহ বানো মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ মোল্লাদের সামলাতে আইন আনলেন। আরএসএস–বিজেপি প্রাণ ফিরে পেল, হ্যাঁ রাজীব গান্ধীর জন্যই। পরের ইতিহাস সবার জানা, হাজার মানুষের প্রাণ গেল, দাঙ্গা হল এবং শেষমেশ বিজেপির পূর্ণ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বাবরি মসজিদ ভাঙা অন্যায় হয়েছে বলার পরেও আদালত আদেশ দিল ওই জায়গাতেই রামমন্দির গড়ার এবং প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট অযোধ্যা গেলেন রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে। হিন্দু আবেগের শীর্ষে থাকা মোদিজি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত থেকে হিন্দু জাগরণের ইতিহাসে নিজের নাম আরও পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ছিলেন, বিজেপির কিছু নেতারা ছিলেন। মোদিজি মাঝেমধ্যেই লাদাখ যান, আর্মি পোশাক পরে রাফালে চড়েন, এবং অযোধ্যাতে যান। মন্দিরের ভূমি পূজনে গেছেন, এবার উদ্বোধনে। একবার হিন্দু জাগরণ একবার জঙ্গি জাতীয়তাবাদ।
সেই ভূমি পূজনের সময় থেকে আর্থিক পরিস্থিতির কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া যাক যে সাড়ে তিন কোটির বেশি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ ছেড়ে ফিরে গেছেন তাঁদের গ্রামে, তাঁদের উপার্জন নেই, রোজগারের কোনও ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ গম ছোলা বা চিনি রেশন থেকে পাচ্ছেন কিন্তু তা দিয়ে তো সংসার চালানো যায় না। দেশ জুড়ে বিভিন্ন পেশার কোটি কোটি মানুষের রোজগারের রাস্তা বন্ধ, বেকারত্ব চরমসীমা ছুঁয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিবেচ্য বিষয় রামজন্মভূমি শিলান্যাস, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং এখন তার উদ্বোধন।
দেশ জুড়ে বেরোজগারি ঠিক এই মুহূর্তে ২১ শতাংশ। মানে কাজ করতে সক্ষম ১০০ জনের মধ্যে ২১ জনের হাতে কাজ নেই, যাদের কাজ আছে তাদের মাইনে ছাঁটাই হয়েছে। পর্যটন শিল্প, রেস্তরাঁ, হোটেল, সিনেমা হল এখনও পুরোপুরি বন্ধ। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি মানুষ আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন, যারা মাইনে দিচ্ছিলেন এতদিন তারা আর পারছেন না, তালা লাগাচ্ছেন, রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কী হবে? বিকল্প পথ কোথায়? কে ভাববেন? দেশের রাষ্ট্রনায়ক আপাতত রামমন্দিরের উদ্বোধন নিয়ে খুব ব্যস্ত।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | যা যা শুনছেন তাই সত্যি? যা আপনি দেখছেন, তাই সত্যি?
দেশে বৈষম্য বাড়ছে, সবচেয়ে ধনী মানুষ আর সবচেয়ে গরিব মানুষের আয়ের ফারাক গত ১০ বছরে বেড়েছে ১৭৬ শতাংশ, দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত রামমন্দিরের উদ্বোধন নিয়ে।
দেশের যাবতীয় প্রকল্পের কাজ বন্ধ, টাকা নেই। রেল বেচে দেওয়া হচ্ছে, কয়লা খনি বেচে দেওয়া হচ্ছে, করোনাকে ঢাল বানিয়ে দেশ বেচার কাজ চলছে, প্রশ্ন করলে দেশদ্রোহী বলে জেলে পোরা হচ্ছে। এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুঠ হয়ে গেছে। সামান্য প্রতিবাদ করেছ কি জেলে পোরা হবে, উমর খালিদ থেকে সোমা সেন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পঙ্গু এক মানুষ, জি এন সাইবাবা জেলে, সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এগুলো কোনও বিষয় নয়, তিনি আপাতত রামমন্দিরের উদ্বোধন নিয়েই ব্যস্ত, লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্র।
আসলে গোটা দেশের মানুষের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চাকরি ইত্যাদি মৌলিক প্রশ্নগুলো সামলানোর দায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেই। উনি সেখান থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দুটো বিষয়ের মধ্যেই মানুষকে আটকে রাখতে চাইছেন। প্রথমত হিন্দুত্ববাদ, দ্বিতীয়ত জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। দুটোই ইতিহাসে পচে যাওয়া অধ্যায়ের করুণ পুনরাবৃত্তি। ধর্ম যে মানুষের মূল সমস্যা দূর করতে পারে না, কোনও ভগবান বা কোনও গুরুজি মাতাজি যত চিৎকার করেই বলুন না কেন যে রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও, যত বুক ঠুকেই বলুন না কেন মামেকং স্মরণং ব্রজ, কেবলমাত্র আমাকেই স্মরণ করিলেই চলিবে, তা যে কতটা ঠুনকো তা তো এই ক’দিন আগে করোনা কালেই বোঝা গেল। আমরা তাকিয়ে ছিলাম কোন দিকে? কী জন্য হা-হুতাশ করেছি? ভ্যাক্সিন কবে আসবে? কবে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করবেন ভ্যাক্সিন? কবে তা পৌঁছবে মানুষের কাছে তাই নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম। কোনও তিরুপতি, পুরী থেকে তো স্বস্তির বার্তা আসেনি, কেউ তো বলেনি যে ওই মন্দির থেকে ওই মসজিদ থেকে বা চার্চ থেকে ভ্যাক্সিন বেরিয়ে আসবে। ওষুধ এসেছে ওই ল্যাবরেটারি থেকে যেখানে কাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু বিজেপি আরএসএস তাকে রাজনীতি শুধু নয় রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জুড়ে নিতে চায়। আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ তো আমরা হিটলার থেকে মুসোলিনি দেখেছি, তার পরিণতিও দেখেছি। একটা গোটা দেশকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাও দেখেছি। আজ এই চরম দুঃসময়ে মানুষকে আবার ধর্মের আফিম খাইয়ে নিজেদের রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। সাধু সাবধান। আমরা কি ভুলেই গেলাম বা আমাদের কি ভুলেই যেতে হবে যে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মরেছে এই রামমন্দিরের দাবিতে রথযাত্রা আর তার পরের দাঙ্গায়? ভুলে যাব যে আদালতকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও কীভাবে ভাঙা হয়েছিল এক ঐতিহাসিক মনুমেন্ট? ভুলে যাব যে দেশের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে ওই দাঙ্গা?
এবার আরও একটা বিষয়ে আসা যাক। বাবারি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। এরপরে একটা মামলা হয়, সিবিআই মামলা করে, বিশেষ সিবিআই কোর্টে এই মামলাতে ৪৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়, তার মধ্যে মারা গেছেন ১৭ জন। সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে মুরলী মনোহর জোশির, সাক্ষ্য দিয়েছেন ৯২ বছরের লালকৃষ্ণ আদবানি। উমা ভারতী থেকে কল্যাণ সিং বা জোশি বা আদবানি কেউই কিন্তু একবারের জন্যও বলেননি যে বেশ করেছি বাবরি মসজিদ ভেঙেছি, আমরা রামমন্দির গড়ব বলেই বাবরি মসজিদ ভেঙেছি। বা এটাও বলেননি যে ওটা তো আসলে মন্দির ছিল তাই তার উপরে গড়ে ওঠা মসজিদ ভেঙেছি বেশ করেছি। না তাঁরা কেউই একজনও এই কথা বলেননি। কিন্তু আমরা জানি, সারা দেশ জানে যে সেদিন ৬ ডিসেম্বর অনেক পরিকল্পনা করেই এই মসজিদ ভেঙেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি আরএসএস-এর কর্মীরা। প্যান্ডোরার বাক্সটা খুলেছিলেন রাজীব গান্ধী, সেই হিন্দু ভোট নিয়ে খেলা করার ইচ্ছে। কিন্তু ঠিক সেই সময় থেকে আদবানি, বিজেপি আরএসএস বুঝে ফেলেছিল যে এই রামমন্দির আন্দোলন তাদের অভীষ্ট হিন্দুরাজের স্বপ্নকে স্বার্থক করে তুলবে। সে লড়াই চলতে থাকে। এর মধ্যে ভি পি সিংয়ের সময়ে আদবানির সেই বিখ্যাত রাম রথযাত্রা। যেখান যেখান দিয়ে গেছে সেই রথ সেখানে দাঙ্গা হয়েছে, হিন্দু ভোট জড়ো হয়েছে বিজেপির দিকে। সেদিন রথযাত্রায় শামিল ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আদবানি তাঁকেই তুলে ধরছিলেন যোগ্য শিষ্য হিসেবে। যোগ্য শিষ্য রথের দরজায় থাকতেন, আদবানিকে উঠতে নামতে সাহায্য করতেন।
সেদিন মোদি ছিলেন না সিদ্ধান্ত নেওয়ার শীর্ষে, অশোক সিঙ্ঘল, আদবানির সিদ্ধান্ত মেনেই দেশের পুরোহিতদের নেতারা ঠিক করেন একজন দলিত বা হিন্দুদের মধ্যে নিচু জাতির কাউকে দিয়ে শিলান্যাস হবে। ১৯৮৯-এ ওই শিলান্যাসের জন্য ডাকা হয়েছিল কামেশ্বর চৌপালকে, উনি বিহারের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা ছিলেন। কেন ডাকা হল? এর পিছনেও যথেষ্ট অঙ্ক কষা হয়েছিল। বিজেপি বেনিয়া আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ভোটব্যাঙ্কের দখল নিয়েছিল, কিন্তু ভারত জুড়ে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ছাড়া ভারত দখল সম্ভব নয় জেনেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন সব কিছুই হাতে, সরকার থেকে আদালত, পুলিশ সবটাই কব্জায় এসে গেছে। রামমন্দির আন্দোলনের প্রথম পুরোহিত আদবানি জোশিরা চলে গেছেন বিস্মৃতির প্রান্তরে। যেটুকু বা আছে তাও চূড়ান্ত অবহেলায়। সম্ভবত তারও শেষ পর্যায় দেখতে চলেছি আমরা। যিনি সেদিন লড়াইয়ের সামনে থেকে শিলান্যাস করেছিলেন, সেই কামেশ্বর চৌপাল এখনও বেঁচে, তিনি বিহার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। তিনি পাননি নেমন্তন্ন, আদবানি, জোশি, উমা ভারতীরা বিস্মৃতির তলায় পড়ে আছেন। বিজেপি আরএসএস বলছে এটা হল দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা প্রাপ্তি, সেই স্বাধীনতার উদযাপনে রাষ্ট্রপতি কিন্তু নেই সবটুকু আলো শুষে নিয়ে এক আমিই একা, নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের গল্প। একজনও বিরোধী নেতা যদি সেখানে যান তাহলে তিনি আসলে সেই রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণেই সাহায্য করতে যাবেন। এমনকী শিবসেনা সমেত বিরোধী জোটের নেতাদের বেশিরভাগ অংশই এই খেলাটা বুঝেছেন, তাঁরা যাচ্ছেন না, কিন্তু সেই কারণটা বোঝাতে হবে সাধারণ মানুষকেও। কেবল উপস্থিত না থেকে প্রতিবাদ শেষ হবে না, রামমন্দিরের পিছনে মর্যাদা পুরুষোত্তম রামকে নিয়ে মোদি–শাহ, আরএসএস–বিজেপির এই নোংরা রাজনীতির কথাও মানুষকে বোঝাতে হবে।