রাজ্যসভা সাংসদ, ডেরেক ও ব্রায়েন বলেছেন মোদি সরকার পাপড়ি চাটের মত সংসদে বিল পাস করাচ্ছে, এবং তাতে নরেন্দ্র মোদি রেগে আগুন, তেলে বেগুন। বলেছেন, এটা সংসদের মর্যাদাহানি, এটা অবমাননাকর! তাই নাকি? আদালতের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙে, বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার সময় মনে ছিল না? কাকভোরে সংসদ ডেকে কাশ্মীর ভেঙে তিন টুকরো করা হল, ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হল, সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের জেলে পোরা হল, তখন মনে পড়েনি, কনস্টিটিউশনাল প্রোপ্রাইটির কথা? আজ মনে পড়ছে? সমস্ত সংসদীয় রীতিনীতি ভুলে কৃষি বিল পাশ করানোর সময় নৈতিকতাবোধ কি গড়ের মাঠে ঘাস খেতে বেরিয়েছিল? ডেরেক ও ব্রায়েন তো কেবল পাপড়ি চাটের কথাই বলেননি, ১২টা বিলের এক লম্বা তালিকাও দিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ১২টা বিল, কোনও আলোচনা ছাড়াই, গড়ে একেকটা বিলে পাস করানোর জন্য ৭ মিনিটেরও কম সময় নেওয়া হয়েছে, পাপরি চাট তো ছেড়েই দিন, খৈনি ডলতেও তো এর থেকে বেশি সময় লাগে, তাই না? কী কী বিল পাস হয়ে গেলো? কত মিনিটে পাস হল? ডেরেক জানাচ্ছেন, রাজ্যসভাতে জুভেনাইল জাস্টিস বিল, অপ্রাপ্তবয়স্কদের অপরাধ আর তার শাস্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানো হয়েছে ৫ মিনিটে, ফ্যাক্টরিং রেগুলেশন অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ছোট মাঝারি শিল্পের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পাশ করানো হল ৭ মিনিটে, ওই রাজ্যসভায় আরও একটা বিল এল সেদিন, কোকনাট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বিল, পাশ হল কত মিনিটে? এক মিনিটে, এটা সংসদের অবমাননা নয়? এটা নৌটঙ্কি নয়? লোকসভায় ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্কারাপসি বিল পাশ হল, ৫ মিনিটে। কেন করা হল? কারণ বিরোধীরা লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সরকার একটা জয়েন্ট পার্লিয়ামেন্টারি কমিটি তৈরি করুক, যা নাকি পেগাসাস নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত করবে। সেই কমিটি তৈরি করার দাবি তুলছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন, জেপিসি তৈরি হোক, তারপর বাকি যা কিছু আছে তা নিয়ে আলোচনা হবে, কারণ অভিযোগ গুরুতর। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক, বিচারপতি, শিল্পপতি, এমনকি বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন, সেই মহিলার ফোনেও আড়ি পাতা হয়েছে।
এই একই আড়িপাতার অভিযোগে, তদন্ত শুরু হয়ে গেছে ফ্রান্সে, আমেরিকায়। এমনকি ইজরায়েল ও পেগাসাস নির্মাতা এনএসও’র কাছে বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছে, আমাদের দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীরা আবেদন জানিয়েছেন, এন রামের মত প্রবীণ সাংবাদিক সুপ্রিম কোর্টে তদন্ত করার আবেদন জানিয়েছেন। অন্যের কথা ছেড়েই দিলাম শরিক দল, জেডিইউ’র নেতা নীতীশ কুমার বলেছেন, এখনই তদন্ত হওয়া উচিত, এটা খুব নোংরা কাজ। মোদি সরকার ভাঙা কাঁসরের মত বলেই চলেছেন, বে আইনী কোনও নজরদারী চালানো হচ্ছিল না, খেয়াল করুন তাঁরা অভিযোগ অস্বীকারও করছেন না। সেই সময়ে বিরোধীরা যারা দেশের কমবেশী ৬০% মানুষের প্রতিনিধি, তাঁরা একটা জেপিসি চাইছেন, এটা সংসদীয় তারিকা নয়? এটা নৌটঙ্কি? তাহলে সংসদীয় আইনে জেপিসি তৈরি করার নিয়ম আছে কেন? সেটা কি মোদিজির মন কি বাতে শোনার জন্য? দেশের বিরোধীরা ট্রাক্টর চালিয়ে, সাইকেল চালিয়ে সংসদে আসছেন, এটা নৌটঙ্কি? আর অটল বিহারী বাজপেয়ী গোরুর গাড়িতে করে সংসদে এলে সেটা দেশের কাজ? মাথায় গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে স্মৃতি ইরানী দিল্লির রাজপথে নেমেছিলেন, সেটা ছিল দেশের মানুষের জন্য? আর রাহুল গান্ধী নৌটঙ্কি করছেন? আসলে সে সব কিছুই নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রটা না কেবল নির্বাচনেই শেষ হয়ে যায় না, নির্বাচন কেবল মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকারে বসায়, সরকার চালানোর দায় দেয়, কিন্তু সরকারই সংসদীয় গণতন্ত্রের সবটা নয়, ভারতে তো কখনই নয়।
কারণ রাজীব গান্ধী বা কংগ্রেসের তুমুল জয়ের সময়েও কংগ্রেসের ভোট ছিল ওই ৪৬ শতাংশের আশেপাশে, নরেন্দ্র মোদি ওয়ান, মানে ২০১৪ তে ছিল ৩৭% আর ২০১৯ এ তা বেড়ে ৪০% এর মত। মানে আমাদের দেশে সেই অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কোনওদিনও হয়নি, আর হয়নি বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার। তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, এমন সরকারও কিন্তু নাকানি চোবানি খায়। বিরোধীদের বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না। ভেবে দেখুন রাজীব গান্ধী, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনও দল কখনও পায়নি, বোফর্স ইস্যুতে খড়কুটোর মত উড়ে গেলো। ইউপিএ দুইয়ের কথা ভাবুন, শেষের ছবিটা হুবহু এক। সংসদ অচল করে দিয়েছিল বিরোধীরা, হ্যাঁ বিজেপির নেতারাও ছিলেন, আজ যাঁদের নেতা, বিরোধীরা নৌটঙ্কি করছেন, বলে ব্যঙ্গ করছেন, সেই নেতার নেতা আদবানি, যোশীরা ছিলেন তখন লোকসভায়। সেই চেহারা আজ আবার সামনে, ২০১৪ তে নরেন্দ্র মোদি কি কম ভুল করেছিলেন, ইনফ্যাক্ট ডিমনিটাইজেশনের মত নির্বোধ পরিকল্পনা তখনই এসেছিল। কিন্তু সংসদে, তার বাইরে এতটা নার্ভাস দেখায়নি তাদের, মোদি – অমিত শাহকে, তাঁরা তখন হাতে মাথা কাটছেন, এ হাতে সিবিআই তো ওই হাতে ইডি, বিরোধী দলের কেউ মাথা তুললেই ডাক আসছে, চালু জোক ছিল, সিবিআই ডাকছে মানে বিজেপিতে ল্যাটারাল এন্ট্রি। সে সব করার পরেও ২০১৯ আরও বড় জয়, কিন্তু ক বছরের মধ্যেই পরিস্কার যে ভিতের গাঁথনি বড্ড পলকা, শরিকরা একে একে বের হতে শুরু করলো, শিব সেনা গেলো, অকালি দল গেলো, ডিএমকে গেলো, একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হওয়া শুরু হল, রাজস্থান, ছত্তিসগড়, ঝাড়খন্ড, কোনও রকমে বিহার বা এমপি রাখতে পারলেও মহারাষ্ট্র হাতের বাইরে, এবং শেষমেষ ঘাড়ধাক্কা এই বাংলায়। ফল? বিরোধীরা চাঙ্গা, সংসদে এরকম মারমুখি বিরোধী দেখা গেছে ২০১১ – ২০১২ – ২০১৩ তে, রোজ অধিবেশন স্থগিত হবার গল্প।
আর কেবল সংসদেই নয়, রামলীলা ময়দানে আন্না হাজারে, কেজরিওয়াল, সঙ্গে বিজেপি, নারী ধর্ষণ, মুল্যবৃদ্ধি, সরকার কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আজ ছবিটা ঠিক উলটো, সংসদের বাইরে কৃষকরা, তাঁরা মিছিলে, রাস্তায়। সংসদের ওয়েলে বিরোধীরা, দিল্লি গেলেন মমতা, কেবল গেলেনই না, পরিস্কার হুমকি, এবার থেকে নিয়মিত আসবো, আসার রাস্তাও পরিস্কার, তিনি এখন তৃণমূল পার্লিয়ামেন্টারি পার্টির নেতা, ওদিকে প্রশান্ত কিশোর চক্কর কাটছেন, বিএসপি কোনদিকে ঠাহর না হলেও, অকালি দল আর আপ অকংগ্রেসী, অবিজেপি আন্দোলনে আছে, লালু গিয়ে কথা বলছেন মুলায়মের সঙ্গে, রাহুলের ব্রেকফাস্টে ১৬ টা বিরোধী দল, হ্যাঁ তৃণমূলও আছে, সিপিএমও আছে, এমনকি ক’দিন আগে মুখ দেখাদেখি ছিল না, সেই শিবসেনার সঞ্জয় রাউত চলে এলেন রাহুলের ব্রেকফাস্টে, ঠিক সেই সময়, মানে রাহুলের বাড়িতে ১৬ টা বিরোধী দল যখন আলোচনায় বসেছে, স্ট্রাটেজি তৈরি হচ্ছে মোদি বিরোধিতার, ঠিক তখন বিজেপি পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় মোদিজি বললেন, সংসদের অবমাননা হচ্ছে, সংসদ চালাতে দিচ্ছে না বিরোধী দল।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত, কংগ্রেস দলনেতার নাম করতে গেলে পাপ্পু জাতীয় স্থুল রসিকতার আশ্রয় নিতেন মোদিজি, মঞ্চে এসে এক মহিলা নেত্রীকে টোন টিটকিরি দিতেন মোদিজি, সেই তিনিই এখন সংবিধান, গণতন্ত্র আর সংসদের কথা বলছেন, হ্যাঁ তিনি রিঅ্যাক্ট করা শুরু করেছেন, আগে কেবল বলে যেতেন, এখন গায়ে মাখছেন, গা চিড়বিড় করছে, মানে বিরোধিতার ধার বাড়ছে। এখানেই শেষ হবে নাকি? আপাতত বাদল অধিবেশন শেষ, বিজেপির রাজনৈতিক প্রাপ্তি শূন্য, অন্যদিকে পেগাসাসের ঠেলা, সুপ্রিম কোর্টের একটু হলেও অন্য স্বর, শরিক দলের আস্থা হারানো, বাংলার হার বিজেপিকে কোন জায়গায় নিয়ে এল ভাবুন, নকড়া ছকড়া অনিন্দ্যপুলকের দল সাংবাদিক ডেকে বিজেপি ছাড়ার কথা বলছে, বাবুলের মত সিকি আধুলি নেতারা বার্গেইন করার চেষ্টা তো অন্তত করছে, মিজোরামের বিজেপি নেতাদের সামলানো যাচ্ছে না। রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজের গলায় অন্যস্বর, ইয়েদুরিয়াপ্পা পদত্যাগ তো করলেন কিন্তু কী সলতে পাকাচ্ছেন কেউ জানে না। এই দক্ষিনী নেতা কিন্তু দু দুবার বিজেপির খেলা ভন্ডুল করে দিয়েছে, মধ্যপ্রদেশে মামাজী, শিবনাথ সিং চৌহান চুপ মেরে গেছেন, মন্ত্রিসভায় জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার লোক ঢোকানোকে মেনে নিতে পাচ্ছেন না, রমণ সিংয়ের কথা তো শোনাই যাচ্ছে না। নিতিন গড়কড়ি আর রাজনাথ সিংয়ের কাছে মাঝে মধ্যেই বিরোধী নেতারা যাচ্ছেন, সব মিলিয়ে এক ছন্নছাড়া অবস্থা বিজেপির। তাই পাপড়ি চাটের তুলনা এনেছেন ডেরেক ও ব্রায়েন, আগে এসব সরস তুলনা দিতেন মোদিজি, তিনি এখন সিরিয়াস, বিরোধীরা খিল্লি করছে, একেই বলে রোল রিভার্সাল, সব অর্থেই পাশা পলট।