আগামী দিনে আরও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিকে মাথায় রেখে বা আবার না জেলে পুরে দেয়, আর্থিক অপরাধের দায়ে আপাতত জামিনে থাকা কলমচি থেকে বহু মানুষ ৫০০ বছরের এক গোলামির বাঁধন টুটে যাবার, এক নতুন স্বাধীনতার কথা বলছেন। এই বহু মানুষের সব্বাই যে পারিতোষিক জুটবে বা জেলে যেতে হবে এই ভয়েই এসব কথা বলছেন তাও নয়। আসলে সমাজে মুষ্টিমেয় এমন মানুষজন তো থাকেন যাঁদের জনমত তৈরি করার ক্ষমতা আর সুযোগ দুটোই থাকে, তাঁরা হয় পারিতোষিকের লোভে না হলে ডান্ডাবেড়ির ভয়ে কিছু প্রচার করেন, করে থাকেন, যা অসত্য, যা মানবতা বিরোধী, যা অন্যায় অবিচারকেই স্থাপনা করে, যা মানুষের সভ্যতার বিপরীত কথাবার্তা। কী ভাবে সম্ভব হয় এই কর্মকাণ্ড? উদাহরণ দিয়ে বোঝাই, ধরুন গো বলয়ে খাদ্য অখাদ্য বিচার এবং তার রায়দান, কারা করেন? নিশ্চিতভাবেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা, তাঁরা জনসংখ্যার কত অংশ? দেশজুড়ে জাতিগত জনগণনা হয়নি, তবুও বিহারের হিসেব নিকেশকে সারা দেশের প্রেক্ষিতে রাখলে ব্রাহ্মণের সংখ্যা ৭-৮ শতাংশের বেশি নয়, এরও উপরে ক্ষত্রিয়দের যোগ করলে উচ্চবর্ণের মানুষজনের সংখ্যা ১৩ কি ১৪ শতাংশের কম। কিন্তু এনারা ওই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল, এনারা ক্ষমতাবান, এনারা সমাজের বিরাট অংশের মতামতকে প্রভাবিত করেন। এবং এই কারণেই সংখ্যার দিক দিয়ে কম এই উচ্চবর্ণের মানুষজন রাজনীতি থেকে আমলাতন্ত্র থেকে সর্বত্র এক বড় জায়গা জুড়ে আছেন, সংখ্যালঘু তবুও সংখ্যাগুরুর মতকে প্রভাবিত করেন। এই অংশের বেশিরভাগ এককালে রাজার, সামন্তদের লেজুড়বৃত্তি করেই রোজগার করতেন, পরবর্তীতে এনারাই যে দল শাসন ক্ষমতায় এসেছে তাদের চাটুকারিতা করেছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান এই অংশের মানুষের বৌদ্ধিক সমর্থনও পেয়েছে, পাচ্ছে। সেই অংশ থেকেই ঢাক ঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে বলা হচ্ছে ৫০০ বছর পরে গোলামির আগল ভাঙছে, নতুন স্বাধীনতা দিবস, নতুন ভারতের কল্পনা, নতুন ভারত বেরিয়ে আসছে এক মন্দির থেকে। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সাহায্য, অংশগ্রহণে সেই মন্দিরের উদ্বোধন এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, এটাই প্রচারের মূল কথা।
যে রাজনৈতিক দল আর সংগঠন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি উল্টে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল তারা আজ নতুন স্বাধীনতার কথা বলছে। আর আবার জেলে যাওয়ার ভয়ে এক বৃদ্ধ কলমচি পাখনা তুলে নেত্য করছেন এটাই আপাতত ছবি। তার মানে দুটো কথা আমাদের সামনে এসেছে, প্রথমটা হল এক ৫০০ বছরের গোলামির অবসান। দুই, এক নতুন ভারতের কল্পনা যা ওই মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছে। আসুন এই দুটো মিথ্যে প্রচারের ফানুসটা একটু নেড়েঘেঁটে দেখা যাক। সারা পৃথিবীর ইতিহাস উল্টে দেখুন, এক শাসনের অবসানের পরেই আরেক শাসন আসে, সেই শাসনের অবসানের পরে আবার একটা নতুন শাসন। আমাদের দেশে, মানে এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রথম কারা আসে? ইতিহাস বলছে মধ্য এশিয়া, বা এশিয়া মাইনর থেকে আর্যরা। এই গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষজন কি তাদের থেকে অসভ্য ছিল, অশিক্ষিত ছিল, তাদের থেকে পিছিয়ে পড়া কোনও সভ্যতার বাসিন্দা ছিল। ইতিহাস বলছে, না। উদাহরণ আমাদের হাতের সামনে, হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা, তাদের নির্মাণ, শহর, শস্যভাণ্ডার বলে দেয় ঘোড়ায় চড়া আর্যদের চেয়ে তারা ছিল অনেক এগিয়ে। খানিক সে অঞ্চলে বিভিন্ন মহামারী আর আর্যদের আক্রমণে সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়, আর্যরা ছড়িয়ে পড়েন, এ অঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়, তাঁদের সংস্কৃত ভাষা, ভাষার নাম থেকেই বোঝা যাবে তাঁরা নিজেদেরকে অনেক বেশি উন্নত এটা বোঝানোর জন্যই তাঁদের ভাষাকে সংস্কৃত, শ্রেষ্ঠ ভাষা বলতেন, মানে এদেশে আরও কিছু ভাষা ছিল। যা বলতে চাইছি এক সভ্যতার অবসান হয়, অন্য এক সভ্যতা গড়ে উঠতে থাকে, সেই আর্য বা মিলিত আর্যদের দক্ষিণের অভিযান, আবার দক্ষিণ থেকেই উত্তরে অভিযান, সব মিলিয়ে আরেক নতুন সংস্কৃতি, আরেক নতুন শাসনতন্ত্র। কিন্তু আমরা কি আর্যদের আগে গাঙ্গেয় অববাহিকার বাসিন্দা হিসেবে আজ নতুন করে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করব? করব না। সেটা হাস্যকর হবে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ (Fourth Pillar) | রামায়ণের সাত কাহন, মোদিজি জানেন?
এরপর দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রাজা মহারাজা তাদের নিজেদের ভেতরে বিস্তর লড়াই চলছে এমন এক দেশ, বিচ্ছিন্ন অথচ এক অপার সম্পদের অধিকারী ভারতর্ষের দিকে চোখ পড়ল লুঠেরাদের, এল তারা দলে দলে, সেদিন মন্দির ছিল রাজনৈতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র, সেদিন কেন? ইতিহাসে ধর্মস্থল চিরটা কালই রাজনৈতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেই থেকেছে। জেরুজালেম তো কেবল ধর্মস্থান ছিল না, বাণিজ্য কেন্দ্রও ছিল, ভ্যাটিক্যান সিটিও তাই, আবার বুখারা বা সমরকন্দ কেবল বাণিজ্য কেন্দ্রই ছিল না। ওই শহরগুলো তাদের বিরাট মাদ্রাসার জন্য, ধর্মশিক্ষার জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল, প্রয়াগ থেকে পাটলিপুত্র বা নালান্দাতে বাণিজ্য আর ধর্ম হাত ধরাধরি করেই চলেছে। কাজেই আক্রমণ ধর্মস্থলেই হত, লুঠেরারা এসে কেবল সোমনাথ কেন অজস্র মন্দির ভেঙেছে, লুঠ করেছে? সেই কারণেই করেছে যে কারণে এক ডাকাতের নজর থাকে সোনা গয়না টাকা সম্পদের দিকে। এরপর মোগলরা এল, বা বলা যাক মোগলদের এক অংশ এল কিন্তু ফিরে গেল না, তারাও এদেশেই থেকে গেল। কিন্তু আর্যদের মতো অনার্যদের ভাষা বা ধর্ম বা সংস্কৃতিকে গিলে খেতে পারল না বরং এক সহাবস্থানের দিকেই গেল। মোগল রাজারা সব্বাই তাই? সবক্ষেত্রেই তাই? না, ইতিহাস বলছে এই মোগলদের মধ্যেও কেউ অত্যাচারী ছিল, কেউ অসহিষ্ণু ছিল, কেউ আবার সহাবস্থানে বিশ্বাস করত। কিন্তু যাই হোক তারা এদেশের মাটিতেই থেকে গেল, এই মাটিতেই তাদের নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলল। বিশাল ইমারত থেকে সাহিত্য, সঙ্গীত, প্রশাসনিক কাঠামো থেকে খাদ্য সব কিছুতেই তারা কিছু দিল, কিছু নিল। তাদের সময়েই আজকে গোবলয়ের প্রামাণ্য রামকথা, রামচরিত মানস শুধু লেখা হল না, যখন সেই তুলসীদাস আক্রান্ত হলেন ব্রাহ্মণদের হাতে, যখন রামচরিত মানস পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল, তখন তা রক্ষাও করলেন ওই মোগল শাসকরা। যেহেতু আর্যরা এদেশের মাটিতেই থেকে গেল, এখানেই এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিল, তাই আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের অনেক লড়াই হলেও তাকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা হয় না। ঠিক সেইরকম বিভিন্ন রাজারাজড়াদের সঙ্গে, মারাঠাদের সঙ্গে, রাজপুতদের সঙ্গে, মোগলদের লড়াই হয়েছিল, রাজ্য দখলের লড়াই, দখলদারি মুক্ত করার লড়াই হয়েছিল কিন্তু সেগুলো স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল না। এরই মধ্যে ব্রিটিশ এল, তারা এদেশে থাকতে এল না, তারা দেশটাকে লুঠতে এল, দখল করে লুঠতরাজের জন্যই এল। কাজেই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই দেখলাম আমরা, সিপাহি বিদ্রোহ।
এমনকী মুচলেকা বীর সাভারকরও এই সিপাহি বিদ্রোহকে দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছেন। তো সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বে কে? ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই থেকে কুঁয়র সিং থেকে তাঁতিয়া টোপি, নানা সাহেব, বেগম হজরত মহল আর তাদের মাথায় মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। ফকির আর সন্ন্যাসীরা, মুসলমান আর হিন্দু সৈনিকরা লড়ছে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার যুদ্ধ। তারা হেরে গেল। জিতল ব্রিটিশেরা। জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ আর মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সিরাজ হেরেছিল পলাশীর যুদ্ধে আর সিপাহি বিদ্রোহ, দেশের প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন দেশীয় রাজাদের, মূলত হিন্দু রাজাদের সমর্থন নিয়ে জিতে গেল ইংরেজরা। শুরু হল আবার নতুন স্বাধীনতার আন্দোলন। কাদের বিরুদ্ধে? নতুন শাসক, ইংরেজদের বিরুদ্ধে। বহু লড়াই, বহু বিশ্বাসঘাতকতা, বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রাণ বিসর্জন, বহু বিশ্বাসঘাতকের ঘৃণ্য চক্রান্ত, বহু আন্দোলন, সহিংস পথ, অহিংস পথ পার করে স্বাধীনতা এল ১৯৪৭-এ। দেশ দ্বিখণ্ডিত হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক, ধার্মিক স্বাধীনতা এল। আমাদের সংবিধান অধিকার দিল প্রত্যেক নাগরিককে, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার, নিজস্ব ধর্ম পালনের অধিকার। আজ এতদিন পরে কোন স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে? কারা বলছেন? যাঁরা সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ প্রশাসনকে লিখিত আশ্বাস দিয়েছিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে থাকার? যারা ইংরেজ প্রশাসনের কাছে লিখিত মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন? তাঁরা আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলছেন? আমরা ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা পেয়েছি, ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে, মুম্বইয়ে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ আর্মির শেষ সদস্য দেশ ছেড়েছিলেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশ ছেড়েছিলেন, ব্রিটিশরা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ ছেড়ে দেশে ফিরেছিলেন। আজ কারা দেশ ছাড়বে? ছাড়ছে? কাদের হাত থেকে স্বাধীন হলাম আমরা? কারা প্রশাসনে আছে? যাঁরা প্রশাসনে বসে আছে তাঁরাই বলছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের কথা। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পরে আমরা আমাদের সংবিধান লিখেছিলাম, হ্যাঁ স্বাধীনতার পরেও দু বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিতর্ক আলোচনার পরে আমাদের সংবিধান সভা এক নতুন সংবিধানকে দেশের সংবিধান হিসেবে ঘোষণা করল। যারা সেই সংবিধানকে মানেনি, যারা সেদিন দেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতকে মেনে নেয়নি, তারা আজ নতুন স্বাধীনতার কথা বলছে। তাহলে কি তারা এই সংবিধানের বদলে একটা নতুন সংবিধান রচনা করতে চায়? কীরকম হবে সেই সংবিধান? তার প্রস্তাবনায় কী লেখা হবে? দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭-এ, প্রথম সাধারণ নির্বাচন ১৯৫২-তে, প্রতি পাঁচবছর, কখনও কখনও তার আগেই বিভিন্ন রাজ্যের বা দেশের সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। দেশের শাসন ছেড়ে যাওয়া কেউ তো সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি, এবারে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার পরে কাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না? এ কেমন দ্বিতীয় স্বাধীনতা যা আমাদের নতুন শাসক দেবে না, যাঁরা গত ১০ বছর ধরে শাসন ক্ষ্মতায় আছেন তাঁরাই নতুন স্বাধীনতার কথা বলছেন? এ কেমন দ্বিতীয় স্বাধীনতা যা আমাদের দেশে এল কিন্তু যাদের হাত থেকে স্বাধীনতা আমরা পেলাম তাঁদের চিহ্নিত করা গেল না বা তাঁরা দেশ ছেড়ে চলেও গেলেন না। এ কেমন দ্বিতীয় স্বাধীনতা যা আমাদেরকে নতুন এক সংবিধান দিল না, নতুন জাতীয় সঙ্গীত, নতুন জাতীয় পতাকাও দিল না। তাহলে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা কেন? আসলে আজ যাঁরা ক্ষমতায় তাঁরা শঠ, প্রবঞ্চক, বিশ্বাসঘাতক, তারা মুক্তকণ্ঠে বলতেও পারছে না কাদেরকে তারা দেশ থেকে তাড়াতে চায়, তারা বলতে পারছে না কাদের হাত থেকে এই স্বাধীনতা এল? তারা বলতে পারছে না যে তাদের ইচ্ছে দেশের সংবিধানকে আমূল বদলে দেওয়া, তাদের ইচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় পতাকাকেও বদলে দেওয়া। এসব ইচ্ছে তাদের আছে, কিন্তু প্রকাশ্যে বলার মতো বাপের ব্যাটা তাঁরা নন, নন বলেই শঠতা আর প্রবঞ্চনা দিয়ে গোল গোল কথা বলছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলছেন। দু’ নম্বর কথা যা বলা হচ্ছে তা হল এক নতুন ভারতের কল্পনা, সে আরেক ঢপবাজি, তার কথা কাল বিস্তারিত বলব, আজ এই পর্যন্তই।