৪২ জনের নাম ঘোষণা হল, যদিও র্যাম্পে ছিলেন ৪১ জন, না ঘাটালের ঘোষিত প্রার্থী দেব উপস্থিত ছিলেন না ব্রিগেডে। সেটা কি ওনার কাজের জন্য? নাকি অন্য কোনও কারণে? জানা নেই। অন্যান্য সময়ে দেব আসতে পারেন নি, উনি ব্যস্ত আছেন গোছের ঘোষনা হত, এবারে তাও নেই, যদিও নাম আছে, ঘাটালে দেব হিরণ লড়াই হবে। দু দলেরই দেওয়াল লিখন শুরু হয়ে গেছে। ব্রিগেডে দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে এখবর আগের দিন থেকেই ভাসতে শুরু করেছিল, তাঁরা র্যাম্পে হাঁটবেন এখবরও ছিল। বর্ধমান – দুর্গাপুর লোকসভাতে সুরিন্দার সিং আলুওয়ালিয়ার সামনে কীর্তি আজাদকে দাঁড় করানো হচ্ছে এ খবরও ছিল, উনি বাংলায় এসেছেন দিন তিনেক আগেই, এসেই প্রথমে চলে গেছেন ঐ বর্ধমানে, হাজির ছিলেন দলীয় বৈঠকেও, তখনই এই খবর মিডিয়াতে এসে গিয়েছিল। আই পি এস অফিসার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করেই যে রাজনীতিতেই আসছেন তাও অনেকেই জানতেন, কেবল মনে হয়েছিল উনি বালুরঘাট থেকে মাঠে নামবেন, নামানো হলো মালদা উত্তর থেকে। দার্জিলিং এ গোপাল লামা ভূমিপুত্র হিসেবেই এলেন, খুব অবাক করার মতো কিছু নয় তবে তাঁর মনোনয়ন বিজেপি কে খানিক অসুবিধেতে ফেলবে, সে কথা পরে আসছি। এবারে এই ৪২ জন এর তালিকা তৈরির আগে বেশ ভালো রকমের ভাবনা চিন্তা ছিল। এর আগেও তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে তো ভাবনা চিন্তা থাকেই কিন্তু এবারে তা আরও অনেক পরিস্কার মাপকাঠিও পরিস্কার। তালিকা দেখুন বুঝতেই পারবেন প্রতিটা আসনের প্রার্থী লড়াই এর জন্য জেতার জন্য বাছা হয়েছে, একটাতেও ওয়াক ওভার নয়, উইনেবিলিটি ওয়াজ দ্য ফার্স্ট ক্রাইটেরিয়া, জিততে হবে এটাই প্রথম বিবেচ্য। দ্বিতীয় হল আনুগত্য। হেক্কড়বাজ অর্জুন সিং বাদ, এলেন অনুগত পার্থ ভৌমিক আবার তালিকাতে ঢুকলেন দেবাংশু ভট্টাচার্য, তমলুক থেকে, নাম ভাসছিল বা ভাসানো হচ্ছিল কুনাল ঘোষের। আরামবাগে গতবার সামান্য ভোটে, হাজার বারোশ ভোটে জিতেছিলেন অপরুপা পোদ্দার, এবারে সেই আরামবাগের টিকিট গেল মিতালি বাগের কাছে, মহিলা, জাতি সমীকরণে এগিয়ে, আর সংগঠনের জোর, সব মিলিয়ে আরামবাগ ধরে রাখার জন্য পরিবর্তন। মতুয়া ভোটের দিকে চোখ গত নির্বাচন থেকেই আছে, এবার প্রার্থী তালিকাতে সেটা চোখে পড়বেই রাণাঘাট বনগাঁতে মুকুটমণি অধিকারি, বিশ্বজিৎ দাস কে দাঁড় করানো হল, বিজেপি থেকে সদ্য দলে এসেছেন, বিজেপির সংগঠনের খানিকটা ভাঙিয়ে এনেছেন এবং মতুয়া ভোটের দাবিদার। আলিপুরদুয়ার এ একটা রিগিং এর অভিযোগও শোনা যায়নি ঐ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে, না একটা অভিযোগও বিজেপির তরফ থেকেও আসেনি, কিন্তু জেলা পরিষদে বিজেপি শূন্য, ১৮ টা আসনই তৃণমূলের দখলে, আর যে নেতার হাত ধরে এই জয় এসেছিল তাকে রাজ্য সভায় পাঠানো হল, এবার সেই প্রকাশ চিকবরাইক নিজেই প্রার্থী। এবারের তালিকা জেতার সম্ভাবনা, আনুগত্য আর সংগঠন তিনটের নিক্তি মাপা বিচারে তৈরি। পুরুলিয়াতে গতবারে হেরেছিলেন ডাক্তার মৃগাঙ্ক মাহাতো, এবার তাঁর বদলে শান্তিরাম মাহাতো, অনেক বেশি বলিয়ে কইয়ে। ঝাড়গ্রাম থেকে এক্কেবারে নতুন মুখ কালিপদ সোরেন, সাঁওতালি ভাষার গবেষক, পদ্মশ্রী পেয়েছেন, আকাদেমি পুরস্কার আছে, শোনা যাচ্ছিল সদ্য পদত্যাগ করা ঝাড়গ্রামের বিজেপি সাংসদ কুনার হেমব্রমের নাম, কিন্তু তা ছিল নেহাতই গুজব, বোঝা গ্যালো। বিজেপির সিটিং এম পির পদত্যাগ এখানে বিজেপিকে বিব্রত করবে। মেদিনিপুরে জুন মালিয়া, গত ক বছর ওখানেই পড়ে আছেন, দিলীপ ঘোষকে সম্ভবত মেদিনীপুর দেওয়া হচ্ছে না, জুন মালিয়া এবারে বিধায়ক থেকে দিল্লি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, লড়াই খুব খুব কঠিন। তমলুকে বাঘ মারতে পাঠানো হল দেবাংশুকে, সামনে থাকবেন অভিজিৎ গাঙ্গুলি, কদিন আগেও মনে হচ্ছিল ভিনি ভিডি ভিসি, উনি দাঁড়াবেন, প্রচারে নামবেন আর জেতার সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসবেন, এখন মনে হচ্ছে লড়াই খুব কঠিন, শুভেন্দু অধিকারি প্লাস অভিজিৎ গাঙ্গুলির বদলে লড়াইটা শুভেন্দু অধিকারি বনাম দেবাংশু ভট্টাচার্যের, এবং প্রায় সমানে সমানে, এই আসন বিজেপি অনায়াসে জেতার কথা, অভিজিৎবাবু এই আসনকে কঠিন করে দিয়েছেন। যে আন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে তাঁর ইমেজ তৈরি হল, সেই নিয়োগ দূর্নীতির আন্দোলন, চাকরি প্রার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলন ধরণা, সবকিছুকেই এমনভাবে নস্যাৎ করলেন তিনি যা দেখে নিজলিঙ্গাপ্পার নাম মনে পড়তে বাধ্য। ওদিকে লকেট হুগলিতে জিতেছিলেন এবং তারপর থেকেই হুগলির বিজেপি রাজনীতি তে গোষ্ঠিদন্দ্ব এক বড় খবর, সেখানে রচনা কে বাঘ মারতে পাঠানো হল। রচনা জিতলে লকেটের রাজনীতির সামনে প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলবে, লকেট জিতে গেলে বড় কোনও খবর তো হবে না।
তবে রচনার রাজনীতিতে আসার মধ্য দিয়ে একটা বৃত্ত প্রায় সম্পূর্ণ হল, রচনা, শ্রাবন্তী, মিমি, নুসরাত, কনটেমপোরারি অভিনেত্রীরা প্রত্যেকেই রাজনীতিতে নামলেন, ২০২৬ এ ঋতুপর্ণা মাঠে আনলেই সম্পুর্ণ হবে। মালদা উত্তর আর মালদা দক্ষিণের প্রার্থী চয়ন বলে দিচ্ছেন মালদায় গণি খান আজ অতীত, কোতোয়ালি বাড়ির রাজনীতি মালদাকে ঘিরে থাকতো আষ্টেপৃষ্টে, সে ঘেরাটোপ আর নেই। কংগ্রেস অবশ্য সে বংশের বাতিটুকু জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, তার জন্য শেষ বল পর্যন্ত খেলা দেখতে হবে। মাথায় রাখুন মালদা জেলা পরিষদের ৪৩ জনের মধ্যে ৩৪ জন তৃণমূল, ৫ জন মাত্র কংগ্রেস আর ৪ জন বিজেপির। সেই হিসেব মাথায় রেখেই একধারে একজন আই পি এস অফিসার অন্যদিকে অক্সফোর্ডের পি এইচ ডি ডিগ্রিধারী নতুন মুখ কে হাজির করেছে তৃণমূল, মজার কথা হল এই শাহনওয়াজ আলি রাইহানের গবেষণার বিষয় ছিল Between Marx and Muhammad : Muslims and communism in Bengal, কমরেড সেলিমের এই গবেষণা পত্র টি পড়ে দেখা উচিত। ওদিকে মিমি চক্রবর্তি আর নুসরত জাহানের টিকিট কাটা গেছে, বাঁচা গেছে, এরকমটাই অনেক তৃণমূল নেতা কর্মী বলছেন, বদলে অতিথি শিল্পী নয় পুরোদস্তুর রাজনীতিতে নামা সায়নী ঘোষ মিমি চক্রবর্তির বদলে আর বসিরহাটে নুসরাতের জায়গাতে হাজি নুরুল ইসলাম, ইনিও দলের কর্মী, বহুদিন ঐ এলাকাতেই লড়ে যাচ্ছেন, ভূমিপুত্রও বটে, সন্দেশখালির রেশ কাটিয়ে তিনি জিততে পারেন কিনা সে দিকে চোখ থাকবে সবার। বহুবার বলেছিল বাংলার দিকে বিজেপির একটা চোখ রয়েছে তার অন্যতম কারণ হল বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, দিল্লিতে যে আসন বিজেপি হারাবে তা পূরণ হবে যে রাজ্য থেকে সেই তালিকাতেই আছে পশ্চিম বাংলার নাম। গতবারের ১৮ পার করে আরও গোটা সাত আট আসন জেতার জন্য তাদের মাস্টার প্ল্যান আজকের নয়, বহু পুরনো, গতবার লোকসভা নির্বাচনের পরেই এই কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল, ২০২১ এ বিধানসভাতে হারের পরে সেই স্বপ্ন প্রথম ধাক্কা খায়, ২০২৩ এ পঞ্চায়েত জেলাপরিষদের নির্বাচনে বোঝা গ্যালো বুথ লেভেলে বিজেপি এখনও শিশু। কাজেই মাত্র গত তিন চার মাস আগে মনে হচ্ছিল বিজেপি কি গোটা চার আসনও পাবে? কিসের ভিত্তিতে?
২০১৯ এর পরে বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৩ এ ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন আর এর মধ্যের বিভিন্ন উপনির্বাচনের ফল দেখে মনে হচ্ছিল ৪ টে আসন পাওয়াও বেশ কঠিন হবে। বুথ স্তরে সংগঠন নেই, দলের মধ্যে চূড়ান্ত গোষ্ঠি দন্দ্ব আর ভুল স্ট্রাটেজি, এই তিন কারণেই বিজেপি অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। ভাবুন না অনন্ত মহারাজের কথা, রাজবংশী সম্প্রদায়ের ভোট পাবে বলে যাঁকে এনে রাজ্যসভাতে পাঠানো হল, সেই তাঁকে এখন নিদেনপক্ষে চুপ করে থাকার অনুরোধ করতে হচ্ছে, জঙ্গলমহলে যে সমর্থন এসেছিল সেটা ক্ষয়েছে বললে কম বলা হবে, কুড়মি আন্দোলনকেও বুঝেই উঠতে পারেন নি বিজেপি নেতারা, কাজেই পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম হাত থেকে গেছে। বিজেপি কর্মীদের মধ্যে সত্যিই বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল বা আছে ঐ দিলীপ ঘোষের, সে উনি গরুর দুধে সোনা পান আর কাঁধে তোয়ালে ফেলে বাইকে চড়ুন, যে ভাবেই হোক তিনি কর্মীদের মধ্যে ভরসা তৈরি করতে পেরেছিলেন, এখন তিনি গোলপোস্টের বাইরে। অভিজিত গাঙ্গুলিকে বের করে এনে নির্দল হিসেবে তমলুক কেন? যাদবপুরেও দাঁড় করালে বড় ঘটনা হত, তা না করে সরাসরি বিজেপিতে আনার পরে এখন তিনি বিজেপির বোঝা, সে বোঝার ওজন দিনে দিনে আরও বাড়বে। কিন্তু সন্দেশখালির ঘটনার পরে নির্দিষ্ট কোনও আসনের কথা না হলেও পার্সেপশনে, ধারণায় খানিক বদল এসেছে, মনে হচ্ছে না ৪ বা ৫ নয়, বিজেপি আরও কিছু আসন পাবে, পেতে চলেছে। ধরুন মনেই হচ্ছিল আসানসোলের আসন বোধহয় গ্যালো, কিন্তু ঐ পবন সিং কান্ডের পরে ওই আসনের কথা আর আসছেই না। মনে হচ্ছিল কাঁথি, তমলুক তো চলেই গেছে, মানে তৃণমূলের দুটো জেতা আসন এবার বিজেপি জিতবে। সন্দেশখালির ঘটনার পরে কি মনে হয়েছিল বিজেপি ১৮ র চেয়ে বেশি আসন জিতবে? না তা মনে হয় নি, কিন্তু মনে হচ্ছিল ১২/১৪ টা আসন পেয়েই যাবে। কিন্তু গতকালের তালিকা বের হবার পরে লড়াই আরও অনেক কঠিন হয়ে গ্যালো বিজেপির কাছে। দার্জিলিং সহজ আসন, গোপাল লামা এক মাস্টার স্ট্রোক, রাজু বিস্ত আর যাই হোক ভূমিপূত্র নয়, আবার রাজু বিস্ত কে সরিয়ে মোদিজীর প্রিয় শ্রিংলা কে কজন মেনে নেবেন? তবে রাজনীতি এক বড়সড় দাবার খেলা, তৃণমূল একটা কঠিন চাল দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে এগিয়ে গেছে তৃণমূল, পরের চালের জন্য অপেক্ষা করুন, বিজেপিতেও অমিত শাহ আছেন, ওখানেও মাস্টার স্ট্রোক দেবার লোকজন আছেন, কে বলতে পারেন যে ঐ ৪২ জনের এক আধ জন ইলেকশনে দাঁড়াবেন না, সরে দাঁড়াবেন, হতেও তো পারে। কাজেই বিজেপি ২০ টা আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে খানিক এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তৃণমূল ৪২ টা আসনে জবরদস্ত প্রার্থী দিয়ে অনেকটাই ঘর গুছিয়ে ফেলেছে, তাই আপাতত অ্যাডভানটেজ তৃণমূল, এই এগোনও পেছনো চলতেই থাকবে। জানি আপনাদের মাথায় আসছে কংগ্রেস আর বামেদের কথা, এখনও যারা কোনও হিসেবের মধ্যেই নেই, কংগ্রেস চেষ্টা চরিত্র করে একটা, বড় জোর দুটো আসন পেলেও পেতে পারে, বামেদের একটা আসনও জুটবে না, তবুও তাদের প্রার্থী তালিকা বের হলে আলোচনা তো করবোই। আপাতত উপসংহার, ৪২ টা আসনে প্রার্থী ঘোষণার পরে তৃণমূল আবার বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল, বিজেপি আবার অনেকটাই পেছলো আর বাম কংগ্রেস জোটের সম্ভাবনা বেড়ে গ্যালো এ কথা বলাই বাহুল্য।