একলা চলোরে ।
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়–
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে ॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে–
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে ॥
গিরিডিতে বসে রবি ঠাকুর এই গান লিখেছিলেন, ১৯০৫ এ সেপ্টেম্বার মাসে ভান্ডার পত্রিকায় ছাপা হল, সুর প্রচলিত এক ধাপকীর্তনের, হরিনামে জগৎ মাতালে, আমার, একলা নিতাইরে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় এই গান মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছিল, অনেক অনেক পরে ১৯০৭ নাগাদ, রবি ঠাকুর এইচ বসু স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানিতে এই গান রেকর্ড করেন, তখনও মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় গান লেখার ১০ বছর পর ১৯১৫ তে তিনি দেশে ফিরলেন, কিন্তু কী আশ্চর্য, এ গানের প্রত্যেক লাইন যেন গান্ধিজীকে মনে করেই লেখা, মানুষটার ডাকে আসমুদ্রহিমাচল মানুষ রাস্তায় নেমেছে, তার ইসারায় জেলে গেছে, কিন্তু সারাজীবন তিনি একলাই থেকে গেছেন, শেষ জীবনে তো বটেই। ১৯৪৮ এ আজকে এই সময় তিনি নিথর, তাঁর দেহ ঘিরে অজস্র মানুষ কিন্তু তিনি একলা, এখনও তিনি উপেক্ষিত, কিন্তু ৭৮ বছরের বৃদ্ধ এখনও ততটাই প্রাসঙ্গিক, ততটাই ঋজু বক্তব্য নিয়ে অনেকের প্রেরণা, অনেকের এখনও মাথাব্যাথা।
গোয়ালিয়র থেকে আনা ইটালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল, নম্বর ৭১৯৭৯১ থেকে তিনটে বুলেট বিঁধেছিল গান্ধিজীর বুকে, মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু এখনও তাঁর চিন্তা নিয়ে বড্ড বেশি রকমের প্রাসঙ্গিক, আর এস এস-বিজেপির আগ্রাসী ধর্মীয় ফাসীবাদ যত উগ্র চেহারা নেবে, গান্ধী তত বেশি করে প্রাসঙ্গিক হবেন, তবুও তিনি শেষ দিন পর্যন্ত বড্ড একলা, সব দিক থেকে। কস্তুরবা মারা গেছেন, যার কাছে তিনি সব কথা বিনা দ্বিধায় বলে ফেলতে পারতেন, ঐ আগা খান প্যালেসেই মারা গেছেন মহাদেব দেশাই, তাঁর বন্ধু, সহচর। মদ্যপ হরিলাল, বড়ছেলের নামে টাকা তছরুপের অভিযোগ, গান্ধী ত্যাগ করেছেন তাঁকে, হরিলাল লিখেছে আপনি মানুষ নন, নিজের অসহায় সন্তানের পাশে দাঁড়ালেন না? উনি গান্ধী, উনি সততার পাঠ দেন, উনি অন্যায়ের পাশে দাঁড়াতে পারেন না। রাজনৈতিক পরিসরে সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাছে, আপোষকামী, প্রশ্ন উঠেছে ভগত সিংহের ফাঁসি কেন আটকাতে পারলেন না, তাঁর ক্ষমতাকে বিশাল মনে করেছিল দেশের মানুষ, গান্ধিজী বললেই ফাঁসি রদ হয়ে যাবে, গান্ধিজী বলেছিলেন, আমি ওদের কাজ কে সমর্থন করি না, কিন্তু মানবতার খাতিরে ওদের ফাঁসি দিও না, ইংরেজরা শোনেনি, ভারতীয়দের বড় অংশ কেবল প্রথমটা শুনেছে, তিনি হিংসা বিরোধী। হ্যাঁ অহিংস রাজনীতির কথা তাঁর মুখে তো নতুন কিছু নয়, কিন্তু সেই অবোধ প্রশ্ন থেকেই গেছে, কেন তিনি ফাঁসি আটকালেন না?
তিনি ইংরেজ ভারত ছাড়ো র ডাক দিচ্ছেন, কংগ্রেস নেতারা দ্বিধাগ্রস্ত, সমাজতন্ত্রী নেহেরু ফাসিস্ট বিপদ কে আটকাতে বড় ঐক্য দরকার বলে মনে করেন, দলের অনেকেই যুদ্ধ চলাকালীন ঐ মাপের আন্দোলনে নামতে দ্বিধাগ্রস্ত, গান্ধিজী বলছেন, যুদ্ধে নৈতিক সমর্থন মিত্র শক্তির দিকেই, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা নয়, হিন্দু মহাসভা আর এস এস কেবল কংগ্রেসের বিরোধিতা নয়, ব্রিটিশদের সমর্থনে কাজ করতে শুরু করলেন, সাভারকার তো মুচলেকা দিয়েই জেল থেকে বেরিয়েছিলেন, তিনি যুবকদের ইংরেজ ফৌজে ভর্তি হবার নির্দেশ দিচ্ছেন। সোভিয়েত আক্রান্ত এখন এটা জনযুদ্ধ, এই তত্ত্ব নিয়ে ব্রিটিশ ফৌজে যোগ দিতে থাকল কমিউনিস্টরা, জাতির পিতা একলাই বললেন ইংরেজ ভারত ছাড়ো, কংগ্রেস বাধ্য হল সেই আন্দোলনের ডাক দিতে। ভারত ছাড়ো অন্দোলন শুরুর আগের দিনেই গ্রেপ্তার হলেন গান্ধী, কস্তুরবা, তাঁদের জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেদিনও নিস্তরঙ্গ ভারতবর্ষ, একলা গান্ধী, কিন্তু রাস্তায় গান্ধী, স্বরাজ চাই, পূর্ণ স্বরাজ চাই, ইংরেজ ভারত ছাড়। দ্বিতীয় দিনে জেগে উঠল ভারতবর্ষ, গান্ধী সমেত নেতাদের গ্রেপ্তারিই জাগালো ভারত কে, উত্তাল হল এই বাংলা, মেদিনীপুর স্বাধীন হল। যুদ্ধ শেষ, স্বাধীনতা আসবে, মহম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানের কথা বলছেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলছেন বিনায়ক দামোদরদাস সাভারকর, গান্ধিজী ঐক্যবদ্ধ দেশের কথা বলছেন, মাউন্টব্যাটেন কে বলছেন, আপনারা চলে যান, আমরা নিজেরা বুঝে নেবো। প্যাটেল চাইছেন যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতা, এই সুযোগ ছাড়া যায় না। নেহেরু বিভ্রান্ত, একবার মাউন্টব্যাটেন একবার গান্ধিজী করে বেড়াচ্ছেন, নিজেকে বোঝাচ্ছেন, দেশের স্বাধীনতা পেতে হলে, দেশবিভাগকে মেনে নিতেই হবে।
গান্ধীজী বলেই ফেললেন, আমি একলা, আহা আজ যদি আমার আরেক সন্তান দেশে থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত সে রুখে দাঁড়াতো, উনি নেতাজীর কথা বলছিলেন। শেষ পর্যন্ত র্যাডক্লিফ সাহেব এলেন, দেশ ভাগ করলেন, ম্যাপের ওপর পেনশিল দিয়ে দাগ টানা হল, সে দাগ স্কুলের মাঠ কে স্কুল থেকে আলাদা করে দিল, নমাজের মসজিদ পড়ে রইল একপারে, কাসেম মিয়াঁর ঘর আরেক দিকে, হারান মাঝি চেয়ে দেখল তার কালাচাঁদ, হরিচাঁদ থেকে গ্যালো ওইপারে, সে একবস্ত্রে বৌ বাচ্চা কে নিয়ে এই পারে, এবং এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু, রিফিউজি দুষছে কাকে? গান্ধিজীকে। কারণ গান্ধিজী বলেছিলেন আমার দেহের ওপর দিয়ে দেশ বিভাজন হবে। গান্ধিজী কথা রাখলেন না, কারা বলছেন? যে মুসলমানরা কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজের জমিন ছেড়ে, পাকিস্তানের দিকে রওনা দিলেন, তারা বলছেন। অন্যদিকে যারা তাদের এতদিনের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে আসতে বাধ্য হল, সেই পঞ্জাবি বা বাঙালি উদ্বাস্তু ও বলছেন, গান্ধিজী বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, গান্ধিজী এখানেও একলা।
কমিউনিস্ট রা বললো ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, এটা তো গান্ধীর ষড়যন্ত্রে ট্রানস্ফার অফ পাওয়ার, স্বাধীনতা কোথায়? এখানেও গান্ধিজী একলা। হিন্দু মহাসভা, আর এস এস লোকজন বলছে গান্ধী পাকিস্তান পন্থী, পাকিস্তানের হয়ে দালালি করছে, স্বাধীনতার ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে যাবে কেন? এটা হিন্দুরাষ্ট্র, মুসলমানদের জায়গা নেই, পাকিস্তান শত্রুরাষ্ট্র, আবার গান্ধিজী একলা। এই অবস্থাতেও ধৈর্য হারান নি, একলাই চলে যাচ্ছেন নোয়াখালি, দাঙ্গা থামাতে, চলে যাচ্ছেন কলকাতা, অনশনে বসছেন, দাঙ্গা বন্ধ করো। দেশ স্বাধীন, মধ্যরাতে পতাকা উত্তোলন, সেন্ট্রাল হলে নেহেরুর ভাষণ, ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি, তার আগেরদিন পাকিস্তানে চাঁদতারা পতাকা উঠেছে, তুলেছেন কায়েদে আজম জিন্নাহ, ইকবাল তাঁর গানের কলি বদলে লিখেছেন, মুসলিম হ্যায় হম, বতন হ্যায় পাকিস্তান হমারা। গান্ধিজী একলা চরকা কাটছেন। বলেছেন, আমাকে অনুষ্ঠান আড়ম্বর থেকে বাদ দাও, সচিব পেয়ারেলাল কে ডিক্টেশন দিচ্ছেন, কংগ্রেসের কাজ শেষ, কংগ্রেসের লড়াই ছিল স্বাধীনতার, স্বাধীনতা এসেছে, এবার স্বাধীন ভারতবর্ষে নতুন সংগঠন চাই, নতুন ভারত গড়ে উঠুক, ট্রাস্টির মত, অছির মত পয়সাওলা মানুষজন দায়িত্ব নিক দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের, কে শুনছে? তিনি বলে যাচ্ছেন, লিখে যাচ্ছেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব বিব্রত, গান্ধী একলা।
স্বাধীনতার শর্ত অনুযায়ী, সংযুক্ত ভারতবর্ষের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৫৫ কোটি টাকা পাওনা পাকিস্তানের, এদিকে পাকিস্তান আক্রমণ করেছে কাশ্মীর, নেহেরু মন্ত্রী সভা আটকে দিয়েছে সেই টাকা, মাউন্টব্যাটেন হাজির গান্ধীর কাছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মুখ পুড়বে, আপনি কিছু করুন। গান্ধিজী প্যাটেল নেহেরুকেই বললেন না, সংবাদ মাধ্যমকেও জানিয়ে দিলেন, এ টাকা পাকিস্তানের প্রাপ্য, এর সঙ্গে যুদ্ধের সম্পর্ক নেই। জিন্না বললেন এসব বাণী তে ভুলছি না, প্যাটেল বিরক্ত, নেহেরু বিব্রত, গান্ধিজী একলা।
ওদিকে সেই কবেই, ৪৭ এর আগস্ট মাসেই একই প্লেনে পাশাপাশি বসে দিল্লি এসেছেন তিনজন, বিনায়ক দামোদরদাস সাভারকার, নাথুরাম ভিনায়ক গডসে, নারায়ণ দত্রাত্রেয় আপ্তে। কয়েকমাস পরেই ৪৮ এর ১৮ জানুয়ারি, আবার অনশন ভাঙলেন গান্ধিজী, দিল্লির মসজিদ, মুসলমান বাড়ি ঘরদোর দখল করেছিল হিন্দু, শিখ উদ্বাস্তুরা, তিনি বলেছিলেন দাঙ্গা থামাতে হবে, জবরদখল ছাড়তে হবে, বিরক্ত প্যাটেল, বিরক্ত নেহেরু, আবার গান্ধীর অনশন, সব্বাই মিলে সই করে লিখে দিলেন, আর দাঙ্গা হবে না, দাঙ্গা থামলো, জবরদখলকারীরা সরে গ্যালো, হিন্দু শিখ উদ্বাস্তুরা বিড়লা হাউসের সামনে এসে শ্লোগান দিক গান্ধী তুমি বরং মরো, আমাদের আমাদের মত থাকতে দাও, গান্ধী আবার একলা। জানালেন ২ ফেব্রুয়ারির পরে পাকিস্তান যাবো, আবার প্যাটেল আর নেহেরুর মাথায় হাত, এই সময়ে গান্ধিজী করাচী যাবেন?
ওদিকে গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্র শেষ, একটা চেষ্টা হল ২০ জানুয়ারি, ধরা পড়ল, মদনলাল পাহওয়া, অনেক কিছুই বললো, যা বললো তা দিয়ে সাভারকার, নাথুরাম গডসে, গোপাল গডসে, নারায়ণ আপ্তে, দিগম্বর বাগড়ে, বিষ্ণু রামচন্দ্র কারকারে, শঙ্কর কিস্তিয়া সবকটাকেই গ্রেপ্তার করাই যায়, কেন জানা নেই, তদন্তই হল না। গডসে, আপ্তে আবার সাভারকারের বাড়িতে গ্যালো, তার নির্দেশে সেখান থেকে গোয়ালিয়র, সেখান থেকে গোয়ালিয়রে দত্রাত্রেয় সদাশিব পরচুরের বাড়িতে, যোগাড় হল ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল, গডসে আর আপ্তে চলে এল দিল্লি। নিউ এজ, কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকায় লেখা হল গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, পুলিশ, আই বির একজনও জানার চেষ্টাই করলো না, কারা ষড়যন্ত্র করছে, গান্ধিজী তখনও একলাই শেষ চেষ্টা করছেন, দেশ বিভাজন হয়েছে হোক, তিক্ততা মিটে যাক, হিন্দু মুসলমান ঐক্য ফিরে আসুক, তারপর দেখা যাবে। একলাই বলে যাচ্ছেন, একলা চলো রে। ৩০ তারিখ নাথুরাম গডসে খুন করলো, তিনটে গুলি বুকে নিয়ে তখনও একলাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আর সেই দিনগুলোতে যখন তাঁকে হত্যার চক্রান্ত চালাচ্ছে তারা যাদের উত্তরাধিকারীরা আজকে শাসন ক্ষমতায় বসে আছে, সেই চক্রান্তের কথা সবাই জানেন, সরকার জানে, পুলিশ জানে, সংবাদপত্র জানে এমনকি গান্ধিজী নিজেও জানেন। সেই সময় জুড়ে তিনি কী করছেন? সম্প্রিতীর কথা বলছেন, দাঙ্গা বিধ্বস্থ অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর প্রতিদিন সকালে ঐ ৭৮ বছর বয়সী মানুষটা এক শিক্ষকের কাছে বাংলা শিখছেন, কেন? কারণ তিনি বাংলায় রবীন্দ্রনাথ পড়তে চান। সেই তাঁকে হত্যা করা হল, হত্যার মূল অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হল, সেদিন প্রাণ দিয়েও উনি নিস্পত্তি করে দিতে পারতেন আমাদের দেশের এই চক্রান্তের, এই বিভেদকামী প্রচেষ্টার। কিন্তু সব ধামাচাপা দেওয়া হল। আজ তারি ফিরে এসেছে। একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে / রাজার দোহাই দিয়ে / এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, / মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি। আমরা তাদের কি চিনতে পারছি না? নাকি চিনেও ভয়ে কিছু বলতে পারছি না, নাকি আমরাও সেই হত্যায় সামিল ছিলাম? ৩০ শে জানুয়ারি, নিজের হাতের দিকে তাকান, রক্তের দাগ পরিস্কার।