অনেকের মনে হচ্ছে বিজেপি জাদু জানে, মনে হচ্ছে এক জাদুবলে তারা জিতে যাচ্ছে, অনেকে মনে করছেন ইভিএম ট্যাম্পারিং করে তারা জিতে যাচ্ছে। বহু মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছেন এই উল্কার গতিতে এক উচ্চতা ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতাকে ছুঁয়ে ফেলছে বিজেপি অনায়াসে। এর তুলনা ইতিহাসে রাইজ অফ হিটলার ছাড়া অন্য কোথাও নেই। এক বাজিগরের মতোই দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে জার্মান হৃদয় সম্রাট হয়েছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। হুবহু সেই উল্কাসদৃশ্য গতিতে উঠেই চলেছেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। আমাদের অনেকেই ভেবেছিলেন কর্নাটক গেছে এবারে মধ্যপ্রদেশ যাবে। ছত্তিশগড় তো বিজেপির কাছে যাবে এমনটা কেউ ভাবেনি। রাজস্থানে জোর লড়াই হবে, তেলঙ্গানা অবশ্য বিজেপির কাছে যাচ্ছে না সেটা সব্বার জানা ছিল। তবুও বিজেপি এক অন্য খেলা শুরু করেছিল, যে খেলার ফলে যতটা হারার কথা ছিল বিআরএস-এর ততটা হার হয়নি, এবং এখনও গোটা ১৫ কংগ্রেস ভাঙানোর চেষ্টা জারি আছে, তার জন্য কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতারাও আছেন এবং তা করা গেলে বিআরএস আর কংগ্রেসের ভেঙে আসা গ্রুপ নিয়ে তেলঙ্গানা সরকারের দখল নিতে পারবে বিজেপি। কিন্তু রাজ্যগুলোতে এমন জয় দেখার পরেও আমাদের মনে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করতে দম বেরিয়ে যাবে, বসুন্ধরা রাজে, শিবরাজ সিং চৌহান বা রমন সিং বিদ্রোহ করতেই পারে। কী হল? তিন রাজ্যে যাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানো হল কেউ তাঁদের নাম মাথাতেও এনেছিল? এঁরা প্রত্যেকেই ৫৬-৫৮ বছরের নিচুতলার থেকে উঠে আসা নেতা, প্রত্যেকে সংগঠনের বহু ধাপে পরীক্ষিত। প্রত্যেকেই আরএসএস-এর থেকে উঠে আসা দলীয় কর্মী এবং প্রত্যেকেই খুব সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন।
মজার কথা হল এঁদের নাম ঘোষণা হল, বিদ্রোহ কোথাও নেই, কেউ আপত্তি করল না। একগুচ্ছ সিনিয়র নেতাকে হাতে ললিপপ ধরিয়ে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ যাঁদের সিংহাসনে বসালেন তাঁরা উঠতে বললে উঠবেন, বসতে বললে বসবেন। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, গোয়া, ত্রিপুরাতে বিজেপির সরকার নয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। একমাত্র উত্তরপ্রদেশ আর অসম বাদ দিলে মাসখানেক পরে বাকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম আপনার মনে পড়বে না। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে গুগল না করে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর নাম আপনার মাথাতে আসছে না। কিন্তু তাতে কী? বিজেপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলে কোন মেসেজটা গেল? দেশের মানুষের কাছে কোন মেসেজ গেল? আদিবাসী মানুষজনের কাছে কোন মেসেজ গেল? ওবিসি মানুষজন এই রিক্রুটমেন্ট থেকে কী বুঝলেন? রাজস্থানের ব্রাহ্মণরা কেন আজ আনন্দে ফেটে পড়ছেন? অর্থাৎ সেখানেও মোদিজি যা বলার যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন যে দলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নেতারা দলের কাজ করুন, ভোটের প্রচার করুন, সময় সুযোগ মতো তাঁদের দিকেও চোখ ফেরানো হবে। বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এতটুকু বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতার পরিণাম খারাপ হবে, তেমন বড় নেতা হলে মার্গদর্শক মণ্ডলীতে ঠাঁই হবে, বুঝিয়ে দিয়েছেন দলে থাকলে, কথা শুনে মন দিয়ে কাজ করলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। ওদিকে কংগ্রেসের কথা ভাবুন, একজনকে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি, কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার অনুরোধ জানানো হল, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন, অপেক্ষাকৃত তরুণ একজনকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বানাতে পারল না কংগ্রেস, রাজস্থানে দীর্ঘদিন দুই নেতার কাজিয়া চলল। নির্বাচনে কি তার প্রভাব পড়েনি?
আরও পড়ুন: মহুয়া মৈত্র, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র আর বিজেপি
সংগঠনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন অমিত শাহ–নরেন্দ্র মোদি, সে সংগঠন কাজ করছে এবং বিরোধীদের মনে হচ্ছে জাদু চল গয়া। দিগ্বিজয় সিংয়ের মনে হচ্ছে ইভিএম হ্যাক হয়ে গেছে, রাজনৈতিক পণ্ডিতরা হতভম্ভ, হিসেব মিলছে না। হিসেব খুব সোজা, বিজেপি তার সংগঠনকে এমনভাবে সাজাচ্ছে যাতে আজ নয় আগামী দিনের পরিকল্পনা আছে, আজ নয় আগামী দিনের নেতৃত্ব যাতে এখন থেকে জায়গা পায় তার ব্যবস্থা তারা করছে। আবার তার সঙ্গে সঙ্গে এক অসম্ভব কড়া ধাঁচের হাইকমান্ড, যা দল, সরকারে শেষ কথা বলবে, তাও আছে। সব মিলিয়ে এক সংগঠন যা তার নিজের পাওয়া ভোটে কিছুটা যোগ করবে, কিছু মানুষকে নিয়ে আসবে, কিন্তু যারা ছিল, তারা চলে যাবে না। কাজেই তাদের রাজ্যে অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি কাজ করছে না, অন্যরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াতেই উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু খেয়াল করুন এসবই ঘটছে বিহারকে বাদ দিয়ে হিন্দি হার্টল্যান্ডে। না, এই জাদু কাজ করছে না দক্ষিণে, কাজ করছে না উপকূল এলাকাতে। গুজরাতকে বাদ দিলে বাংলা, ওড়িশা, অন্ধ্র, কর্নাটক, কেরল, তেলঙ্গানাতে, কোনও উপকূলবর্তী রাজ্যে কাজ করছে না এই জাদু। এমনকী মহারাষ্ট্রেও তেমন সক্রিয় নয় এই হাওয়া। হিন্দি হার্টল্যান্ডের বাইরে বলেই পঞ্জাব বিজেপির অধরা। কিন্তু যেটুকু এলাকাতে তারা সংগঠন তৈরি করেছে, তা ক্রমশ এক দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে উঠছে। সংগঠনের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলের কাছে কী খবর যাচ্ছে? কংগ্রেসের মতো বংশপরিচয় নয়, মহারাজা না মহারানির ঘরে জন্মানোটা কোনও শর্ত নয়, দলের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সংগঠনের কাজ করলে আপনি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমএলএ, এমপি, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত প্রধান হতেই পারেন। দুই, আপনাদের দলে একজন আছেন যিনি মহামানব, তিনিই আপনাদের পথ দেখাবেন। তিন, আপনারাই নতুন দেশ গড়বেন, এতদিন যা হয়েছে সবটাই চুরি জোচ্চুরি, আপনারাই ভবিষ্যত। মানে কংগ্রেসের সংগঠন গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে, সেই আন্দোলনে, আজ সেরকম এক আবহ তৈরি করতে পেরেছে বিজেপি। সেখান থেকেই তাদের সংগঠনের রেজিমেন্টেশন, কমিটমেন্ট গড়ে উঠছে। আবার সেই রাইজ অফ হিটলারের কথাই মনে পড়ে যাবে। একইভাবে সারা জার্মানির ইউথ, জার্মানির তরুণ তরুণী এক নতুন দিশা পেয়েছিল হিটলারের কাছ থেকে, যার বদলে নিঃশর্ত সমর্থন করেছিল তাদের ফুয়েরারকে। কেউ তলিয়ে দেখেনি কীসের উন্নয়ন? কীসের বিনিময়ে উন্নয়ন? আজও দেখছে না। দেখার দরকারই নেই কেন দেশের ৮০ কোটি মানুষকে ফ্রি র্যাশনের জন্য বসে থাকতে হয়? কেন মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতির কাছে চলে যাচ্ছে দেশের যাবতীয় সম্পদ? কেন বৈষম্য এতটাই বাড়ছে যেখানে এই শিল্পপতিদের মোট আয়, মোট সম্পদ দেশের মোট আয় আর সম্পদকে ছাপিয়ে যাচ্ছে? কেন দেশের ১৫-১৬ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলা হচ্ছে? কেন যাবতীয় আধুনিক ধ্যানধারণাকে মুছে ফেলে মধ্যযুগীয় ধারণাকে আঁকড়ে ধরা হচ্ছে? কেন দেশের সব ইতিহাসকে এক বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও মুছে ফেলার চেষ্ঠা হচ্ছে? কেন বহুস্বর, বহুমত, বহু মানুষের বহু পছন্দকে চুলোর দোরে পাঠিয়ে এক জাতি, এক ভাষা, এক নেতার তত্ত্ব আমদানি করা হচ্ছে? না, এই জমাট মজবুত সংগঠন থেকে সেসব প্রশ্ন উঠছে না, আর তা উঠবে না, উঠতে দেওয়া হবে না তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ভোটে জেতার এক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যার মধ্যে সংগঠনের দিকটা প্রত্যেক দলের শেখা উচিত। দলের কর্মীরা, যারা সংগঠনের কাজ করে, তারা যদি দেখে হঠাৎ এক ভুঁইফোড়কে এনে হাজির করা হয়েছে, কেবল অন্যদল থেকে ভাঙিয়ে আনা লোকজনকেই তোল্লা দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎ কোনও বুদ্ধিজীবী বা অভিনেতা বা কোনও সেলিব্রিটি মাথার উপরে বসে গেছে, তাহলে তারা ক্ষুণ্ণ হবেন বইকী। সেই কর্মীরা যদি দেখেন রাজ্যস্তরের নেতাদের খেয়োখেয়ি সামলাতে পারছে না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, তাহলে তাঁদের কাজ করার ইচ্ছে কমবে বইকী। তাঁরা যদি দেখেন দলের চার গোষ্ঠী চারমুখো তাহলে সেটা তাঁদের ভাবায়।
আর এই অভাবগুলো, এই সমস্যাগুলো অন্তত হিন্দি হার্টল্যান্ডে সমাধান করতে পেরেছে বিজেপি নেতৃত্ব। হিন্দি হার্টল্যান্ডের বিরোধী নেতাদের এই শিক্ষা নিতে হবে। আবার হিন্দি হার্টল্যান্ডের মানুষজনের কাছে বিজেপির বার্তা যেভাবে পৌঁছচ্ছে সেভাবে উপকূলবর্তী রাজ্য বা দক্ষিণে পৌঁছচ্ছে না যার ফলে সেখানে বিজেপির সেই সংগঠনও তৈরি হচ্ছে না। এই বাংলাতেই দেখুন না, এতদিন ধরে আরএসএস করে বিজেপিতে শক্তভাবে হাল ধরে কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় দিলীপ ঘোষ ছিটকে গেছেন। উঠে এসেছেন দল ভাঙানো শুভেন্দু অধিকারী, আবার তাঁকেও দলের মাথায় বসাতে নারাজ বিজেপি। দলের মাথায় এনেছেন আরেক নবাগত সুকান্ত মজুমদারকে। রাহুল সিনহা মাঝে মধ্যেই ভাবেন নিশ্চয়ই যে এতদিন ধরে পার্টি অফিস আগলিয়ে লাভটা কী হল? অর্থাৎ বিজেপির হিন্দি হার্টল্যান্ডে সংগঠনের যা যা ভালো, সেটা কিন্তু এই দক্ষিণ, বা উপকূলের রাজ্যগুলোতে অনুপস্থিত। আর এটাই বিজেপির এক বিরাট সমস্যা। এই হার্টল্যান্ডের ২২৪টা আসনে বিজেপির প্রার্থীরা গত নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। এবার সংগঠন আরও পোক্ত, আরও ভোট পাবে, ৫০ এর জায়গায় ৬০ শতাংশ পাবে, এতে ভোট শতাংশ বাড়বে কিন্তু বাকি ৩১৯-এ বিজেপির আসন ছিল মাত্র ৭৯, এবং এই অঞ্চলে বিজেপি আরও ক্ষয়ে যাচ্ছে। কর্নাটক, তেলঙ্গানা, ওড়িশা, বাংলা, বিহার এমনকী মহারাষ্ট্রেও কোনওভাবেই তাদের আসন আগের মতো হওয়া সম্ভব নয়। সেটাই আজকের বিজেপিকে চিন্তায় রেখেছে, ২০১৪ থেকেই বিজেপির সংগঠনে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আগে যে প্রবল শক্তিশালী রাজ্য নেতাদের দেখা যেত তাঁরা আজ হয় নেই না হলে তাঁদের হাত থেকে ক্ষমতা গেছে। কিন্তু তিন রাজ্যের নির্বাচনের পরে এক্কেবারে নতুন মুখ এনে বিজেপি কেবল ওই রাজ্যগুলোতে সংগঠন সাজাচ্ছে এমন নয়, তারা দেশের অন্য জায়গা, অন্য রাজ্যগুলোতেও এক মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করছে। আগেরবারের ফলাফল হবে না কিন্তু ওই বাকি ৩১৯-এ তাদের অন্তত ৬০-৭০টা আসন পেতেই হবে, সেটাই তাদের লক্ষ্য।