মোদিজি যেন এক ধর্মীয় পরিব্রাজক, এই মন্দির থেকে সেই মন্দির, সেখান থেকে আরেক মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতবড় রাম মন্দিরের উদ্বোধন, বলা হচ্ছে এটা নাকি দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। মিডিয়াতে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তনের মতো চলছে কেবল রামমন্দিরের কথা। মোদিজি চলে গেলেন কেরালার ত্রিশূরে গুরুবায়ুর মন্দিরে। কিন্তু প্রশ্ন তো উঠছেই, মন্দির দিয়েই পার করা যাবে ওই ২৭২? এই প্রশ্ন উঠছে কেন? কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দলই বলছে? না, দলের মধ্যেও এই আলোচনা চলছে। কখন? যখন দেশজুড়ে মোদি মোদি রব। রাম জন্মভূমি আন্দোলন তার শেষ পর্যায়ে, অযোধ্যাতে গেলে মনে হবে রাম নয় মোদিরাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন। চারিদিকে মোদিজির কাট আউট, মোদিজির সহাস্য মুখ আর ওনার গ্যারান্টি। ছবিতে মোদিজি, খবরের কাগজে মোদিজি, টিভিতে মোদিজি, হাতে আছে ৩০৩ জন সাংসদ, উল্টোদিকে একটা মুখও নেই তবুও আটকাচ্ছে কোথায়? প্রথম কথা হল গতবার তো একলাই ছিল ৩০৩, এবারে লক্ষ্য ৪০৪ পার করা, কেন? কারণ সেটাই কংগ্রেসের রেকর্ড। রাজীব গান্ধী ৪০৪ জন সাংসদ নিয়ে লোকসভায় ঢুকেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল ৪০৪ তো দূরস্থান, আসন ধরে ধরে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করেও মাথার চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে বিজেপি নির্বাচন সেলের। এক সেই রকম নেতা বললেন, ভায়া, অল দ্যাট গ্লিটারস, আর নট গোল্ড। মনে পড়ে গেল, সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছনোর পরেই তো পতনের শুরুয়াত। বলটা আকাশের দিকে ছুড়ে দিন, উঠবে, অনেক উঁচুতে উঠবে, কিন্তু উঠতেই থাকবে? না, একটা উচ্চতার পরে তা নীচে নামবে, তাকেই অধোগতি বলা হয়। কিন্তু এমন এক চিন্তার উৎস কী?
চিন্তার উৎস তিনটে। প্রথমটা হল এই রামমন্দির ইত্যাদি করেও হিন্দুদের ৬০ শতাংশ মানুষকে নিজেদের ছাতার তলায় আনা যায়নি। মানে মেরুকরণের দাওয়াই কাজে দিচ্ছে না। খুব সোজা হিসেব, ৮০ শতাংশ হিন্দুর ৬০ শতাংশ মানে ৪৮ শতাংশ ভোট, সেটা যদি বিজেপি পায় তাহলে আগামী ভোটের দরকারই থাকবে না, একেবারে দেশ রসাতলে যাওয়ার আগে অবধি ওই মেরুকরণের ওষুধেই বিজেপি ক্ষমতায় থেকে যাবে। ক্ষমতার হিসেব বরাবরই এই রকম, ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ার হয়েছে বার বার। হিন্দু মানুষজনের অনেকেই ঋক, সাম, যজু, অথর্ব বেদ, ১০৮টা উপনিষদ ইত্যাদি না পড়লেও রামায়ণ পড়েছেন, মহাভারত পড়েছেন। যদি পড়ে নাও থাকেন, দেখেছেন তো? খেয়াল করে দেখুন তো, কোথাও মন্দির পেয়েছেন? মানে রাম-সীতা মন্দিরে যাচ্ছেন, ১৪ বছরের বনবাসে, কোথাও পেয়েছেন? রামায়ণের সপ্তকাণ্ডে অযোধ্যার বর্ণনা আছে বহু জায়গায়, সেখানে কোথাও মন্দির আছে? নেই। মহাভারতে? কোথাও? পুঙ্খানাপুঙ্খ বর্ণনা আছে হস্তিনাপুরের নতুন প্রাসাদ, রাজসভার, বিবরণ আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের, কোথাও মন্দির নেই। যাকে তথাকথিত সনাতন ধর্ম বলা হয়, সেখানে মন্দির নেই, ছিল না। কোনও দেবতার মন্দিরের কোনও উল্লেখ না আছে বেদে, না আছে কোনও উপনিষদে না আছে প্রাচীন পুরাণে। তাহলে পুজোটা কোথায় হত? বা পুজো কি আদৌ হত?
পুজোর দায়িত্ব ছিল ঋষি মুনিদের হাতে, তাঁরা স্থান নির্বাচন করতেন। রাজাকে পাশে রেখে ধর্ম নিয়ে এক রাজনীতিই তো ছিল সেটা। মন্দির ছিল না সনাতন ধর্মে, ছিল যজ্ঞ, যজ্ঞবেদি তৈরি হত যজ্ঞের প্রকারভেদে। বহু পরে সেই সনাতন ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরি হয়েছে, বৈদিক দেবতাদের সঙ্গে জুড়ে গেছে লোকায়ত রীতি আর তাদের দেবতারা। মনসা থেকে টুসু, ভাদু থেকে শনি, এমনকী শিবের আড়ালে পশুপতি। কিন্তু তখনও ছিল না নিত্যপুজো, ছিল বেদ পাঠ, ছিল সাম গান। এরপর গোষ্ঠীপতিরা রাজা হলেন, রাজা হলেন মহারাজা। তাঁদের পূজ্য দেবতারাই রাজ্যের দেবতা, রাজ্যের মানুষের পূজ্য দেবতা। রাজা বৈষ্ণব, কাজেই শাক্ত বা শৈবদের হয় মত বদলাতে হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে বৈষ্ণব রীতিনীতি, না হলে দেশ ছাড়তে হয়েছে, জেলে পচে মরতে হয়েছে, শূলে চড়ানো হয়েছে। আবার শৈব রাজা এসে ধ্বংস করেছে বৈষ্ণব আখড়া তেমন উদাহরণও আছে। শৈব রাজা বুদ্ধ মঠ, জৈন মঠ ভেঙে চুরমার করেছেন এবং এসব হয়েছে মোগল, তাতার, শক হুনদের আসার অনেক আগেই। এই রাজারাই মন্দির তৈরি করলেন, সেই মন্দিরের গায়ে লেখা হল রাজার কীর্তি, পাথর খুদে বানানো হল ভাস্কর্য, যা সেই রাজার মহান কীর্তিকে তুলে ধরবে পুজো দিতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে। সেখানেই জমা হবে অতুল সম্পদ, সে সম্পদের অছি পুরোহিত ব্রাহ্মণরা শুরু করলেন নিত্যপুজো। সনাতন ধর্ম সিন্ধু নদ অববাহিকার নীচের ভূমিতে জন্ম দিল কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা, জন্ম দিল প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের। দক্ষিণের রাজারা পাথর কেটে মন্দির বানানোয় উৎসাহ দিলেন, সারা দাক্ষিণাত্য জুড়ে সেই মন্দিরগুলো আসলে চালুক্য, গঙ্গা, পল্লব, চোল রাজাদের রাজনৈতিক কেন্দ্র, সেখানেই তাদের বীরত্ব আর শৌর্যের গাথা। যে যখন ক্ষমতায় এসেছেন, সে তখন অন্যেরটা ভেঙে নিজের জয়গাথা লিখিয়েছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বদলে যাচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, আমাদেরও বদলাতে হবে?
উত্তরে তখনও কাঠ আর মাটি, কাজেই মন্দির নির্মাণ হলেও তা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সেই চালুক্যরা যখন হর্ষবর্ধনকে হারিয়ে উত্তর ভারতেও এলেন, তখন তাদের আনা কারিগরেরাই তৈরি করল উত্তর ভারতের বিভিন্ন মন্দির, আজ যে কেদারনাথের মন্দিরে আমরা যাই, সে মন্দিরের মূখ্য পূজারী কর্নাটকের বীরশৈব কমিউনিটির, মন্দিরের গঠন দক্ষিণের রীতি মেনেই তৈরি। যজ্ঞেশ্বর বা বাগেশ্বরেও শিব মন্দির, তাও ওই একই ধারায় তৈরি। এরপর থেকে উত্তরভারতেও মন্দির তৈরি শুরু হয়, আকারে খানিক বদলও আসে। প্রতিহার বংশের রাজারা সোমেশ্বর নামের এক জায়গায় তীর্থক্ষেত্রে দান ধ্যান করতেন, চালুক্যরা দাক্ষিণাত্য থেকে এসে সেই প্রতিহারদের হারায়। ওই সোমেশ্বরেই তৈরি করে সোমনাথ মন্দির, আবার সেই বীরগাথা এবং এক বিশাল ধনসম্ভার। বার বার সেই মন্দির ভাঙা হয়েছে, লুঠ হয়েছে ধনরত্ন, মহম্মদ গজনির সময়ে একবার নয় বেশ কয়েকবার এই লুঠপাট চলে। মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসের এক আঁকা ছবি পাওয়া যায়, যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মন্দির ছিল দাক্ষিণাত্যের মন্দিরের মতোই। কিন্তু সেই ধ্বংসের উপর স্বাধীনতার পরে বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগে নতুন মন্দির তৈরি হয়, সেই সময় একটা বিতর্ক হয়, মন্দির কি রাষ্ট্রের পয়সায় হবে? গান্ধীজি আপত্তি করেন, মন্দিরের জন্য টাকা আসে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে, মন্দির তৈরি হয়, একেবারেই উত্তর ভারতীয় ধাঁচের, সে মন্দির তৈরির উদ্যোগে ছিলেন সেই সময়ে নেহরু মন্ত্রিসভার খাদ্য ও খাদ্য সরবরাহ দফতরের মন্ত্রী কে এম মুন্সি, বল্লভভাই প্যাটেল এবং মহাত্মা গান্ধী। প্যাটেল গান্ধী দুজনেই মারা যান, মন্দির উদ্বোধনে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। এ নিয়ে নেহরুর আপত্তি ছিল, কিন্তু রাজেন্দ্র প্রসাদ বা কে এম মুন্সি তাঁর আপত্তি শোনেননি।
অর্থাৎ এখানেও দেখুন মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে থাকে রাজনীতি। আওরঙ্গজেবের ইতিহাস বলছে, তিনি কামাখ্যা মন্দিরের জমি দান করেছিলেন, মন্দির নির্মাণের খরচ জুগিয়েছিলেন, কেন? আওরঙ্গজেব সেকুলার ছিলেন বলে? আসলে তাঁর সময়ে এক বিরাট প্রতিরোধ আসতে শুরু করেছিল ওই উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে, অসম থেকে, তিনি সেই বিদ্রোহ দমন করেন। তারপরেই সাহায্যকারী ব্রাহ্মণ মন্ত্রণাদাতাদের খুশি করার জন্যই এই দান করেছিলেন, সেটাও ছিল মন্দিরের রাজনীতি, কখনও মন্দির ভেঙে রাজনীতি, কখনও মন্দির গড়ে রাজনীতি। ইংরেজরা এসেছে, শুরুর দিকে নয়, কিন্তু ১৯০০-র গোড়া থেকেই ইংরেজ শাসকরাও এই ধর্ম আর উপাসনালয়কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। ১৯০৫-এ বাংলা ভাগের ঘোষণা ছিল সেই রাজনীতিরই অঙ্গ। দেশ স্বাধীন হল, এরপর যতদিন গেছে তত বেশি করে মন্দিরের রাজনীতি সামনে ফিরে এসেছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছিল অজস্র। যেমন মঠ ভেঙে মন্দির হয়েছিল, মসজিদ ভেঙেও মন্দির হয়েছিল, কিন্তু আগে সে সবই তো ছিল রাজা, নবাব, সম্রাট, সুলতানের রাজনীতি, মন্দিরকে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে, তাঁদের বীরগাথার বিজ্ঞাপন করতে। আজ আরএসএস–বিজেপির রাজনীতির ভিত্তিই হল ওই মন্দির এবং তাদের হিন্দু ধর্ম। ২০২৪-এর নির্বাচন যুদ্ধে জেতার জন্য মন্দিরের রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছেন তাঁরা।
আসলে এই ধর্ম আর মন্দিরের ইস্যু কেড়ে নিলে আরএসএস–বিজেপির হাতে পেনসিলও পড়ে থাকবে না। কিন্তু তারও আগে যে সংশয় তার দ্বিতীয় কারণ দাক্ষিণাত্য। দক্ষিণের দরজাতে ঘা দিতে দিতে দিতে কর্নাটকে খানিক জায়গা পেয়েছিল বিজেপি, সেটাও গেছে। ১২৮টা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল কর্নাটকে ২৫ আর তেলঙ্গানাতে ৪টে আসন। এবারে সেখানেও ১২-১৪টা কমবে। বিহার, মহারাষ্ট্রে ২২-২৩ টা কমবে, বাংলাতে ৯-১০টা কমবে। আমার হিসেব নয়, বিজেপির নির্বাচন সেলের খবর। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আছে দিল্লিতে আপ-কং জোটের খবর। গুজরাতে আপ-কং জোট হচ্ছে, বাংলায় কং-তৃণমূল জোটের খবর। এবং তিন নম্বর সমস্যা হচ্ছে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা বাড়ানোর মতো কোনও জায়গাই নেই, বাকি রাজ্য মানে গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে তারা সর্বোচ্চ সংখ্যাতেই আছে, তা আর বাড়ানো সম্ভব নয়। আর যদি সেটাই হয় তাহলে বিজেপির ৫০টা মতন আসন কমবে, মানে ২৫০-২৫৫টা আসনে আটকে যাবে বিজেপি। সেটা হলেই বিরাট সমস্যা, মোদি ম্যাজিক ভ্যানিশ হলেই দলের মধ্যেই নতুন চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হবে। কাজেই এত কিছু করার পরে মন্দির, কেবল মন্দিরই বিজেপি ২৭২ পার করাতে পারবে না।