কলকাতা: মাত্র দু’বছরের ফারাক। এর মধ্যেই কত জল গড়িয়ে গেল রাজ্য বিজেপি-র অন্দরে (Bengal BJP)। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন পেয়ে যে বিজেপি ২০২১ সালে বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্ন তো ভেঙে চুরমার হয়েছেই (what next in BJP Bengal)। এই মুহূর্তে রাজ্য বিজেপি-র সংগঠনের যা হাল, তাতে বিজেপি ক’টুকরো হয়ে যাবে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে (Future of BJP in bengal)।
বিজেপি-র ভিতরের খবর, যত কাণ্ড সুকান্ত মজুমদারকে (sukanta majumdar) নিয়েই। বস্তুত, দিলীপ ঘোষকে (Dilip Ghosh) সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে রাজ্য সভাপতি করার পর থেকেই রাজ্য বিজেপিতে মুষলপর্ব শুরু হয়েছে। বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় (kailash vijayvargiya)-সহ একাংশের ইচ্ছায় তৃণমূল ভাঙানোর খেলা শুরু হয়েছিল দলে। তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক সে সময় বিজেপি-র গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ওইসব নেতার উপস্থিতিতে। সে্ই দলে কে না ছিলেন! মুকুল রায় থেকে শুরু করে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী-সহ তাবড় তৃণমূল নেতাকে দলে ভিড়িয়ে কৈলাসরা রাজ্য জয়ের অলীক স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুভেন্দু (Suvendu Adhikari) ছাড়া আর কেউই বিজেপিতে টিকতে পারেননি। সকলেই আবার তৃণমূলে ফিরে গিয়েছেন।
এই অবস্থায় দিলীপ ঘোষ সভাপতি থাকাকালীনই বিজেপি-র বিজয়রথ বিধানসভা ভোটে থেমে যায় মাত্র ৭৬টি আসন পেয়ে। তার পর থেকে অনবরত চলছে বিজেপি ছাড়ার হিড়িক। বেশ কয়েক জন বিধায়ক বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। মুকুল রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এর থেকেও বড় কথা হল, বিজেপি-র অন্দরের ভাঙন। সুকান্ত মজুমদারকে সভাপতি করার পর থেকেই দলে সমানে ভাঙন চলছে। তিনি নতুন রাজ্য কমিটির এবং দলের অন্যান্য শাখা সংগঠনের কমিটি ঘোষণার পর বিজেপি-র ভিতরকার ক্ষোভ বিষাক্ত ফোঁড়ার মতো ফেটে বেরিয়েছে। একাধিক নেতা-বিধায়ক দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কমিটিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধিত্ব না-থাকায়, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া-সহ বেশ কয়েক’টি জেলার বিজেপি-র মতুয়া নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে। বনগাঁর সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি সরাসরি দলের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করেছেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, এ ব্যাপারে যত দূর যেতে হয়, যাব।
আরও পড়ুন: Bengal BJP: বাইরে থেকে নেতা এনে রাজ্য বিজেপিকে দুর্বল করার চক্রান্ত হয়েছে, মুখ খুললেন জয়প্রকাশ
সম্প্রতি দলের বিক্ষুব্ধ নেতারা নিয়মিত শান্তনু ঠাকুরের (shantanu thakur) সঙ্গে বৈঠকও করছেন। শান্তনুও দাবি করছেন, এ ধরনের বৈঠক তিনি লাগাতার চালিয়ে যাবেন। দরকার হলে জেলায় জেলায় বিক্ষুব্ধদের সঙ্ঘবদ্ধ করার দায়িত্ব নেবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর ভাই বিজেপি-র আর এক বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর মতুয়াদের নিয়ে দিল্লিতে দরবার করবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। শান্তনুদের একটাই দাবি, অবিলম্বে সিএএ কার্যকর করতে হবে। নাগরিকত্বই ছিল মতুয়াদের দীর্ঘদিনের দাবি। সেই ২০১৪ সাল থেকে মতুয়াদের নাগরিকত্বের ইস্যুতে নানা বিতর্ক চলছে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার আইন আনে লোকসভায়। বিধানসভা ভোটের আগেও অমিত শাহ-সহ বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা সিএএ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সিএএ চালু হয়ে যাবে। এখনও কেন তা চালু হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে মতুয়াদের আবেগকে উস্কে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। তিনি আবার মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতিও বটে।
নাগরিকত্বের ইস্যুতেই মতুয়াদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি-র রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বেশ কয়েক’টি জেলায় ভোটের নিরিখে মতুয়ারা একটা বড় ফ্যাক্টর। বিধানসভা ভোটে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়ার একাধিক আসনে বিজেপি জিতেছে এই মতুয়া আবেগের উপর ভর করেই। দলের সাম্প্রতিক কোন্দলের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও দাবি করেছেন, মতুয়ারা বিজেপি-র সঙ্গেই ছিল, আছে, থাকবে।
আরও পড়ুন: BJP Bengal: শো-কজের দ্রুত জবাব চাইছি, জয়প্রকাশ-রীতেশকে হুশিয়ারি সুকান্তর
এরই মধ্যে দলের দুই রাজ্য নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার এবং রীতেশ তিওয়ারিকে রাজ্য বিজেপি সাসপেন্ড করেছে। তা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবারই আনুষ্ঠানিক ভাবে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে জয়প্রকাশ ও রীতেশ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। একাধিক বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছেন তাঁরা নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে।
সব মিলিয়ে বিজেপি-র গৃহযুদ্ধ একেবারে তুঙ্গে উঠেছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আর দু’বছর বাকি। তার মধ্যে দলের এই গৃহযুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। যদিও এখন পর্যন্ত বিজেপি-র কোনও কেন্দ্রীয় নেতা রাজ্য বিজেপি-র অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে মুখ খোলেননি। পাঁচ রাজ্যের ভোটের অজুহাতে তাঁরা নীরব। যতদিনে তাঁরা সরব হবেন, তত দিনে রাজ্য বিজেপি-র হাল কী হবে, সেটাই দেখার।