পথের ধারে বসে চোখের জল মুছছিলেন মহিলা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় লেপা সিঁদুর। তখনও সকালের কুয়াশা কাটেনি। রাস্তার ধারে ফসলের ক্ষেত। কচি ফুলকপির উপর হালকা শিশির। মহিলার পাশে বসে আরও কয়েকজন। তাঁদের সামনে খোল-করতাল। সবাই বিড়ি ফুঁকছিলেন। আর বিড়বিড় করছিলেন। একজন বলছিলেন, ‘ও নিতাইদা, বাড়ি যাবা না? কতক্ষণ থেবড়ি বসি থাকবা।’ নিতাই বলল, ‘না আজ আর যাবনি। বাড়ি গেলে খাব কী? পালা জমলে শ’তিনেক আসত। কিন্তু সে আর হলনি?’
ওঁরা সবাই পালাকীর্তন গায়ক। এক মাতব্বর গোছের লোকের বাড়িতে পালাকীর্তনের আসর ছিল। সেখানেই বায়না ছিল ওঁদের। কিন্তু আসতে একটু দেরি হয়েছে বলে গৃহকর্তা ওঁদের বায়না ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দেরি হল কেন? নিতাই আঙুল তুললেন মহিলার দিকে। তিনি তখনও কাঁদছেন। মহিলার স্বামীর রাতে স্ট্রোক হয়েছে। সারারাত হাসপাতালে স্বামীর শিয়রে বসেছিলেন। ভোর হতে কীর্তন গাইতে বেরিয়ে পড়েছেন। ট্রেন লেট ছিল। তাই আসতে দেরি। তাই শীতের প্রথম বায়না বাতিল। ওঁরা বসে আছেন পঞ্চায়েত আপিসের সামনে। কখন প্রধান আসবেন? তাঁরা জানতে চাইবেন, কেন বাতিল হল শীতের প্রথম বায়না? সে বছর শীত এসেছিল অশ্রুত পালাকীর্তনের হাত ধরে। খোলে চাঁটি পড়েনি। করতালও বাজেনি। তবু শীত এসেছিল।
শীত কত যে বিচিত্র পথে আসে!
এ বছর এখনও তেমন শীত পড়েনি। শীতে ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, এসব অনাছিষ্টির কথা কে কবে শুনেছে! অথচ এসবই চলছে পালা করে। ভাস্কর চক্রবর্তীর প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া লাইনটি হাহাকারের মতো বাজছে, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?
আমরা গাঁয়ের লোক। শীত আসে বিচিত্র অনুষঙ্গ ধরে। একবার শীত আসার আগেই খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধেছিল গাঁয়ের পালান হালদার। একদিন পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে উঠেছে পালান। নীচে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিকা ফুলটুসি। সে সকালে ঘুঁটে দিতে বেরিয়েছিল। পালানকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে। পালান গাছে উঠেছে বটে, কিন্তু রস কই! দু’একটা পোকা পড়ে আছে হাঁড়ির নীচে। পালান হাঁড়ি নামাতেই এগিয়ে এল ফুলটুসি। সে মুখ নামিয়ে রস দেখতে গেল। পালান তখন হাঁড়িটা ফুলটুসির গলায় ঝুলিয়ে নাচতে লাগল। সে বলছে, রস নেই, রস নেই, তবু কত রস! রাগে ফুলটুসির বুক উঠছে-নামছে। চৌদিকে কুয়াশা। তার মধ্যেই ঘুঁটেকুড়ানির বুক দুলছে। আর রসখ্যাপা পালান তাকে ঘিরে নেচে চলেছে। সে বছর শীত এসেছিল অনেক পরে। পালান-ফুলটুসি তার পর কী করেছিল জানা নেই ।
মুলুকে শীত আসত ক্রিকেটের হাত ধরেও। শীত আসতে দেরি হলে সুপর্ণাকে নয়, গাভাসকারকে বলতাম, ইডেনের তৃতীয় টেস্ট কবে আসবে সুনীলবাবু? প্যাভিলিয়নের দিক ছেড়ে গাভাসকার আসতেন জীবনানন্দের বাড়ির দিক থেকে, যেখানে ‘যে-নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে আমার শরীরে।’
তখন শীত আসত কবেকার পুরোনো এক কাঁথার হাত ধরে। তোরঙ্গ থেকে কাঁথা বেরোলে অদ্ভুত এক গন্ধ। কালো তুষের চাদর ও কাঁথা যখন মেলা থাকত উঠোনে, ঝলমল করত রোদ। কে যেন গরম রুটিতে নতুন গুড় মাখিয়ে ছুটে যেত দিগন্তের দিকে।
তখন পরিযায়ীর পাখনায় রোদ লাগত, ফুলটুসির বুকের দিকে থম মেরে তাকিয়ে থাকত পালান, বায়না বাতিলের পর সেই মহিলা রাস্তার ধারেই গেয়ে উঠত নতুন বাঁধা কোনও পালাকীর্তন।
অঘ্রানের কুয়াশায় শীতের কত যে শব্দ!
শীত এল না। কিন্তু কুয়াশায় ছারখার হয়ে গেল সেনানায়কের বাহন। আগুন জ্বলল। আহত পাখির মতো উপর থেকে মুখ থুবড়ে পড়লেন সেনানায়ক। শীত নেই।
কিন্তু নক্ষত্রের শীত নিশ্চয় লাগছিল তাঁর শরীরে।