ইংরেজ ক্রিকেটমাঠগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভারতীয় উপনিবেশ ওভাল আর এজবাস্টন। এক একসময় গুলিয়ে যেতে বাধ্য ওয়াংখেড়ে ? ইডেন ? নাকি দেশের বৃহত্তম মোতেরা ?
তা এদিন ওয়ার্নারের উইকেট পড়া মাত্র বিরাট কোহলি হাত তুলে তাতাতে শুরু করলেন এমনিতেই আবেগে উচ্চকিত ডগলাস জার্ডিনের মাঠকে। জাগো। চিৎকার করো। চাপ দাও মালদুটোর ওপর। কেনিংটন ওভালের ডেসিবেল এমন জাগল যে গ্যালারিতে থাকা বন্ধুর সঙ্গে সেই চিলচিৎকারে ফোনে কথা বলা যাচ্ছিল না। বডিলাইনের আবিষ্কর্তা যথেষ্ট অভ্যস্ত ছিলেন এজাতীয় দর্শক ব্যারাকিংয়ের সঙ্গে। বিশ্বাস করতেন ক্রিকেট মোটেও সখী সখী বিনোদন নয় –যুদ্ধ। বেঁচে থাকলে কোহলির ট্যাকটিকস অবধারিত সমাদর করতেন।
ক্রিকেট ট্যাকটিকসের জন্মদাতা জার্ডিনের কোনো স্মৃতি-সরঞ্জাম ওভালের বিখ্যাত জাদুঘরে যে নেই আশ্চর্য নয়। মাত্র ৫৭ বছরে তাঁর অকালমৃত্যুর পর শোকাহত স্ত্রী সব পুড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু তুমুল আশ্চর্য লাগল টি-র পর হাডলে টিমের উদ্দেশে কোহলি বক্তব্য রাখছেন দেখে । এমন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ক্যাপ্টেনের কথা বলা উচিত। কিন্তু কোহলির মতো ন্যাচারাল লিডার ততক্ষণে অধিনায়কত্ব নিয়ে নিয়েছেন। এবং তাতে কোনো ভারত সমর্থকের উত্তেজিত অভিযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।
শুক্রবার ক্রিকেট -রূপকথার বইয়ের পাতা নয় ,তার স্ক্রিন কভার দেখা দিয়েই টেস্টকে এমন জীবন্ত করে দিয়েছে যে মনে হচ্ছে হ্যাঁ আর যাই হোক ফাইনাল হচ্ছে না । নাটক আর তার পেটে পরপর রোমাঞ্চের ভিডিও ক্লিপ সমেত অনুষ্ঠিত হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটের প্রকৃত বিশ্বফাইনাল। অজিঙ্ক রাহানে তো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ হাজার রান পূর্ণ করার পথে ৮৯ করবেন তার মধ্যে নতুন রোমাঞ্চ নেই। কে জানত তাঁর ব্যাটিং সঙ্গী হয়ে শার্দুল ঠাকুর এমন জমিয়ে দেবেন ডব্লিউটিসি ফাইনাল যে রুগ্ন বেশ ঝেড়ে সে এখন মহা ফাইনাল। ইয়েস এই পরিস্থিতিতে মহা ফাইনাল — উপযুক্ত হ্যাশট্যাগ।
ইফ উইন্টার কামস ক্যান স্প্রিং বী ফার বিহাইন্ড ? যদি শীত আসে বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে ?
ওভাল উইকেট যদি তিনদিন ধরে আবেগের এমন নাগরদোলার চক্করে শেক্সপিয়ারী গ্রীষ্মের দুপুরকে ফিরিয়ে আনে , তাহলে মাঠের বাইরে কী করে নির্বিকার ,রংহীন আর ঢ্যাবঢেবে থাকে ?
রবি শাস্ত্রী আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় একটা ছোট ঘরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে টানা তিনদিন হিন্দি কমেন্ট্রি করছেন। এর চেয়ে চমকপ্রদ কিছু সাম্প্রতিক ভারতীয় ক্রিকেটে ঘটেছে বলে মনে হয় না। আংকর –যাকে কমেন্ট্রি অভিযানে বলে ‘লিড ‘সেই দীপ দাশগুপ্ত চমৎকারভাবে হাইফেনের কাজটা করে দিচ্ছেন বলে প্রাথমিক শৈত্য পেরিয়ে দুজনেরই সেরাটা বেরিয়ে আসছে। এমনিতে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা তিন ভাষ্যকার তর্কাতীতভাবে গাভাস্কার ,শাস্ত্রী ও সৌরভ। ক্রিকেট ধারাভাষ্যের লতা -আশা -কিশোর।
এর মধ্যে শাস্ত্রী এবার যেন এংরি ইয়ং ম্যান হয়ে এসেছেন। বেশ কিছু বছর ভারতীয় ক্রিকেট ধারাভাষ্যের কণ্ঠস্বর তিনি। বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে ধারবাহিকভাবে চমৎকার সম্পর্ক। সেই লোক সকালে ম্যাচের আগে রাগতভাবে তীব্র আক্রমণ করলেন আইপিএল ফ্রাঞ্চাইজিদের আধিপত্যকে। বললেন “টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালকে গুরুত্ব দিতে হলে বোর্ডকে প্লেয়ারদের চুক্তিতে ক্লজ ঢোকাতে হবে যে দেশের হয়ে খেলা থাকলে আইপিএলকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। যদি আমরা নিজেরাই বলতে থাকি যে সেটা কী করে করবো তাহলে এগোনো যাবে না। কিন্তু যদি মনে হয় দেশের আগে কখনও কিছু নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি নয়। তাহলে ক্লজটা ঢোকাতেই হবে। “
বোঝা গেল আইপিএলই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের শোচনীয় অবস্থার ঘাতক –এই মতবাদের তিনি সরব সমর্থক। মনে করেন বোর্ড যথেষ্ট কড়া নয় আর সেটা বলছেন কিনা বোর্ডের ঘেরাটোপে থাকা ব্রডকাস্টিং চ্যানেলে। শাস্ত্রীর হল-টা কীর ঘোর কাটতে না কাটতে কাউকে বিস্মিত না করে কে এস ভরত আউট হয়ে গেলেন। এরপরের স্ক্রিপ্টটা মনমোহন দেশাইয়ের লস্ট এন্ড ফাউন্ড থিমের মতোই সহজ। সিনেমার
শেষদিকে তিন ভাই একে অপরকে খুঁজে পাবে। এখানে যেমন। দ্রুত ভেঙে পড়ে ফলো অন করবে ভারত। তারপর শনিবারেই গল্প শেষ। দশ ইনিংসে রোহিতরা আসবেন-যাবেন। ভারত থেকে আসা যাঁরা রোববারের টিকিট কেটে রেখেছিলেন একমাত্র তাঁদের সমস্যা। ওভালের বদলে লন্ডন আই , ম্যাডাম তুসো বা ২২১ বি বেকার স্ট্রিট পর্যটনে সময় কাটাতে হবে।
ঠিক এখানেই কাহানি মে টুইস্ট। রাহানে-শার্দুল জুটি এমন কঠিন সারফেসে যে ১১০ রান যোগ করবেন। লাঞ্চের আগে এক ওভারও মেডেন পাবে না অস্ট্রেলিয়া কে জানত ? কে জানত তিনটে ক্যাচ ফেলবে ব্যাগি গ্রিন ক্যাচিং কর্ডন ? প্যাট কামিন্স কাল আর আজ মিলে দুটো উইকেট নেবেন আর দুটোই কিনা নাকচ হয়ে যাবে নো বলে। অস্ট্রেলিয়া কাপ ফাইনালে তিনটে ক্যাচ ছাড়ছে। ওভাল ট্র্যাক চরিত্র বদলে পুরোনো পারথের মতো ভয়ঙ্কর দেখাবে কে ভেবেছিল ? কে জানত ,গত পরশুর দুই সংহারক স্টিভ স্মিথ আর ট্র্যাভিস হেডকে ফিরিয়ে জাদেজা আবার নতুন উত্তেজনা আপলোড করে দেবেন ম্যাচের ওপর ? কে কল্পনা করেছিল শরীরে এতবার চোট পেয়েও মোহিন্দর অমরনাথের মতো অসমসাহসী উত্থান দেখবেন শার্দুল ?
গোটা দিন এমন ওঠাপড়ায় ভরা সংঘাত যে ক্যামেরুন গ্রিনের ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনাই হল না। অথচ রাহানের ওই ক্যাচ ডান হাতে উড়ে গিয়ে ধরতে পারলে সামান্য ক্রিকেট জানা নাদিয়া কোমানেচি-ও গর্বিত হতেন।
প্রথমের ১৭৩ মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া ৩২৫-৩৫০ রানের টার্গেট রাখবে নিশ্চিন্তে ধরে নেওয়া যায়। কোনো কিছুই হয়তো আর মহাফাইনালে অসম্ভব নয়। ফোর্থ ইনিংসের সেই টার্গেট যতই আপাত অসম্ভব দেখাক। শতাব্দী প্রাচীন ওভালে ২৬৩ র বেশি রান তাড়া করে আজ পর্যন্ত কেউ জেতেনি। কিন্তু ইতিহাস হয়নি বলে হবেনা কেন ? অঘটনের অন্তত ঝলক না পাওয়া গেলে আর মহাফাইনাল কেন ?
কী বলেন ?