আধুনিক রাষ্ট্রের আইন এমনকী বিদেশির বিচারও একই আইনে করে থাকে, এটাই সভ্যতা। আর সেই আধুনিক আইন ব্যবস্থাই বিচারের প্রথম কথাটা বলে দিয়েছে, সুবিচারের প্রথম সুরটা বেঁধে দিয়েছে, তা হল, বিচারব্যবস্থার কাজ হল বিচার করা, অভিযোগ যিনি করেছেন, তাঁকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ হাজির করতে হবে আর সেই প্রমাণের আগে পর্যন্ত অভিযুক্ত বিচারাধীন, তিনি অপরাধী নন। যদি মনে করা হয় যে অপরাধী ছাড়া পেলে বিচার প্রভাবিত হবে, সাক্ষ্যপ্রমাণ মুছে ফেলতে পারে, অন্যান্য সাক্ষীদের প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে তাঁকে জেলে রেখেই বিচার করা হবে। কিন্তু সেই জেল হাজতে রাখারও এক সীমা থাকবে কারণ বেল পাওয়াটা, জামিন পাওয়াটা এক স্বাভাবিক ব্যাপার, খুব ব্যতিক্রমী ঘটনাতেই জামিন নাকচ করা হবে। সারা পৃথিবীর সভ্য দেশে এই আইন আছে। আমাদের দেশেও মূলত এই আইনি ব্যবস্থা মেনেই বিচার হত।
কিন্তু ২০১৮-তে মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে, আইনে কিছু সংশোধন আনা হল। ওই যে অপরাধ প্রমাণ করার দায় রাষ্ট্রের বা অভিযোগকারীর, সেটা বদলে ফেলা হল। বলা হল, অপরাধ করেননি, সেটা প্রমাণের দায় এখন অভিযুক্তের। এক হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রীর রাজত্বে আপাতত যে আইন বহাল তা হল ইডি আপনার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এনে দায়ের করবে, অমুকে বলেছে, অমুক কাগজ থেকে জানা গেছে যে আপনি কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করেছেন, অতএব আপনি দোষী, এবার আপনি প্রমাণ করুন যে আপনি দোষী নন। এবং আপনাকে জেলে পুরে দেওয়া হল, এবার জেলে বসে আপনি প্রমাণ করুন যে আপনি দোষী নন। মামলা চলছে তো চলছে, আইনের ধারা এমনই যে বিচারক জামিন দিতে পারছেন না, এদিকে একটি কাগজ বা একটি বয়ানের ভিত্তিতে একজন মানুষ জেল খেটেই যাচ্ছেন। ছাত্র জেলে, শিক্ষক জেলে, সমাজকর্মী থেকে সাংবাদিক থেকে ব্যবসায়ী জেলে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা জেলে। ছাড়া পাওয়ার শর্ত খুব সোজা, ঘাড় ঝোঁকাও, বিরোধিতা বন্ধ করো, বিনিময়ে জেল থেকে ছাড়া পাও। মোডাস অপারেন্ডি, মানে এই ইডি-সিবিআই ইত্যাদির কাজকর্মের ধরন খুব সোজা, ওপর থেকে হুকুম মেনেই বিরোধী নেতাদের টার্গেট করো, ডেকে পাঠাও, জেরা করো, মিডিয়াতে খবর দাও। তারপর এত টাকা আছে, এত সম্পদ আছে, ২০টা চালকল, ৩০০ কোটির ব্যাঙ্ক ডিপোজিট ইত্যাদির গল্প ছড়াও এবং মাথা নোয়ানোর প্রোপোজাল দাও। মাথা না নোয়ালে গ্রেফতার করো। এবং এই গ্রেফতারির পরে বেল নাকচ হবে, তারও পদ্ধতি বার করেছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব ৩৪)
৪ অক্টোবর জেলে পোরা হয়েছিল আপ-এর সাংসদ সঞ্জয় সিংকে, ২ এপ্রিল তাঁকে জামিন দেওয়া হল। কেন? কারণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের কাছে তেমন কোনও প্রমাণই হাজির করতে পারেননি ইডি অফিসারেরা, সঞ্জয় সিংয়ের জামিনের আবেদনের বিরুদ্ধে এমনকী ইডিও একটা কথা বলেনি। ৬ মাস জেলেই থাকলেন একজন সাংসদ। কেন? মণীশ সিসোদিয়া জেলে আছেন, একই মামলায়, এখনও পর্যন্ত একটা কাগজও নেই তাঁর বিরুদ্ধে, কেবল কিছু মানুষের বয়ান আছে, কিন্তু তিনি জেলে। নতুন করে জেলে পোরা হল অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী, নির্বাচনের আগে সমস্ত নীতি নৈতিকতাকে তাকে রেখে একজন অন্যতম বিরোধী নেতাকে জেলে পুরে নির্বাচন পার করার কথা ভাবছে বিজেপি। ফ্যাসিস্টরা প্রশ্ন শুনতে পছন্দ করে না। মোদিজিও পছন্দ করেন না তাই সাংবাদিক, সংবাদকর্মীরা জেলে, আমাদের সম্পাদক কৌস্তুভ রায়ও জেলে। সারা দেশে ২০০-র বেশি বিভিন্ন আঞ্চলিক কাগজ বা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক, সম্পাদক, মালিকের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা চলছে। এবং খুব লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মেসেজ, মাথাটা ঝোঁকাও, মামলা উঠে যাবে, পক্ষে থাকলে লাড্ডুও পাবে। আমাদের সম্পাদক মাথা ঝোঁকাননি, লাডডুও খাননি, তিনি জেলে, জামিনের জন্য আইনি লড়াই চলছে। কতদিন রাখা হবে জেলে? কতদিন জামিন না দিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হবে? জানা নেই। কিন্তু একটা কথা জানা আছে, স্বৈরাচারের পতন অনিবার্য। রাহত ইন্দোরির ভাষায়, জো আজ সাহিবে মসনদ হ্যায়, কল নহি হোঙ্গে, জো আজ সাহিবে মসনদ হ্যায়, কল নহি হোঙ্গে, কিরায়েদার হ্যায়, জাতি মকান থোড়ি হ্যায়। সিংহাসনে যিনি বসে আছেন, কাল থাকবেন না, উনি ভাড়াটে, বাড়িওলা তো নন।
দেখুন ভিডিও: