‘পিয়া তু অব তো আজা, শোলা সা মন দহকে আকে বুঝা যা। তন কি জ্বালা ঠন্ডি হো জায়ে, অ্যায়সে গলে লগা যা।’ হ্যাঁ, সেই আশা ভোঁসলে, যাঁর গানের জাদুতে ৮ দশকেরও বেশি ভারতের কিশোর-যুব সমাজ নেচেছে, দুলেছে, নেশার দমে বুঁদ হয়ে জীবনের গম বা দুঃখ ভুলে থেকেছে। আজীবন দুঃখ, কষ্ট-যন্ত্রণা, অপমান সহ্য করেও সব ভুলে গানের সাধনায় হাসিমুখে জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন। সেই কিংবদন্তি শিল্পী আগামিকাল, ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর ৯০-তম জন্মদিন কাটাতে চলে গিয়েছেন দেশের মাটি ছেড়ে সুদূর দুবাইতে।
গল্পটি আশা ভোঁসলে নিজেই শুনিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। তাঁর জন্মের ঠিক আগে স্রষ্টা বলেছিলেন, তোমাকে একটি সুসংবাদ এবং একটি দুঃসংবাদ দিয়ে পাঠাব। সুসংবাদটি হলো তুমি বিখ্যাত একটি সঙ্গীত পরিবারে জন্মাবে এবং গানে বহু দূর যাবে। আর দুঃসংবাদটি হল তোমার বড় বোনের জন্য ভারতের শ্রেষ্ঠ গায়িকার স্বীকৃতি তোলা থাকবে, তোমার সেখানে জায়গা হবে না! আজীবন এই দুঃখই বয়ে বেড়াতে হয়েছে পাশ্চাত্য থেকে শুরু করে কীর্তন, ভজন, গজল, রাগপ্রধান মায় রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি গাওয়া আশাকে। নিজেই বলতেন, আমার দিদি এত উপরে ছিলেন যে, আমার যেন কোনও কদরই ছিল না।
দূরদর্শনে সলিল চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশার অকপট স্বীকারোক্তি ছিল, তখনই বুঝেছিলাম, দিদি যেভাবে গায় সেভাবে গাইলে আমার গান চলবে না। তখন আমি পাশ্চাত্য গান শুনতে শুরু করি। তাদের কণ্ঠ বদলের ভঙ্গিমা শিখি কিন্তু তার মধ্যেই ভারতীয়করণের ছোঁয়া লাগাই। গল্প হলেও কথাটা নেহাত ভুল নয়। বছরের পর বছর ভারতীয় সিনেমা জগতে নারী কণ্ঠের তালিকায় সবার উপর ছিল দুটি নাম—লতা ও আশা। এত গান, এত এত সুর ও সুরকার, এত দীর্ঘ বছরে শ্রোতা পাল্টে গেছে, বদলে গেছে প্রজন্ম। কিন্তু তাঁদের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি।
লতা বিদায় নিয়েছেন। ৯০ পেরোনোর অপেক্ষায় থাকা আশা মুম্বই থেকে দুবাই পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে কাল এক বিরাট জলসায় পালন করবেন নিজের জন্মদিন। দুবাইয়ের কোকা কোলা এরিনায় ASHA@90 লাইভ ইন কনসার্টে গানে গানে জন্মদিন পালন করবেন শিল্পী।
দেশ ছেড়ে দুবাই যাওয়ার আগে গত ১ সেপ্টেম্বর ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও দিয়েছেন চিরযৌবনা আশা। কেডস পায়ে, বিদূষী সাজে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে ভিডিওতে মোবাইল গেম খেলেছেন। ক্যাপশনে লিখেছেন, যাচ্ছি। ৮ সেপ্টেম্বর দেখা হবে দুবাইতে। আমার জন্মদিনে। একই দিন আরেকটি ভিডিও দিয়ে লিখেছেন, আমার সাম্প্রতিক পেশা অনলাইন ভিডিও গেমিং!
মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সামলে নিতে লতা কঠিন সংগ্রাম করে তাঁর পথ তৈরি করে নিয়েছেন, আমৃত্যু সে পথে অবিচল ছিলেন। লতার মতো বোন আশার রক্তেও যেমন সঙ্গীত ছিল, তেমনি ছিল ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ এবং দ্রুত যে কোনও সুর আয়ত্তে আনার দক্ষতা। কৈশোর পেরোনোর আগেই সংসার করা, ঘুরে বেড়ানো—এসব খেয়ালেই ছিলেন মেতে। ১৩ বছর বয়সে ভুলটা করেই ফেললেন। গণপত ভোঁসলের হাত ধরে সংসার সাজানোর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা আজ নিজেই মানেন আশা। তবে গণপত ভোঁসলে নিজের অজান্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছিলেন। স্ত্রীকে রান্নাঘরে আটকে ফেলার বদলে তাঁকে গান গেয়ে রোজগারের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। আসলে আশার অদৃষ্টে যে গন্তব্য ছিল লেখা, সেখানেই তিনি পৌঁছালেন, তবে সরল–সহজ পথে নয়। অনেক ঘুর পথে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে।
স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের সুখের অন্বেষণ করতে গিয়ে আশাকে পড়তে হলো ঘর-বাইরের টানাপোড়েনে। তাঁর প্রতিদিনের রুটিনটা ছিল এমন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না, স্বামী-শাশুড়ির সেবা, সন্তান পালনের দায় মিটিয়ে লোকাল ট্রেনে চড়ে স্টুডিও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে দরবার। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে গল্প শুনিয়েছেন তিনি।
দিনেদিনে স্বামীর সঙ্গে মতভেদ এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিন যাঁর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলেন, অচিরে তাঁকেই ছাড়তে হলো। বাড়ির অমতে বিয়ে করার কারণে সেখানে ফেরার পথও বন্ধ। জীবন ও জীবিকার তাগিদে একাই শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। এ লড়াইয়ে অস্ত্র বলতে ছিল শুধু কণ্ঠস্বর, অদম্য জেদ এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস। চলচ্চিত্রের গানে পঞ্চাশের দশক লতাময়। আশা সেসব গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন, যেগুলো লতা গাইতে রাজি হতেন না। ছবিতে এসব গানে কণ্ঠ মেলাতেন শিশুশিল্পী অথবা নাইট ক্লাবের নর্তকী। গীতা দত্তর বদলি হিসেবেও কিছু গান গেয়েছেন আশা।
একসময় ও পি নাইয়ারের সুনজরে পড়লেন আশা। অল্প দিনেই গীতা দত্ত ও শামসাদ বেগমকে পেছনে ফেলে নাইয়ারের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠলেন তিনি। বৈজয়ন্তীমালার মতো নামী নায়িকার জন্য প্লেব্যাক করার সুযোগ পেলেন। এদিকে শচীন দেববর্মনের সঙ্গে লতার দূরত্ব ছিল বেশ কিছুদিন। সেই ‘সুযোগ’ কাজে লাগালেন আশা। অন্যদিকে রয়্যালটি-সংক্রান্ত ঝামেলায় ‘লতা-রফি ডুয়েট’ বন্ধ হল। লতার স্থানে এলেন আশা। শঙ্কর-জয়কিষণ জুটিরও দ্বিতীয় পছন্দের গায়িকা হয়ে গেলেন আশা। চটুল-চঞ্চল ধরনের গান, ক্যাবারে, কাওয়ালি চালের গানে প্রায় সব পরিচালকই নির্ভর হয়ে উঠলেন আশার প্রতি। এভাবে একটু একটু করে দিদির সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়লেন আশা।
৭৩ সালের দিকে আশার সঙ্গে ও পি নাইয়ারের মতবিরোধ হলো। তবে এর মধ্যে আশা পেয়ে গেছেন তাঁর পরবর্তী উত্থানের সিঁড়ি রাহুল দেববর্মনকে। রাহুল একে একে সুপারহিট গান তুলে দিয়েছেন আশার কণ্ঠে। আশা সেই গানের যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। গানের সূত্রেই মন দেওয়া–নেওয়া হয়েছিল পঞ্চম ও আশার।
এখনো প্রতিদিন রেওয়াজ করেন, সে কথা নিজেই জানিয়েছেন। তাঁর রেওয়াজের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। ঘুম না এলে মধ্যরাতেও তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ বসে যান। রেওয়াজে বসার আগে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে নেন। এক সাক্ষাৎকারে আশা বলেছিলেন, আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেই নারী হিসেবে, যে মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে, নিজে রান্না করেছে।
গুলজার একবার দুই বোনের তুলনা প্রসঙ্গে আশাকে বলেছিলেন, লতা ও তুমি দুজনেই চাঁদে গিয়েছ। কিন্তু লতা প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে বলে চিরকালই ১ নম্বর থেকে যাবে, তুমি থাকবে তার পরে। স্বামী, সন্তান হারানো আশার আফসোস, আমার সামনে সবাই এক এক করে চলে গিয়েছেন। আমি একা রয়ে গিয়েছি। শিল্পীর এই আফশোস কি ঠিক? আশাই তো গুলজারের কথায় ও আরডি-র সুরে শুনিয়ে গিয়েছেন জীবনের গান, ছোটি সি কাহানি সে, বারিশো কি পানি সে সারি ওয়াদে ভর গয়ি। না জানে কিঁউ দিল ভর গয়া, না জানে কিউ আঁখ ভর গয়ি।