নয়াদিল্লি: দেশের যে প্রান্তেই যান না কেন, তা সে শহর (City) হোক কিংবা নগর (Town), বা ছোট কোনও মফস্বল, পথের ধারে ভিক্ষুক (Beggars) চোখে পড়বেই। আর ধর্মীয় স্থলের (Religious Places) কাছে তো ভিক্ষুক চোখে পড়বেই পড়বে। পুণ্য অর্জনের জন্য হোক বা মানবিকতার খাতিরে, আমরা অনেকেই ভিক্ষা দিয়েও থাকি। সাধারণত সেই ছবিই আমাদের চোখে পড়ে। ওঁরা ভিক্ষাবৃত্তি করে ক্ষুধা মেটাতে। ভিক্ষাবৃত্তি (Begging) কিংবা ভিক্ষাদানে (Giving Alms) কারও জীবন বদলায় না। তাই এক সমাজকর্মী (Social Worker) ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন, ভিক্ষুকদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য। ভিক্ষা নয়, বরং ভিক্ষুকদের জন্য বিনিয়োগ (Investment) করেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, ওঁদের জীবনে পরিবর্তন আনা, ভিক্ষুক জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া।
ওড়িশার (Odisha) সমাজকর্মী চন্দ্র মিশ্রর (Chandra Mishra, Social Worker) এই অভিনব ধারণাই জন্ম দিয়েছে বেগার্স কর্পোরেশনের (Beggars Corporation)। আর তাঁর স্লোগান (Slogan) হল – দান করবেন না, বিনিয়োগ করুন (Don’t Donate, Invest)। তাঁর এই উদ্যোগ ১৪টি ভিক্ষুক পরিবারের জীবন বদলে দিয়েছে। শুধু কী তাই? যাঁরা যাঁরা এই বেগার্স কর্পোরেশনে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের টাকা ১৬.৫ শতাংশ সুদ সহ ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দিয়ে দিয়েছেন।
চন্দ্র মিশ্রর এই মহৎ ও অভিনব উদ্যোগের (Noble and Unique Initiative) কথা সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তিনি যখন গুজরাতে (Gujrat) ছিলেন, সেই সময় থেকেই ভিক্ষুকদের জীবন বদলানোর আইডিয়া (Life Changing Idea) প্রথম এসেছিল তাঁর মাখায়। মন্দিরে (Temples) সামনে ভিক্ষুকদের ভিক্ষা চাইতে দেখে তিনি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন, ওঁদের জীবন বদলাবেন, তাঁদের কাজ দেবেন এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ (Special Training) দেবেন।
বিভিন্ন রাজ্যে কর্মসংস্থান নীতি (Employment Policy) নিয়ে কাজ করার পর চন্দ্র মিশ্র বারাণসী (Varanasi) পৌঁছান ২০২০ সালে ৩১ ডিসেম্বর। প্রথমবার উদ্যোগ নিলেও, পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। বেনারসের স্থানীয় এনজিও (NGO) জনমিত্র ন্যায়সের (Janmitra Nyas) সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করে নিয়েছিলেন। তাদেরকে তিনি বলেছিলেন, তিনি কর্মসংস্থানের (Employment) সুযোগ দিয়ে ভিক্ষুকদের জীবন বদলাতে চান।
মহৎ উদ্দেশ্য, ওই এনজিও মিশ্র কথা শুনে রাজিও হয়ে যায় সাহায্য করতে। বারাণসীর বিভিন্ন ঘাট (Ghats) ঘুরে ঘুরে শুরু হয় সমীক্ষা (Survey)। ভিক্ষুকের অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁদের রাজি করানোটাও ছিল বড চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক অবস্থায় হাজার বোঝালেও কোনও ভিক্ষুকই তাঁর ডাকে সাড়া দেননি।
এরপর, ২০২১ সালে দেশে দ্বিতীয়বার কোভিড-১৯ লকডাউন (Covid – 19 Lockdown) শুরু হল। বহু ভিক্ষুক তাঁর কাছে এসেছিলেন সাহায্য চাইতে। আর এইভাবেই সে বছর অগাস্ট মাসে জন্ম নিল বেগার্স কর্পোরেশন। ভিক্ষুকদের জীবন বদলানোর চন্দ্র মিশ্রর কর্মসংস্থানমুখী অভিযানে (Campaign) প্রথম অংশগ্রহণকারী হলেন একজন মহিলা। বাচ্চা নিয়ে তিনি বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াতেন। স্বামী ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় আর কোথাও যাওয়ার ছিল না তাঁর। চন্দ্র মিশ্র তাঁকে ব্যাগ (Bag) তৈরির পরামর্শ দেন এবং তাঁকে সেই কাজও দেন।
শুরুটা ধীর গতিতে হলেও, থেমে থাকেনি। ওই মহিলার তৈরি করা ব্যাগ নিয়ে একটি সম্মেলনে (Conference) গিয়েছিলেন সমাজ কর্মী চন্দ্র। সেখানে ইতিবাচক সাড়াও মেলে। এরপর, আরও অনেক ভিক্ষুক বেগার্স কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হন। বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি (Reputed Person) চন্দ্র মিশ্রর এই অভিনব উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়েছেন।
২০২২ সালের অগাস্ট মাসে বদ্রীনাথ মিশ্র (Badrinath Mishra) এবং দেবেন্দ্র থাপাকে (Devendra Thapa) সঙ্গে চন্দ্র মিশর বেগার্স কর্পোরেশনকে ফর প্রফিট কোম্পানি (For Profit Company) হিসেবে নিবন্ধিত (Registered) করেন। আজ এই সেই বেগার্স কর্পোরেশন ১৪টি ভিক্ষুক পরিবারকে নিয়ে শিল্পোদ্যোগে (Entrepreneurs) পরিণত হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১২টি পরিবার ব্যাগ তৈরি করে এবং ২টি পরিবার মন্দির সামনে ফুল বিক্রি করে (Selling Flowers)।
উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, দরকার অর্থ। তার জন্যও আইডিয়া ছিল চন্দ্র মিশ্রর কাছে। ভিক্ষুকদের জীবন বদলানোর জন্য তিনি ১০ – ১০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এই অভিযানে ৫৭ জন যোগ দিয়েছিলেন দেড় মাসে। সংস্থায় প্রথম টাকা দিয়েছিলেন ছত্তিসগড়ের (Chhattisgarh) এক ইঞ্জিনিয়ার (Engineer)। অর্থ সংগ্রহ করে তহবিল (Fund) গড়ে তা খরচ করা হয় স্কিল-ট্রেনিং এবং কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসে। পাশাপাশি, চন্দ্র মিশ তাঁর কোম্পানি ইনভেটিভ স্টার্টআপস কম্পিটিশনের (Innovative Startups Competition) মঞ্চেও নিয়ে গিয়েছেন। এরপর, তাঁর বেগার্স কর্পোরেশন টপ ১৬ মাইন্ডফুল স্টার্টআপসে (Top 16 Mindful Startups) যোগ দিয়েছে।
চন্দ্র মিশ্রর বক্তব্য, ভিক্ষুকদের জীবন বদলানোর জন্য অনুদান নয়, তাঁরা লগ্নি চান। সেটা তাঁরা পেয়েছেন। আর যখন তা ফেরত দেওয়া সময় এসেছে, লগ্নিকারীদের তা ফেরতও দিয়ে দিয়েছেন সুদ সমেত। বিনিয়োগকারীদের লাভ হয়েছে। চন্দ্রের কথায়, “প্রতিটি ভিক্ষুক পিছু দেড় লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে ৫০,০০০ টাকা তিন মাসের স্কিল-ট্রেনিংয়ের জন্য লাগে। আর বাদবাকি টাকা লাগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যবসার প্রাথমিক পরিকাঠামো গড়ে দিতে।”
বেগার্স কর্পোরেশনের সাহায্যে স্কুল অব লাইফ (School of Life) নামে আরও একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন চন্দ্র। বারাণসীর বিভিন্ন ঘাটে যে বাচ্চারা শিব-হুনুমান (Shiv-Hanuman) সেজে ভিক্ষাবৃত্তি করে বিশেষত তাদের জন্যই এই উদ্যোগ। চন্দ্র মিশ্রর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্যোগ, কিন্তু তা যে এইভাবে বাস্তবায়িত করে মানুষের জীবন বদলানো যায় এবং সমাজসেবার মাধ্যমেও লাভজনক ব্যবসা (Profitable Business) গড়ে তোলা যায়, তা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। তবে মানুষের চন্দ্র মিশ্রর উদ্যোগে আস্থা দেখিয়ে লগ্নি করেছেন। হরিয়ানার গুরুগ্রামে (Gurugram, Haryana) চাইওম (ChaiOm) নামে চা কোম্পানি (Tea Company) চালানো পায়েল আগরওয়াল (Payal Aggarwal) বেগার্স কর্পোরেশন ব্যবসায়িক চুক্তি করেছেন। তিনি ৫ লক্ষ টাকা লগ্নি করবেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টি ক্যাফে (Tea Cafe) খুলবেন।