‘স্নেহের ঠাকুরঝি, তুমি আমার বিজয়ার শুভেচ্ছা নিও। ছেলেমেয়েদের শুভেচ্ছা দিও। ইতি বৌদি।’
‘বড়দি, বিজয়ার প্রণাম লইবা। কার্তিক, গণেশ, রুনু, ঝুনু কেমন আছে। ওদের আমার আশীর্বাদ দিও। বোম্বেতে নাকি খুব বৃষ্টি হইতেছে। সাবধানে থাকিও। জামাইবাবুকে আমার প্রণাম দিও। একবার পারলে কলকাতায় আসিও। বহু বছর তোমাদের দেখি না। আমার ছেলেমেয়েরা তো বড় মাসিকে দেখেই নাই। ভাইবোনদেরও ওরা চেনে না। ভালো থাকিও। ইতি লক্ষ্মী।’
আমার মায়ের চিঠি এগুলো। পিসিমা, বড় মাসি চিঠির জবাব দিলে সেই চিঠি অত্যন্ত যত্ন সহকারে স্থান পেত তোষকের তলায়। বছরের পর বছর সেই সব পোস্ট কার্ড কিংবা এনভেলপ বা ইনল্যান্ড লেটার তোষকের তলায় থাকতে থাকতে বিবর্ণ হয়ে যেত। লেখাগুলো সব ঝাপসা হয়ে যেত। আমার দাদা অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বিহারে চলে গিয়েছিল। মা দাদার চিঠির জন্য পোস্টম্যান সুকুমার দার অপেক্ষায় বসে থাকত। যেন দাদা রোজ চিঠি পাঠাবে। আর সুকুমার দা রোজ দাদার চিঠি পৌঁছে দেবে। কোনও কোনও বছর পুজোর সময় দাদা ছুটি পেত না। বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানোর জন্য দাদাকে চিঠি লিখতে লিখতে মাকে কাঁদতে দেখেছি। আবার দাদার জবাবি চিঠি এলেও মা পড়তে পড়তে কাঁদত। দেখে আমাদের ভাইবোনেদেরও চোখে জল এসে যেত। দাদার গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি সেই তোষকের তলায় বছরের পর বছর চাপা পরে থাকত। ফেলার কোনও জো ছিল না। বিছানার তলায় চিঠি জমিয়ে রাখার ধাত ছিল দাদু, ঠাকুমারও। দাদা, পিসিমনি, পিসিমার চিঠি কে আগে পড়বে, তা নিয়ে দাদু আর ঠাকুমার মধ্যে প্রায় হাতাহাতি হত। কী সব দিন ছিল।
আরও পড়ুন : চিঠি’র স্মৃতিকে ফিরিয়ে দিতে ডাক-থিমেই মাতৃবন্দনা
আজ আর কেউ চিঠি লেখে না। কোথায় হারিয়ে গেল পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, এনভেলপ। জানি না, পোস্টাপিসে এখন এসব পাওয়া যায় কি না। সেই সময় বড়দের পাল্লায় পরে আমাদের ভাইবোনেদেরও বিজয়া দশমীতে চিঠি লিখতে হত। বড়দের প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখতাম আমরা। আজ আমার আপনার বাড়ির ছোটদের চিঠি লেখার কথা বলাই যাবে না। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই ওরা বলবে, চিঠি? সে আবার কী?
আজকের দিনে ফেসবুক, হোয়াটসআপের যুগে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানো এক সেকেন্ডের ব্যাপার। হরেক রকমের ‘বিজয়ার শুভেচ্ছা’ মার্কা স্টিকার পাওয়া যায়। ফেসবুক, হোয়্যাটসআপে চিপকে দাও। খেল খতম। পারলে ভিডিও লোড করে দাও। চিঠি ফিঠির আবার কী দরকার? ও সবের দিন ফুরিয়েছে। জীবন এখন জেটের গতিতে চলছে।
আরও পড়ুন : বাড়ির পুজোয় ধুনুচি নাচে মাতলেন সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার
আগে ছিল যৌথ পরিবার। অনেক লোকের একটাই হাঁড়ি। বড়দের রোজগার ছিল কম। কিন্তু আন্তরিকতা ছিল অফুরন্ত। তাই বলে কি ভায়ে ভায়ে ঝগড়া হত না? জায়ে জায়ে মন কষাকষি হত না? নিশ্চয়ই হত। আবার সব মিটেও যেত। দশমীর আগে বাড়িতে নাড়ু, মোয়া বানানোর চল ছিল। বাড়ির মা, কাকিমা, ঠাকুমা রা দল বেঁধে বসে পড়ত গুড়ের পাক দিতে। দশমী যেতে না যেতেই লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতি হত ঘরে ঘরে। ছোটবেলায় বিজয়াতে বাড়ি বাড়ি যাওয়া ছিল রেওয়াজ। বড়দের পায়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম। তারপরে কাকিমা বা জেঠিমার আসার অপেক্ষায় থাকা। কতক্ষণে ভিতর থেকে তারা নাড়ু, নিমকি, মোয়া নিয়ে আসবেন। আজকাল সে সবও উঠে গেছে। একেবারে একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, এবারে আজ পর্যন্ত বিজয়া করতে কেউ কারও বাড়ি যায়নি। অবশ্য এর মধ্যে করোনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে করোনার আতঙ্ক না থাকলেও এটা বলাই যায়, সেই চলটা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে।
আগে ছিল যৌথ পরিবার। জেঠতুতো, খুড়তুতো , মামাতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা পুজোর সময় একত্রিত হয়ে হই চই হত। এখন স্কেলিটন পরিবার। তুতো ভাইবোনদের ছেলেমেয়েরা চেনে না। অদ্ভুত এক দুঃসময় এখন।
যাক। আবার পুরোনো কথায় ফিরে আসি। কথা হচ্ছিল চিঠি লেখা নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সে পাট উঠে গিয়েছে। যুগযুগ জিও ফেসবুক। তোমার জয় হোক। নাই বা থাকল চিঠি লেখা। কোন কালে কবি লিখেছিলেন, ফিরে এস চাকা। কবির মতো নাই বা বললাম, ফিরে এস চিঠি। এককালে বিজয়া দশমীর সঙ্গে চিঠির একটা আত্মিক যোগ ছিল। আজ আর নেই।