বাবা মায়ের স্নেহ মমতা ভালোবাসার কাছে আইন প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। বয়সন্ধিক্ষণে সন্তানসন্ততির সিদ্ধান্তে আইনের সহযোগিতায় ফলে বাবা-মা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না তাদের সন্তানকে। করোনা পরিস্থিতির আগে রবীন্দ্র সরোবর ও পার্কস্ট্রিট অঞ্চলের পরিবেশ দেখলেই তা পরিষ্কার। কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা চলাকালীন মন্তব্য বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের।
আরও পড়ুন : মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে…হেসে ফেললেন বিচারপতিও
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের এজলাসে আইনজীবী হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় আবেদন জানান, একটি নাবালিকা মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়েটিকে বিহার থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দেখা যায় নাবালিকা ওই মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে মেয়েটি জানায়, ওই ছেলেটির বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই। যদিও বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালবাসা ওই মেয়েটিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। তাই তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। বিচারপতি মেয়েটি নাবালিকা বলে এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তলব করেন পুলিশের কাছে। মামলার শেষে বিচারপতি বেশ কিছু মন্তব্যও করেন। বিচারপতির মন্তব্য, বর্তমান ঘটনায় সামাজিক চিত্রের প্রেক্ষাপট ফুটে উঠেছে বলে মনে করছে আইনজ্ঞ মহল। বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির আগে রবীন্দ্র সরোবর ও পার্ক স্ট্রিটের পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়, বর্তমান সমাজচিত্রটা আসলে কী। ছেলেমেয়েরা এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাতে মা-বাবার স্নেহ-মমতা গৌণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে আইনের সহায়তা পাচ্ছে ওই ছেলে-মেয়েরাই।
আরও পড়ুন : কুসংস্কারের বলি, ভেলায় ভাসছে নাবালিকার দেহ
বিচারপতির এই মন্তব্য আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজীবী মহল। তাঁদের মতে, বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে বিচারপতির এই মন্তব্য, বাবা-মায়েদের মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করবে। বাবা-মায়েরা সচেতন হবেন। বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের মন্তব্য নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও ওড়িশা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, দীর্ঘ ৬০ বছর আইনের সঙ্গে যুক্ত থেকে বলা যায়, আইন ও বিচার সত্যসন্ধানী নয়। আইন শুধুমাত্র সামাজিক নিয়ন্ত্রণ করে। আবার জীবন আইন মেনে চলে না। কিন্তু জীবনের দাবি মেনে আইনকে চলতে হয়। তাই যুগে যুগে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর ভর করেই আইন তৈরি হয়। সামাজিক ভালোবাসাকে আইন তোয়াক্কা করে না।
আরও পড়ুন : বাংলায় জামিন পেলেও কারাগারে দেবযানী
সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের যেমন কর্তব্য রয়েছে। তেমনই সন্তানেরও বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য থাকা প্রয়োজন। বাবা মাকেও পরিস্থিতির কথা বিচার করে সন্তানদের আগলে রাখতে হয়। বয়ঃসন্ধিক্ষণ কখনও আইন মানে না। তাই একজন রাজকুমারীও পথের ভিখারির সঙ্গে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়ে তাই বাবা-মা, মানবাধিকারকর্মী ও আদালত প্রত্যেকেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
বিচারপতি প্রসাদের মন্তব্য নিয়ে ভিন্নমত রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রর। তাঁর মতে, সমাজ বদলে গেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের প্রতি বাবা মায়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল খুব কঠোর। সামাজিক পরিবেশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়েছে সমাজে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজ বদলে গেছে। বাবা-মায়েদের নিয়ন্ত্রণে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। ফলে যখন ঘটনা ঘটছে, তখনই তাঁদের সম্বিত ফিরছে। তাই বাবা মায়েদের দায় দায়িত্ব পালনের সময় শিথিলতার নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন।
আইনজীবী মহলের মতে, শিথিলতার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আইনের কথা মাথায় রেখে প্রথম থেকেই বাবা-মায়েদের মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। যাতে যে কোনও পরিস্থিতিতেই তাঁরা নিজেদের মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। আইনের কাছে অসহায় মা-বাবার স্নেহ।