কলকাতা: মৃন্ময় জগতের আঁতুড়ে সন্ধের শঙ্খধ্বনি সুর ভুলেছে। পলেস্তারা খসা অমসৃণ সময়ের দেওয়ালে মনখারাপ জমাট হয়ে আসে । তাল তাল মাটি আর দক্ষ হাতের যুগল কাজে মন দিতে অপারগ । জীবন আর উপার্জনের সঙ্ঘাত তীব্রতর বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে । তবুও ওরা পড়ে থাকে সৃষ্টির অবিন্যস্ত গলিতে । ধূসর স্বপ্নের ছায়া আর বুকে বারুদঠাসা আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ওরা রাতের চাটাই পাতে। ভোরের আজান মিইয়ে আসার আগেই একে একে খুলে যায় টিনের একচালা । টালির উঠোন জুড়ে পড়ে থাকা মূর্তি আর ঘন রোদে আঁধার কাটা কুঁড়ে। গলি থেকে তস্য গলি, মাটির আনকোরা গন্ধে মনের উচাটনি অভ্যাস বার বার অসুখের পাড়ে ধাক্কা খায় । বছরের পর বছর ধরে ওরা থাকে ওখানে । এমনতরো মিথ্যে অভ্যাসের পালে কখনও হাওয়া লাগেনি । লাগার কথাও ছিল না । বাঙালির পার্বণী প্রতিক্ষা ওই গলিজুড়েই যে আবর্তিত হয়েছে । বছরভরের ব্যস্ততা কুড়িয়ে নিতে নিতে ওরা ক্লান্ত হয়েছে । কখনও নিদারুণ বিশ্রামে ক্লান্তি নামেনি মাটির আগলে ।
কলেজ স্ট্রিটের আড্ডা
কোথাও আবার নরম সিঁড়ি, টানা বারান্দা, ঢাউস পাখার ঘসটানো শব্দের নীচে পাতা থাকে বিশ্রাম । আড্ডা জমে । সিগারেটের ধোঁয়া ওঠার কোনও বিরাম থাকে না । আড্ডা চরমে উঠতে উঠতে কখনও এলিয়ে পড়ে কাঠের চেয়ারে । আঙুল জুড়ে থাকে একান্ত আপন হয়ে । ঠোঁট এগিয়ে এসেও দূরে সরে যায়। সম্পর্কের ব্যবধান কাছে আসে, আরও কাছে । কোল্ড কফির পেয়ালা আর সম্পর্কের উত্তাপ যেন বিনি সুতোয় বাঁধা হয়ে যায় । ফিশ কাটলেট বা চিকেন পকোড়ার অর্ডারের জন্য হাপিত্যেশেও সুখ দুলে ওঠে । সিগারেটের কাউন্টার এক ঠোঁট থেকে আরেক ঠোঁটে স্থাপিত হয় । প্রথম প্রেমের নিভৃত অভিঘাতে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত জন্ম নেয় অচেনা কফি হাউস. বই-খাতার দুদণ্ড আলাপ আর কলেজ-ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের সখ্যতা ঝুল-বারান্দার কোণের টেবিলে গাঢ় হয় । সিঁড়ির দেওয়ালে স্লোগান আর হাতে আঁকা ছবি, সঙ্গী কিছু টেরাকোটা । ভিতরে একঝাঁক অজানা অচেনা পাখি, এক ছাদের তলায় বিলকুল কিচিরমিচির । অভিজাত রেস্তোরাঁর ফিসফিসানি যেখানে উধাও । মেঝে থেকে সিলিংয়ের দূরত্ব, দেওয়ালে রবিঠাকুরের প্রতিকৃতি আর আড্ডার রোশনাই সব পেয়েছির আসরে ঘাঁটি গাড়ে । বড় বড় কাঠের জানলা, দমকা হাওয়ার ঝাপটা আর ভেতরে আলো-আঁধারি খেলা । কোথাও শেষ বিকেলের আলো, কোথাও টিমটিমে বৈদ্যুতিক বাতি. ঝুলপড়া নিয়নের নীচে নিখাদ আড্ডাসরণি । বিকেল সাড়ে চারটেতেই হাউসফুল । দাঁড়িয়ে হত্যে দেওয়া. তেলেভাজা, আদা-চা আর কফির গন্ধ মিলেমিশে সুগন্ধের খিচুড়ি পাকায় অন্দরে । করিডর ধরে টেবিলের মাঝখান দিয়ে হাঁটার সময় মনে আসে, ওই কোণার টেবিলটায় কি ঝাঁকড়া চুলে মাথা নিচু করে, মোটা চশমায় চোখ লুকিয়ে নিজের নীল ডায়েরির পাতায় কবিতা লিখছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায় ? লম্বাটে টেবিলটায় কি ব্রিটিশ হঠাও আন্দোলনে স্বদেশি নেতারা মিটিং করেছিল ? কোনও টেবিলের কোণায় ধারালো কিছু দিয়ে লেখা ইংরেজি এম । তখনই মনের মধ্যে সিঁদ কাটে মান্না দে । মইদুল চলে যাওয়ার পর তারই কোনও স্মৃতিকাতর বন্ধু টেবিলে আনমনে লিখে রেখেছে নামের আদ্যক্ষর ? মইদুল কি জানতে পেরেছিল কোনওদিন এ কথা ? ওয়েটারের বাঁকা চোখ, ফরমাশে তাড়া, মিলেজুলে আড্ডার সর্বনাশ পেরিয়ে বাঙালি দার্শনিক কেশবচন্দ্র সেনের বসতবাড়িটি চঞ্চল হয়ে ওঠে । পরে ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অ্যালবার্টের নামে এর নাম দেওয়া হয় অ্যালবার্ট হল । ১৯৪২ সালে সরকারি উদ্যোগে অ্যালবার্ট হল হয়ে যায় কফি হাউস । আরও পরে ইন্ডিয়ান কফি হাউস । অসুখে অসুখে কফি হাউসের সেই আড্ডা আজ বড় দৈন্য ।
কুমোরের টুলি
মাটি নিয়েই চলে জীবন-জীবিকা । মাটির ঘরেই ওদের বাস । শহর লাখ টাকার থিমপুজোয় মাতে । ওদের অন্ন জোগানোর তীব্র প্রয়াস । মৃন্ময়ী প্রতিমায় নিপুণ তুলির টান, চিন্ময়ী হয় তিলোত্তমা । অশুভ নিধনে শুভ চেতনা জাগরণে, খুশির বার্তা বয়েই ঘরে ফেরে উমা । উৎসবের আলোতেও আঁধার ঘর । সেই ব্যস্ত পাড়াটির নাম কুমোরটুলি । আসলে ওদের হাতেই পুজো আসে । তোমার মুগ্ধতায় তৃপ্ত ওদের ঝুলি । এ গলিতে আজ কঠিন অসুখ । গলি, তস্য গলি পেরিয়ে ছোটে রিক্ততার জীবাণু । প্রাণের শেষ বিন্দুটি ধরে রাখার অনবরত বিফল চেষ্টা । কুমোরটুলি আজ ক্লান্ত । অসুখের ব্যর্থতা আর ধুলোওঠা বিবর্ণ সাদাকালো ক্যানভাস তফাত বোঝে না জ্বলন্ত রৌদ্রে । বাঁশের কাঠামো আর খড়ের আস্তরণ পেরিয়ে মাটির অন্তরঙ্গে প্রাণ আজ বড্ড বেশি বহিরাঙ্গিক । সৃষ্টিসুখের দেওয়াল কেঁপে কেঁপে উঠছে । মুহুর্মুহু জীবন ও যাপনের কলহের আঘাত । কুমোরটুলির গভীর ক্ষত, ধীর হয় স্পন্দন, থেমে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস, সামনে শুধুই অন্ধকার । এ অন্ধকার আমার কুমোরটুলি না । এ দৈন্যতা আমার কুমোরটুলি না । এ বিবর্ণতা আমার কুমোরটুলি না । আস্ত তালাটা খুলে ফেলো, আটচালার আবছা ছবিটা তীব্রতর রং পাক, ভোরের শিশিরের গন্ধ আর শিউলির মনোরম দৃশ্যপটে তোমায় বাঁচতেই হবে । শহুরে আলো আর মূর্তির তেলরঙা আতিথেয়তার জন্ম কুমোরপাড়া, তোমায় জেগে উঠতেই হবে । এ গলিতে আঁধার চাই না । অসুখের তপ্ততা চাই না, মহামারীর বিষাদ চাই না, মাটিমাখা আঙুলগুলোর চলমান তারুণ্য চাই, সৃষ্টিসুখের উল্লাস চাই, নতুন জামা চাই, মহালয়ার ভোর চাই, বায়না চাই, কুমোরপাড়ার ঘরে ঘরে ব্যস্ততা চাই । কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপে ঠাকুর চলে যাওয়ায় মনখারাপ চাই ।
আরও পড়ুন: সমুদ্রমুখী বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনলেন সোনাক্ষী! এবার কি বিয়ে!
কলেজ স্ট্রিটের আড্ডা
আড্ডায় মনখারাপ চাই না, সোনালি বিকেল হারিয়ে যাক, চাই না । নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে থাকলেও তাদের খবর চাই । গ্র্যান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ ডিসুজা আর কত ঘুমোবে কবরে ? রমা রায় তার ভালবাসা ফিরে পাক, ক্যানসার সারিয়ে ফিরে আসুক অমল । সুজাতা সুখী থাক, আজীবন । নিখিলেশের বিজ্ঞাপনের ছবি কদর পাক । ডিসুজা শুধু বসে কেন থাকবে ? সে কবিতা লিখুক, বিষ্ণু দে, যামিনী রায়কে নিয়ে তর্কে মাততে তো কোনও আপত্তি নেই । রমা রায়ের অভিনয় শুধু অ্যামেচার নাটকেই কেন বন্দি থাকবে? মইদুলের দুরন্ত কপি কেন বাইলাইন পাবে না, কেন তার কপি অ্যাঙ্কর স্টোরি হিসেবে ছাপা হবে না? বুড়ো ট্রাম তার আদর বিছিয়ে ফিরে যাক । বন্ধু বন্ধুর কথা শুনুক, গা ঘেঁষে থাক । নিরন্তর ভাল লাগা, ভালবাসার গল্প তৈরি হোক সেই টেবিলে । কফির সৌরভে ভালবাসা ভেসে থাক, অবিরাম জন্ম নিক প্রেম । ফের স্বপ্নের রোদ উঠুক । পার্বণ ছাড়়া কি প্রেম হয়, কিংবা প্রেম ছাড়া পার্বণ! কুমোরটুলি আর কফি হাউস তাই বন্ধনহীন গ্রন্থির মতো জুড়ে থাক ।