কাবুল: আফগান খনিজ সম্পদের সমৃদ্ধিটা কীরকম? এক কথায়, আজকের ডিজিটাল যুগে আলিবাবার গুপ্তগুহা! লিথিয়াম ব্যাটারি থেকে শুরু করে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল, জিপিএস ইত্যাদি প্রযুক্তিতে ব্যবহার্য চিপ তৈরির যাবতীয় দুষ্প্রাপ্য উপাদান সেখানে মজুত রয়েছে। একালে কৃত্রিম উপগ্রহ, নজরদারি ড্রোন, বৈদ্যুতিক যানের ক্ষেত্রে এগুলি অপরিহার্য। আবার সামরিক প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এই সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। তিন লক্ষ কোটি ডলারের হিসেবটা এখানেই সুপ্ত।
আফগান সঙ্কটের কেন্দ্রভূমি কিন্তু শুধুই সম্পদ লুঠের বিষয় নয়। এর নেপথ্যে আছে বিশ্ব-রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষিত। উপমহাদেশে বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণে কাবুল থেকে কান্দাহার, গজনি থেকে পাশতুনিস্তান, এই বিস্তৃত এলাকাকে ‘বাফার জোন’ গণ্য করা হয়। সুতরাং সোভিয়েত-মার্কিন ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের জের যে সেখানেও থাকবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে সোভিয়েত জমানার অবসানে ইতোমধ্যে তৃতীয় শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে চিনের। তাই বেজিংয়ের নজরেও আছে আফগান ভূমি।
অতঃপর মূল প্রশ্নে ফেরা যাক। আফগানিস্তানে তালিবান নামক নেকড়েদের স্বরূপটা কী? সোজাসাপ্টা ভাষায়, তারা সিয়া-পেন্টাগনের আর এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাড়া আর কিছু নয়। তালিবান-জেহাদিদের পূর্বসূরী কারা, সেটা ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। আটের দশক থেকেই কাবুলে ব্রেজনেভের আমলে সোভিয়েত আগ্রাসনকে দমন করতে পাল্টা শক্তি হিসেবে ‘আফগান মুজাহিদিন’ নামক জঙ্গি সংগঠনকে আসরে নামায় মার্কিন সমর ও গোয়েন্দা দফতর। রীতিমতো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে তালিম দেওয়া হয় তাদের।
আরও পড়ুন: তালিবানে যোগ দিয়েছেন পঞ্জশিরের আফগান যোদ্ধা আহমেদ মাসুদ, দাবি হক্কানির
‘অপারেশন সাইক্লোন’ নামে সেই অভিযানে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি বছর ধাপে-ধাপে বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ প্রায় দু’ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যায়। তাদের এই সামরিক রণকৌশলের সঙ্গী ছিলো সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান ও ব্রিটেনসহ কিছু ইওরোপীয় দেশ। তারাও পর্যাপ্ত সাহায্য সরবরাহ করতে থাকে।
আটের দশকের সেই কুখ্যাত ‘আফগান মুজাহিদিন’ গোষ্ঠী কালক্রমে হয়ে ওঠে ‘তালিবান’ বাহিনী, যাদের প্রাথমিক উদ্ভব ঘটে ছিলো পাশতুন প্রদেশে। মূলত ইসলামি শিক্ষার পীঠস্থান গুলিতেই এরা সক্রিয় ছিলো। তালিবান (বা তালেবান) শব্দের মূলেও আছে ‘তালেব’, অর্থাৎ শিক্ষার্থী।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে জঙ্গি ‘তালেব’রাই বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে সক্রিয় মুজাহিদিন নেতৃত্বের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করে ফেলে। সংগঠনের নয়া পরিচিতি তৈরি হয় ‘ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তান’ (আই ই এ) নামে। মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নেতৃত্বে ‘আই ই এ’ সক্রিয় ছিলো ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। কাবুল থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয় কান্দাহারে। আফগান ভূখণ্ডের প্রায় সবটাই তাদের দখলে চলে যায়। তারাই আবার ক্ষমতায় ফিরছে বলে মিডিয়া জানিয়েছে।
আরও পড়ুন: আফগানিস্তান থেকে আতঙ্কিতদের ফেরানোই এখন মূল লক্ষ্য আমেরিকার
সৌদি সন্ত্রাসবাদী নেতা কুখ্যাত ওসামা বিন লাদেনের ‘আল কায়েদা’-ও সক্রিয় ছিলো তালিবান জঙ্গিদের ঘাঁটিতে। ওদিকে জন্ম-দুশমন ভারতকে চাপে রাখতে পাকিস্তান তার আফগান সীমানা উন্মুক্ত করে দেয় তালিবান বাহিনীর জন্য। পাশাপাশি মিত্র জোটের দোসর হওয়ার সুবাদে আমেরিকার মতো ভিন দেশি শক্তিকে জমি ছেড়ে দিতে হয় ঘাঁটি গড়ার কাজে। সে এক বিচিত্র কূটনীতির খেলা। অতঃপর ইসলামাবাদের ভূমিকা পর্যবেক্ষণের বিষয়। আমাদের গৈরিক সরকারও যে বিড়ম্বনায়, তা স্পষ্ট হয়েছে বৈদেশিক নীতির অস্পষ্টতায়।
গত দুই দশকে “নেটো” সামরিক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে মোটামুটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হতে দেখা গিয়েছে কাবুলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে পুনর্গঠনের কাজে শামিল হয়ে ছিল ভারত। সেই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে এবার। ‘বাফার জোন’ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে দিল্লির সরকারকেও।
পরিশেষে বলি, তালিবানি রমরমা শুধুই নারীর লাঞ্ছনাজনিত দুর্ভোগের পরিসরে সীমিত নয়। মানবাধিকারের আরও বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তার হিংস্রতার ছায়া। তালিবানের সঙ্গে ইসলামি অনুষঙ্গ জুড়ে তার ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ লক্ষ করে কাতর হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু এর নেপথ্য রাজনীতি ও ‘সুসভ্য’ বিশ্বশক্তির কদর্য খেলাটা তাঁদের নজরে পড়ছে না। এদেশে গৈরিক শক্তির ‘তালিবানি’ তাণ্ডব কীসে কম যায়?
আরও পড়ুন: হাজারেরও বেশি যাত্রী নিয়ে আফগানিস্তান থেকে পাড়ি দিল আমেরিকার ৩৮টি বিমান