চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যে আনন্দর কাতর আর্জি ছিল প্রকৃতির কাছে, ‘জল দাও আমায়, জল দাও/রৌদ্র প্ৰখরতর, পথ সুদীর্ঘ, আমায় জল দাও।’ অনেকটা যেন ওই কায়দাতেই শহরের দিকপাল মদ্যপরা মদের দোকানিকে বললেন, ‘মদ দাও আমায়, মদ দাও।’
তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। রৌদ্র সত্যি প্ৰখরতর। কিন্তু তাতে কী! আজ মঙ্গলবার। পাড়ার মদের দোকান খোলার দিন। এতদিন বন্ধ ছিল। সদ্য খুলেছে। যেন ‘মরুতীর হতে সুধা শ্যমলিম পারে’ এসেছেন মদ-পিপাসুরা।
একদিকে কোভিডের টিকা দেওয়ার লাইন। আর একদিকে মদের লাইন। দুই হাতে এমনি করেই বাজে কালের মন্দিরা।
পৃথিবীর আর কোনও শহরে এমন আছে? রাস্তার একদিকে টিকার লাইন। আর একদিকে মদের লাইন। এ দৃশ্য বোধহয় শুধু শহর কলকাতার। পেচো মাতাল যেমন আছে, তেমনই আছে বাবুমশাইরা। মদ খেয়ে কেউ চিল-চিৎকারে গান করেন, কেউ একটা কথাও বলেন না, কেউ বা হয়ে পড়েন মহানুভব। এতদিন সেটা বন্ধ ছিল। মদের লকগেট খুলে দিয়েছে সরকার। কত কিউসেক মদ ছাড়া হল, কত মিলিমিটার মদবৃষ্টি হল—তার খবর কে রাখে! রেখে হবেই বা কী!
ভিড়ের মধ্যে একজনকে দেখা গেল, বোতল তুলে ধরে হর্ষ প্রকাশ করছেন। যেন অলিম্পিকের ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, পদক দেখাচ্ছেন দেশবাসীকে। সত্তর দশকে মদকে রীতিমতো পাবলিকের হাটে এনে ফেলেছিলেন উত্তমকুমার-কিশোরকুমার জুটি। বিপিনবাবুর কারণসুধা তখন সুপারহিট। কে বড় প্রেমিক, দেবদাস নাকি অমানুষের মধু তা নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে। উত্তমকুমার তো বটেই, তাঁর দুই চ্যালা জোতে ও পদা-র মতো হতে পারলেও যেন বর্তে যায় কেউ কেউ। মদের প্রতি আকর্ষণ সেই পুরাণকাল থেকে। সেই মদের মন্দাকিনীর গতি থেমে যায়, মনুষ্যকুল শুনবে কেন?
কেউ কেউ অনলাইনে মদ পাওয়া যায় কি না, খোঁজ করেছেন। অনলাইনে যদি ঘুঁটে বিক্কিরি হয়, তা হলে মদ হবে না কেন? কোথায় সেই ভগীরথ, যিনি এনে দেবেন একপাত্র সুধা! ডাকযোগে কি আর সাঁতার শেখা যায়! মদের কোনও ভার্চুয়াল প্রবাহ হয় না। যা হবে, হাতেনাতে। মদ দাও আমায়, মদ দাও।
মদ মিলছে গঞ্জ-শহরে। টিকাও মিলছে ইতিউতি। রাস্তার দু’ধারে জীবনের দুই প্রবাহ। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন একটি বিন্দুতে পৌঁছতে।
যে বিন্দুতে টলমল করছে জীবন। হোক না মদ, হলোই বা টিকা। ক্ষতি কী!