বাম জমানার শেষের দিকে ছোট মেজ, সেজ, বড় বাম নেতাদের মুখে শোনা যেত কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সেই বাম, বিশেষ করে সিপিএম নেতারা এই শিল্পের গান গাইতেন। তার কারণ ছিল আসলে একটাই, দীর্ঘ সময় ধরে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বেকারত্ব এক মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমন এক সময়ে বাম নেতাদের মনে হয়েছিল একমাত্র শিল্প এলেই এই বেকারত্বের অবসান সম্ভব। কাগজে কলমে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যক্তি পুঁজির বিরোধী, পুঁজিবাদের বিরোধী, সেই পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সাম্যবাদ আনতে চায়। কিন্তু তাদের সরকার পুঁজি আনার জন্য, বিনিয়োগ আনার জন্য হেঁদিয়ে মরল। বুদ্ধবাবু তো বলেই দিলেন, বেড়াল ইঁদুর মারতে পারলেই হল, তার রং সাদা না কালো তা দেখার দরকারই নেই কাজেই ইন্দোনেশিয়াতে কমিউনিস্টদের কতল-এ-আম করনেওয়ালাদের সাকরেদ সালেম গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাতেও তাঁদের অসুবিধে ছিল না। আর সেই শিল্প আনার তুমুল জোয়ারে তাঁরা তিন ফসলা, চার ফসলা জমি, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি কেড়ে ন্যানো কারখানা করবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, ঘটি হারাল। তো সিপিএম না নিক, মানুষ তার সামনে চলা ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়। আর সেই জন্যই ওই সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, জোর করে জমি নেওয়া যাবে না, হবে না। তাকিয়ে দেখুন দেউচা পাচামির দিকে, ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড স্টেশন বা তাজপুর বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের দিকে। আন্দোলনের যে কোনও পর্যায়ে পুলিশ নেমে, গুলি চালিয়ে কত কী ঘটাতে পারত, কিন্তু মমতা এবং তাঁর সরকার গুলি চালাননি, মানুষ মরেনি। কখনও আলোচনা, কখনও ভয় দেখানো, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো, বিভিন্ন পদ্ধতিতে এসব জমি অধিগ্রহণ সামলিয়েছে মমতা সরকার। কিন্তু ওই প্রশ্নটার উত্তর আমাদের সামনে আসেনি, বা আমরা ওই প্রশ্নটাকে নিয়ে তেমন নাড়াঘাটা করিইনি। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, শিল্প এলেই কি চাকরি হবে?
আদানি, আম্বানি, হিরনন্দানি, নেওটিয়া, ডালমিয়া থেকে পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জি, বড় বড় শিল্প গোষ্ঠীরা হাজির হয়েছেন শিল্প সম্মেলনে। বিনিয়োগ আনার জন্য মমতা এর আগেই স্পেনে গিয়েছেন, ব্রিটেনেও গেছেন, এবারে সেখান থেকেও নাকি বিরাট এক দল এসেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা রাজ্যের অর্থনীতির স্বার্থেই শিল্প-কৃষির উন্নতি চাইবেন, স্বাভাবিক। বিধানচন্দ্র রায়কেও দুর্গাপুর কারখানা করার জন্য জমি কেড়ে নিতে হয়েছিল, আন্দোলন হয়েছিল, গুলিও চলেছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সময়ে তেমন বড় কোনও উদ্যোগের কথা না শোনা গেলেও জ্যোতি বসু বহুবার বিদেশে গিয়েছেন শিল্প আনতে, বিনিয়োগ আনতে, মুক্তকচ্ছ হয়ে নয়, তবে চেষ্টা ছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | দিলু ঘোষ বা শুভেন্দু এবার টিয়াপাখি নিয়ে রাস্তায় বসুন
বুদ্ধবাবুর সময়ে সেই চেষ্টা এক মরিয়া আকার ধারণ করল, দল এসইজেড বিরোধী কিন্তু সরকার এসইজেড বানাচ্ছে। অনুমতি দিচ্ছে জমি দিচ্ছে আর নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরের কথা তো আগেই বললাম। কিন্তু মূলত এক কৃষিপ্রধান দেশে শিল্প কত চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে? শিল্পে কত মানুষের সরাসরি চাকরি মেলা সম্ভব? বিধান রায়ের আমলে বহু লক্ষ মানুষের চাকরি হয়েছিল, এটা ঘটনা। কিন্তু যত দিন গেছে, তত শিল্পের আধুনিকীকরণ হয়েছে, হাইলি মেকানাইজড, কম্পিউটারাইজড শিল্পে হাতেগোনা মানুষের চাকরি হচ্ছে। তথ্য বলছে, ১৯৫৬ সালে ৫০ কোটি বিনিয়োগ ৭০-৮০ হাজার মানুষের সরাসরি চাকরির সুযোগ করে দিত। আর আজ সেই ৫০ কোটির সমমূল্য ৫০০ কোটির বিনিয়োগে সরাসরি চাকরি পাবে আট থেকে ন’ হাজার মানুষ। অর্থাৎ আজকের শিল্প কিন্তু আর লেবার ইন্টেনসিভ নয়, বহু মানুষের চাকরি হবে এমন আশাও করা যাবে না। হাইলি স্কিলড হাজারখানেক মানুষ দেড় থেকে দু’ হাজার কোটি বিনিয়োগ করা শিল্পের জন্য যথেষ্ট। এবং তাই শিল্প এলেই বেকারত্ব সমস্যার সমাধান যে হবে না সেটা বোঝাটা বড্ড জরুরি। তাহলে? তাহলে উপায় হল কৃষির আধুনিকীকরণ, কৃষিজাত বস্তুর শিল্প, যাকে অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি বলে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি, বন্দর তৈরি, রাস্তা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি তৈরিতে এখনও বহু মানুষের চাকরি সম্ভব। এবং এসব ক্ষেত্রে সরাসরি যত মানুষের চাকরি হবে পরোক্ষ ক্ষেত্রে তার তিন থেকে চারগুণ রোজগারের সুযোগ বাড়ে। আমাদের প্রশ্ন ছিল মানুষের কাছে, গত দু’ দশক ধরে আমরা শিল্প সম্মেলন দেখছি, কম বেশি বিনিয়োগ আসছে, কখনও কম বা কখনও বেশি, কিন্তু চাকরির বাজার বাড়ছে না, চাকরির সুযোগও বাড়ছে না। এমন এক সময়ে আবার আমাদের কৃষিক্ষেত্রেই জোর দেওয়াটাই কি উচিত নয়? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
এক কৃষিপ্রধান দেশে কমিউনিস্ট সরকার যখন স্লোগান দিল কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ, ঠিক তখন গ্রাম বাংলার এক বিরাট অংশের চাষিদের কাছে জমির ঠিকঠাক কাগজটা পর্যন্ত নেই, ক্ষতিপূরণ দেবেন সরকার? অনেক টাকা দেবেন? কিন্তু কাগজ না থাকলে ক্ষতিপূরণ পাবে কে? অতএব তৈরি হয়েছিল এক বিরাট সংখ্যার অনিচ্ছুক কৃষক, তাদের জমি কাড়তে গিয়ে সরকারটাই পড়ে গিয়েছে। কেবল কাগজই নয় আসলে যা যা করলে কৃষি ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে তার কিছুটা অবশ্যই বোঝা যেতে পারে চীনের দিকে চোখ রাখলে। একর পিছু উৎপাদন আমাদের তুলনায় ৮ কি ৯ গুণ, হ্যাঁ এটাই বাস্তব। কৃষির সেই ভিত্তির থেকেই চীন শিল্পের দিকে হাত বাড়িয়েছে, সেটাও ভারি আর বড় শিল্প নয়, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প। ঘরে ঘরে চিপ তৈরির কারখানা, ছোট্ট কারখানাতে উৎপাদন তাদের সাফল্যের ভিত্তি। শিল্প সম্মেলন চলছে, এই কথাগুলো বেশি বেশি করে বলা দরকার।