নিশ্চয়ই মনে আছে সেই, “শুন্ডির দেব পিণ্ডি চটকে।” সেই পিণ্ডি চটকানো চলছে এই বাংলায়। কিছুদিন আগেই সাড়া জাগিয়ে যে ইন্ডিয়া জোটের পথচলা শুরু হয়েছিল তার পিণ্ডি চটকানো শেষ, এবার শ্রাদ্ধটা সেরে ফেললেই হয়। এবং এমন নয় যে এই কাজটা কেউ একজনে করছেন, এ বাংলায় প্রতিদিন ইন্ডিয়া জোটের তিন শরিক সমান গুরুত্ব দিয়ে, সমান চেষ্টাচরিত্র করে জোটের পিণ্ডি চটকাচ্ছেন, এবং মজার কথা হল একজন অন্যজনকে এই জোট ভাঙার কারিগর বলেই চিহ্নিত করছেন। একদিকে আরএসএস-এর মতো এক সংগঠনের ছাতার তলায় তাদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, হিন্দু একতা সমিতি ইত্যাদির মতো নানান হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, নারী সংগঠন দুর্গা বাহিনী ইত্যাদি, শ্রমিক কৃষক সংগঠন, রিটায়ার্ড সৈন্যদের সংগঠন, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ, বিভিন্ন টেকনোক্র্যাট, এক বিরাট সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী এবং তার সঙ্গে চোস্ত দুরুস্ত টোয়েন্টি ইন্টু ফোর এক নির্বাচন মেসিনারি নিয়ে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। যেন এক অশ্বমেধ যজ্ঞ, ঘোড়া ছুটছে, দখলে আসছে রাজ্য, দেশ। আর অন্যদিকে এতদিন ধরে একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়ে আসা সংগঠনগুলো যাঁরা মনে করেন দেশের সংবিধানকে বাঁচাতে হবে, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বহুস্বরকে বাঁচাতে হবে, তাঁরা যাঁদের দেওয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছে, তাঁরা মিলে এক প্ল্যাটফর্মে আসার একটা চেষ্টায় খানিক সফল হলেন। তাঁদের সেই সফলতা এমনকী বিজেপিকেও বিচলিত করল, কিন্তু তার পরেই আবার তাঁরা ফিরে গিয়েছেন আপন আপন অবস্থানে, একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেই চলেছেন। মানুষ অবাক হয়ে দেখছেন, যে মানুষ এখনও আরএসএস বা বিজেপির ডাকে ওই হিন্দুত্ববাদী স্লোগানে গলা মেলাননি, তাঁরা দেখছেন শুরুর আগেই খেলা শেষের গল্প। সেটাই বিষয় আজকে। এ বাংলায় ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের পিণ্ডি চটকানো চলছে।
তৃণমূল আগেই জানিয়েছিল, মল্লিকার্জুন খাড়গেই হতে পারেন জোটের মুখ, কিন্তু আগেভাগে তা জানানোর, মানে সাংবাদিকদের কাছে বলার কী দরকার ছিল? জানা নেই। কিন্তু এটা যে পার্ট অফ পলিটিক্স জানা আছে যদিও তা যে জোটকে শক্তিশালী করবে না তা জানা আছে। ওদিকে নীতীশ কুমারের নাম এসে গেল সোশ্যাল মিডিয়াতে, কারা তুললেন? জোটের বৈঠকেই কি তা আলোচনা করা যেত না, হান্ড্রেড পার্সেন্ট যেত, কিন্তু করা হল না। মিডিয়াতে না ভাসিয়ে জল মাপা হচ্ছে। এবারে বাংলাতে শুরু হয় গেল বয়ানবাজি।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলায় কি দলের রাশ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই আসছে?
সিপিএম তো লাগাতার বলে আসছে তৃণমূল বা মমতা বিজেপির বি টিম, কিন্তু সে কথা কি একবারও ইন্ডিয়ার বৈঠকে বলেছেন? না বলেননি। ইন্ডিয়া বৈঠকে আসন রফা হওয়ার আগে বেরিয়ে এল, মমতা মাত্র ২টো আসন দিতে চান কংগ্রেসকে। শুনে বহরমপুর কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী রেগে আগুন তেলে বেগুন। মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, আসুন বহরমপুরে হারাব, বলে বলে হারাব। কংগ্রেস জানাচ্ছে, ১০টা আসনে লড়তে চায়, মানে তৃণমূল লড়বে ৩২টা আসনে। অধীর চৌধুরীও বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে ট্রোজান হর্স, আসলে বিজেপির হয়েই খেলছেন। বহরমপুরের অধীরবাবু আর ন্যাড়ামাথা কৌস্তুভ বাগচি একই ভাষায় কথা বলছেন, অতএব তাল দিতে মাঠে কুণাল ঘোষ। উনি জাতে উগ্র ক্ষত্রিয় কি না জানা নেই কিন্তু ভাষাতে তো বটেই, কাজেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেছে। উনি চোখা চোখা দিতে শুরু করেছেন। মানুষ দেখছে, বিরক্ত হচ্ছে, বিজেপি দেখছে, আমোদিত হচ্ছে। কিন্তু এরমধ্যেই আরএসএস–বিজেপি বিরোধী জোটের ছবি মলিন হচ্ছে। কংগ্রেস একলাই লড়বে? কী হবে? একটা আসন কোনওভাবে, বহরমপুর জিতবে না লিখে নিন, তৃণমূল আর জাতীয় কংগ্রেস জোট হবে না? বিজেপি আবার সেই ১৫-১৬টা আসনে জিতবে মিলিয়ে নেবেন। আসন আর নির্বাচনের কথা ছেড়েই দিন, যে হিন্দুত্ব আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদী জোয়ার আসছে তাতে দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুস্বর বিপন্ন। জোটের নেতাদের সেটা মাথাতেও নেই, তাহলে কি এটা এক জোট জোট খেলা? হতেই পারে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলার তিন জোটের শরিক, সিপিএম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রস যে ভাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে বয়ানবাজি করেই চলেছে তাতে কার সুবিধে? কেনই বা তাঁরা এটা করছেন? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
১৯৩০ থেকে দেখুন জার্মানির ইতিহাস, পড়ুন ইলিয়া এরেনবুর্গ-এর পারির পতন। কীভাবে স্বৈরাচার সুযোগ নেয় বিরোধী শক্তির মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতার, তাদের অনৈক্য কীভাবে হিটলারের হাত শক্ত করেছিল পড়ুন। আর সেই ১৯৩০-এই যে অধ্যায়ের সমাপ্তি হতেই পারত, তা আরও বিশাল আকার ধারণ করেছিল। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট আর কমিউনিস্টদের, গণতন্ত্রকামীদের একে অন্যের প্রতি ঘৃণা আর বিষ ছড়ানো জারি থেকেছিল। এবং ১৯৩৩-এ, তাদের প্রত্যেকেই খুন হয়েছিলেন বা জেলে পচে মরেছিলেন। এই নিজেদের মধ্যে অনাবশ্যক লড়াইয়ের সিঁড়ি বেয়েই হিটলারের উত্থান। ইতিহাস তাই বলে। আর আমরা সব্বাই জানি, দোজ হু ফরগেট হিস্ট্রি আর কনডেমন্ড টু রিপিট ইট। ইতিহাস ভুলে গেলে তার পুনরাবৃত্তি হয়। আমরা কি তাহলে আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য বসে থাকব?