দু’ দু’বার জেতা আসন আসানসোলে বিজেপির প্রার্থী কে? আমরা জানি না, জানেন না এলাকার বিজেপি কর্মীরা, জানে না সংবাদমাধ্যম। গেস-ওয়ার্ক চলছে, তাতে আরও কনফিউশন বাড়ছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রতিটি মিটিংয়ে ভাইপোকে দেখে নেব, ভাইপো জেলে যাবে, ভাইপোর লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি প্রতিটা জনসভায় বলেই যাচ্ছেন, কিন্তু এখনও সেই ভাইপোর কেন্দ্রে আসন দিয়ে উঠতে পারলেন না। এখনও জানাই নেই কোন চমক অপেক্ষা করছে সেই তালিকায় যা এখনও সামনেই এল না। সারা দেশ জানে, আমরাও বহুবার আলোচনা করেছি যে বিজেপির আসন বাড়াতে হলে তাকে সেই আসন পেতে হবে কেরালা থেকে, তামিলনাড়ু থেকে, অন্ধ্র থেকে, ওড়িশা থেকে এবং অবশ্যই বাংলা থেকে। সেই বাংলার দায়িত্ব চলে গেছে দিল্লির নেতাদের হাতে, জেলে পোরা হয়েছে বেশ কিছু মন্ত্রীসান্ত্রী, তৃণমূল নেতাদের, এনআইএ ডেকেও তলব করা হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের, আবার রাজ্যের কিছু কিনো খ্যাপার দল খেপে উঠেছে, তাঁরা যোগ দিচ্ছেন রুদ্রনীলের নেতৃত্বে কালচারাল সেলে। কিন্তু ডায়মন্ডহারবার আর আসানসোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটো আসনে প্রার্থীই খুঁজে পাচ্ছে না বিজেপি। আমার সূত্র বলছে, বেশ কিছু সেলিব্রিটি, ডাক্তার, মোক্তার অভিনেতা ইত্যাদিকে অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু ডায়মন্ডহারবার শুনে তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেষমেশ নাকি গোখরো সাপকেই রাজি করানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু শরীর খারাপের কথা বলে তিনিও তা এড়িয়ে গেছেন। এই গরমে কোন সেলিব্রেটি, অভিনেতা গায়ক নায়ক ডাক্তার মোক্তার এই হাঁসফাঁস গরমে ওই আসনে লড়ে নিজের লাল টুকটুক শরীরকে খামোখা কষ্ট দিতে যাবেন বলুন তো? আর ঠিক সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, যাঁরা বলছেন ৩৭০ পাবেন, তাঁরা এখনও বাংলার দুটো আসনের প্রার্থী দিতে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন?
বিজেপি উত্তর ভারতে যে ধারণা থেকে বেড়ে উঠেছে, বেড়ে উঠছে তার সঙ্গে কি এতটুকু মিল আছে আমাদের এই বাংলার? নেই। ধরুন উত্তর ভারত জুড়ে রামচরিত মানস আছে, নবরাত্রি আছে, অযোধ্যার পূণ্যভূমি আছে, নিরামিষ ভোজন, যাকে বলে শুদ্ধ শাকাহারী ভোজন, তাও আছে। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দু সিপাহিরা বিদ্রোহে নেমেছিলেন কারণ এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে নাকি গরু আর শুয়োরের চর্বি লাগানো আছে এই প্রচার শুনে। প্রচারের জন্ম এই বাংলা থেকে, এখানে কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের কেবল ওই স্ফুলিঙ্গটুকুই দেখেছিলাম আমরা, বিদ্রোহ দাবানলের আকার নেয়নি।
আরও পড়ুন: Aajke | কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়…
এখানে আমাদের সেই কবেই রামকৃষ্ণদেব বলেছেন যত মত তত পথ, বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার দিনে নিজের হাতে ইলিশ রেঁধে খেয়েছিলেন, খাইয়েছিলেন গুরুভাইদের। এখানে রাজা রামমোহন মোগল সম্রাটের দূত হয়ে বিলেতে গিয়েছিলেন, এখানে রবি ঠাকুর আর নজরুলের মানবতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার গান আর কথা ছড়িয়ে আছে। সমস্যা সেখানেই। এখানে বিজেপি যে ১৮টা আসন পেয়েছিল তা এক মোহি লহর, এক মোদি ঝড়ে। ২০১৯-এ মোদি ঝড়ের অনুষঙ্গ ছিল পুলওয়ামা। আজ সেই ঝড় বা হাওয়া নেই, এমনকী মৃদুমন্দ পবনেরও দেখা নেই। খামোখা চেঁচিয়ে মরছে কিছু নেতা। যে মাটিতে কমলালেবু হয় না, যে আবহাওয়াতে কমলালেবু হয় না, সেখানে কমলালেবু চাষ করতে গেলে যা হয় ঠিক তাই হচ্ছে। ফল হচ্ছে না, হলে টক হচ্ছে। বাংলার মানুষকে বোঝানো যাবে যে নবরাত্রির সময়ে নিরামিষ খেতে হয়, বোঝানো যাবে যে হিন্দুরা বড্ড বিপন্ন? বোঝানো যাবে যে দুর্গা বা কালী নয় হনুমানেই লুকিয়ে আছে আসল দেবতা। বোঝানো যাবে যে মুসলমান মানেই দেশদ্রোহী? সম্ভব নয়। এসব যাঁরা বলা শুরু করেছিলেন সেই গুরুদেব শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল নেতাজি সুভাষ বসুর অনুগামীরা। হাওয়ায় ভেসে ১৮ হয়েছিল, হাওয়া নামতেই অবকি বার দোশো পারের বদলে ৭৭ হয়ে গেছে। একটু অপেক্ষা করুন, এবারের ফলাফল দেখে আরও কিছু নেতার ঘর ওয়াপসি নিশ্চিত। যে উত্তরবঙ্গে বিজেপির বিরাট অগ্রগতি আমরা দেখেছিলাম, সেই উত্তরবঙ্গে স্বয়ং রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে বালুরঘাটে এবারে জান দিয়ে লড়তে হচ্ছে, আলিপুরদুয়ার সেফ সিট নয়, রায়গঞ্জ জিতেছিলেন দেবশ্রী চৌধুরী, জিতে মন্ত্রী হয়েছিলেন, এবারে নিশ্চিত হারের মুখোমুখি না হতে চেয়ে আসন ছেড়ে পালিয়েছেন। ওখানে বিজেপি তিন নম্বরে থাকবে, বাঁকুড়া ঝাড়গ্রাম পুরুলিয়া জিতবে? হুগলি জিতে আসতে পারবে? সংশয় আছে রানাঘাট, মেদিনীপুর নিয়েও। এবং সেই নড়বড়ে সংগঠন আর জয় নিয়ে সংশয়ী কর্মী নেতাদের ফৌজ এখনও দুটো গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থীই ঠিক করে উঠতে পারল না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যাঁরা বিধানসভায় শূন্য তাঁরা বহু জায়গাতে বহু আসনে প্রার্থী ঠিক করে উঠতে পারেননি বোঝা গেল, কিন্তু যাঁরা দেশে নিজেরাই ৩৭০টা আসন জিতবেন বলে দাবি করছেন, তাঁরা রাজ্যের সবক’টা আসনে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছে না, এটাই কি বুঝিয়ে দেয় না যে এ রাজ্যে বিজেপি এখনও তৃণমূলের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জনই করেনি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যাঁদের সেই জমানার কথা মনে আছে তাঁরা জানেন, বিজেপি বা সিপিএম-এর মতো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠিত দল নির্বাচন ঘোষণার বহু আগেই ঠিক করে ফেলত তাদের প্রার্থী তালিকা। নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার যা দেরি, ঘোষণা হয়ে যেত সেই তালিকা। কোনও প্রতিবাদ হত না। প্রচারের কাজ শুরু হয়ে যেত। দুটো দলেই আজ একই হাল, প্রার্থী নেই, অনৈতিক জোট, প্রার্থীপদ নিয়ে আকচা আকচি। যেমনটা হত কংগ্রেসে, যেমনটা হয় আর পাঁচটা দলে, নির্বাচনের আগে ঠিক তেমন ছবিই দেখা যাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি বা বিজেপি দলে। ফারাক হল, কমিউনিস্ট পার্টি আপাতত এক অতিক্ষুদ্র সংসদীয় দল আর বিজেপি এক বিরাট আকার। তাহলে কি ক্ষয় শুরু হয়েছে? পূর্ণিমার পরে চাঁদের ক্ষয়ের মতো?