পাড়ার পঞ্চা কেলো ছেনোদের মুখে শোনা যেত, মেরে মুখের জিওগ্রাফি বদলে দেব, গাছে বেঁধে পেটাব। তো সেগুলো ছিল মাস্তানদের ভাষা, আমরা তো সে ভাষা শিখিনি, বলার দরকার পড়েনি। কিন্তু রাজনীতি ক্রমশ সেই দিকেই আমাদের নিয়ে চলেছে, অনিবার্য ললেসনেস-এর দিকে, এক অরাজকতার দিকে, এক মাৎসন্যায়ের দিকে। যেখানে ক্ষমতা থাকলে যা খুশি তাই বলা যায়, যা খুশি তাই করা যায়। এই অবস্থা দু’ধার থেকে তৈরি হয়। এক হল এগজিসটিং আইন কানুনকে অথর্ব করে দিয়ে, মানে ধরুন আপনার ঘরে চুরি হয়েছে, আপনি পুলিশে খবর দিলেন, না চোর ধরা পড়ল না চুরির জিনিস ফেরত এল। বা যদি বা ধরা পড়ল, দিন চারেকের মাথায় জামিন পেয়ে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে এল। খুনিরা জেলের বাইরে আর নির্দোষ জেলে পচে মরছে। এরকম একটা অবস্থা ইচ্ছে করেই তৈরি করা হয় যাতে আম জনতার আইনের উপর থেকে ভরসাও উঠে যায়। আর সেই সময়েই এসে হাজির হবে বুলডোজার বাবারা। এনকাউন্টার স্পেশালিস্টরা। আইনের দরকার কী? গুলি করে মেরে দিলেই ল্যাটা চোকে। মেয়ের ধর্ষকদের দিনের পর দিন আইনের আড়ালে হাওয়া খেয়ে বেড়াতে দেখা এক পিতা, এক ভাই তো এরকমই ভাববেন, গুলি করে মেরে দাও। কিন্তু প্রশ্ন তো থাকবেই, কে বলে দিল যে যাকে গুলি করে মারা হল, যার ঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হল সেই ব্যক্তি দোষী, আসল দোষী। সভ্য সমাজে সেই কাজটাই তো করার জন্য আছে আইন আদালত, বিচারক বা বিচার ব্যবস্থা। কিন্তু সেই বিচার ব্যবস্থাকে পাত্তাও দিতে রাজি নয় আজকের শাসকদল, সেটাই বিষয় আজকে, দেশের আইন কানুনের উপর এতটুকুও আস্থা নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা বিজেপি নেতাদের।
কিছুদিন আগেই বিহারে গিয়ে আমাদের ছোটা মোটা ভাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, যাঁরা দাঙ্গা করবেন, তাঁদের উল্টো লটকে মারা হবে। মাত্র গতকাল আমাদের রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে আসা আদিত্যনাথ যোগী বললেন, আমাদের রাজ্যে এরকম দাঙ্গা হলে অপরাধীদের উল্টো লটকে এমন মারতাম যে তাদের সাতপুরুষ আর কোনওদিন দাঙ্গা করার সাহস পেত না।
আরও পড়ুন: Aajke | আবার ডাহা মিথ্যে বলছেন সাংসদ শান্তনু ঠাকুর
আচ্ছা, এরকম বলা যায়? একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে বসে একজন স্বরাষ্টমন্ত্রী একজন মুখ্যমন্ত্রী অনায়াসে এরকম বেআইনি কথা বলে দিতে পারেন? কোন আইন আপনার হাতে আছে যেখানে একজন দাঙ্গাবাজকে এমনকী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও উল্টো করে ঝোলানো যায়? এটা তো প্রথম প্রশ্ন, পরের প্রশ্নও খুব স্বাভাবিক। একজন এমপির একজন মন্ত্রীর ছেলে গাড়ির চাকার তলায় সবার সামনে চারজন কৃষককে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার পর তাদের লটকানোর কথা কি বলেছিলেন যোগীজি? লটকে ধোলাই দিয়েছিলেন? হাথরসের ওই জঘন্য অপরাধীদের বেলায় উল্টো করে ঝুলিয়ে মারার কথা বলেছিলেন যোগীজি? খুঁচিয়ে পিটিয়ে সংখ্যালঘু মানুষকে জয় শ্রীরাম বলার জন্য যারা বাধ্য করে তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে ধোলাই দেওয়ার কথা ভেবেছেন যোগীজি? এ রাজ্যে এসে জ্ঞান না দিয়ে নিজের রাজ্যে সেগুলো প্র্যাকটিস করুন না। ক্ষমতা দেখাচ্ছেন সংখ্যালঘু কুঁকড়ে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত লোকজনদের উপর, একবার শক্ত মাটিতে আঁচড় কেটে দেখান না। রাজ্য জুড়ে এক বিশৃঙ্খলা, আইন তাকে রাখা আছে, মাফিয়ারা ঘুরছে খোলা ষাঁড়ের মতো আর যোগীজি এসেছেন এই রাজ্যে উল্টো ঝুলিয়ে ধোলাই দেওয়ার দাওয়াই নিয়ে। ন্যাশন্যাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য বলছে, এই বাংলার থেকে উত্তরপ্রদেশে আইন শৃঙ্খলার সমস্যা অনেক বেশি, কলকাতা দেশের অন্যতম নিরাপদ শহর। কিন্তু তবুও তো সমস্যা আছে, গাফিলতিও আছে। কিন্তু তার কথা একজন ছেনো গুন্ডার গলায় আমরা শুনতে যাব কেন? রামনবমীতে বেশ বড় রকমের দাঙ্গা বাঁধানোর পরিকল্পনা ছিল, সেটা লাগলে উনি আসবেন, উল্টো ঝুলিয়ে মারার দাওয়াই দেবেন এগুলো স্ক্রিপ্টে ছিল, কিন্তু হয়নি। সামান্য কিছু টেনশনের মুহূর্ত ছাড়া সেদিনগুলো কেটে গেছে নিরাপদেই। কিন্তু উনি সেই পুরনো স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে এসেছেন, আওড়ে যাচ্ছেন। এক দাঙ্গাবাজের মুখে আইন কানুন শান্তি নিয়ে কোনও কথাই শুনতে রাজি নই আমরা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ১) একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, একজন মুখ্যমন্ত্রী আইন নিজের হাতে নিয়ে দোষীদের উল্টো বেঁধে মারতে পারেন কি না? দুই, নিজের রাজ্যে কৃষকদের গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে যে গুন্ডা, তাকে উনি ওই উল্টো করে বেঁধে ধোলাই দেওয়ার কথা বলেননি কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আজ নয়, আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকে অস্বীকার করেছে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে, অস্বীকার করেছে দেশের সংবিধান বা আইনের শাসনকে। তাদের লক্ষ্য হল এক মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যেখানে রাজার ইচ্ছেয় অভিযোগ শোনা হয়, রাজাই বিচার করেন, রাজাই শাস্তি দেন। এবং শাস্তির সেসব প্রথাও মধ্যযুগীয়। উল্টো ঝুলিয়ে মারা, হাত পা কেটে নেওয়া, প্রকাশ্যে শূলে চড়ানো। অমিত শাহ বা আদিত্যনাথ যোগী সেই অন্ধকার সময়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি।