এই লেখা যখন পোস্ট হবে তখন উত্তর প্রদেশের চতুর্থ দফার ভোট (Up Assembly Polls) শেষের মুখে। উত্তর প্রদেশের প্রথম তিন দফা ভোটের বৈশিষ্ট্য হল, ভোট পড়ছে কম। তৃতীয় দফার ভোটে ভোট পড়েছে ৬০.৪৬ শতাংশ। ২০১৭তে যা ছিল ৬২ শতাংশ। প্রথম দুই দফার ভোটেও এই প্রবণতা ছিল। আগে মনে করা হত, ভোট বেশি পড়া মানে মানুষ কিছু বলতে চাইছে। আর কম পড়া মানে স্থিতাবস্তার পক্ষে ভোট। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা তা বলছেন না। তাঁদের মত বরং উল্টো। তাঁরা বলছেন, বিজেপি (BJP) সমর্থকদের একটা অংশ ভোট দিতে বেরোচ্ছেন না। এক সময় যেমন মনে হচ্ছিল বিজেপি উত্তরপ্রদেশে হৈহৈ করে জিতছে, তিন দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, যোগী-অখিলেশের (Yogi-Akhilesh) লড়াই একতরফা নয়, প্রায় সমানে সমানে। সেটা আরও বোঝা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) আচরণে। প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল একটি সাক্ষাৎকারে মোদী বলছেন, তাঁর দল কত ভালো ফল করবে পাঁচ রাজ্যের ভোটে। নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে মোদীর বিরুদ্ধে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
কিন্তু কী এমন কারণ ছিল যে নরেন্দ্র মোদীকে প্রচার বন্ধ হওয়ার পরে এমন ইন্টারভিউ দিয়ে এই ধরনের অভিযোগ তোলার সুযোগ করে দিতে হল! এখানেই শেষ নয়। আট বছর আগে আমদাবাদের বিষ্ফোরণের (Ahmedabad Blast) অপরাধীদের মধ্যে ৩৮ জনের ফাঁসীর আদেশ হয়েছে। সেই সিরিয়াল বিষ্ফোরণ ঘটাতে সন্ত্রাসবাদীরা রাস্তার ধারে রাখা সাইকেলে বিষ্ফোরক রেখে দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী এই কথা বলে, জনসভায় অখিলেশ যাদবের দলের প্রতীক সাইকেলের (Samajwadi Party’s election symbol) কথা মনে করিয়ে দিলেন শ্রোতাদের। এই ধরনের কথা মানায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে? আরেকটি জনসভায় দেখা গেল মোদী বলছেন, উত্তরপ্রদেশের (UttarPradesh) গরিব মায়েরা মোদীর নুন খেয়েছেন, ভোট তাঁকেই দেবেন। এই হল প্রধানমন্ত্রীর ভোট প্রচারের ভাষা। এটা কি মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়ের ভাষা? মনে তো হয় না।
অখিলেশ যাদব ও তাঁর দলের প্রতীক
কেন উত্তরপ্রদেশ নিয়ে বিজেপি এত মরিয়া? বলাই হয়, দিল্লি (Delhi) যাওয়ার রাস্তাটা উত্তরপ্রদেশ দিয়ে। দেশের ১৫ প্রধানমন্ত্রীর ৯ জন নির্বাচিত হয়েছেন এই রাজ্য থেকে। যে দু’টো আন্দোলন ভারতের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছে, মন্দির এবং মণ্ডল, দুই আন্দোলনেরই পীঠস্থান উত্তরপ্রদেশ। ৪০৩ বিধানসভা আসন, ৮০ লোকসভা আসন, এই রাজ্য থেকে নির্বাচিত হন ৩১ জন রাজ্যসভা সাংসদ। ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ৪০৩ আসনের মধ্যে ৩১২টি আসন পায়। ১৯৮০-র পর এটাই উত্তরপ্রদেশে কোনও রাজনৈতিক দলের ৩০০ পার করা জয়। ১৯৮০-র বিধানসভা ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে ৩০৯টি আসন পেয়েছিল। ৩৭ বছর বাদে ৩১২ আসন পেয়ে ইন্দিরার রেকর্ড ভেঙে দিলেন নরেন্দ্র মোদী। তবে ১৯৮০ তে ৩০৯ আসন পেলেও, ১৯৮৫তে কংগ্রেসের আসন কমে হয়েছিল ২৬৯। ফলে দেখার, ২০১৭-র রেকর্ড, ৩১২ আসন নিয়ে, ২০২২-এ বিজেপি কোথায় গিয়ে থামে! কারণ মাথায় রাখতে হবে ২০১৭-র এই রেকর্ড জয়ের পর, গত পাঁচ বছরে বিজেপি কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মণিপুর, গোয়ার মতো কিছু রাজ্যে দল বদলের খেলার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। আবার বিহারের মতো কিছু রাজ্যে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এলেও, উত্তরপ্রদেশের সেই ৩১২-র দাপটের কোনও ছাপ কোনও রাজ্যজয়েই ছিল না। বিজেপি ভয়টা এখানেই।
যোগী আদিত্য, অখিলেশ যাদব, নরেন্দ্র মোদি
আরও পড়ুন- পলিটিকালবিট: ভক্ত-যুগ কি আসছে?
২০১৬-এর ৮ নভেম্বর নরেন্দ্র মোদীর নোটবন্দি (Demonetization) ঘোষণা। তার প্রায় সাড়ে তিন মাস বাদে ২০১৭-র ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার ভোট (Up Assembly Polls)। ৩১২ আসন পেয়ে বিজেপি প্রচার করেছিল, নোটবন্দিতে (Demonetization) মানুষের সমর্থনের প্রমাণ এই বিপুল জয়। বিজেপি (BJP) সেবার কোনও মুখ্যমন্ত্রী-মুখ ঘোষণা করেনি নির্বাচনের আগে। নরেন্দ্র মোদীই ছিলেন মুখ। ফলে ওই বিপুল জয়কে মোদীর কৃতিত্ব হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। ফল প্রকাশের পর বিজেপি, অজয় সিং বিস্ট ওরফে যোগী আদিত্যনাথ, যিনি গেরুয়া পরেন এবং একটি লাইসেন্সড রিভলভার ও একটি রাইফেলের মালিক, তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে। এবারে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী নন, মুখ যোগী আদিত্যনাথ। হতে পারে বিজেপির এই সিদ্ধান্তের পিছনে বাংলায় মোদীকে মুখ করে নির্বাচন লড়ার এবং পরাজয়ের অভিজ্ঞতা কাজ করেছে।
বিজেপি ভালো করেই জানে, ২৪-এ দিল্লিতে ক্ষমতায় আসতে হলে ২২-এ উত্তর প্রদেশ চাই। তাছাড়া সামনে জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মোট ভোটের মূল্য ৮৩, ৮২৪। রাষ্ট্রপতি পদে নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে হলে বিজেপিকে এই উত্তরপ্রদেশে যথেষ্ট ভালো ফল করতে হবে। উত্তরপ্রদেশে ২০১৭তে যে ফল হয়েছিল তাতে বলাই যায় বিরোধীরা কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। তার পুনরাবৃত্তি এবার হবে না। ২০১৭-র থেকে অনেকটাই ভালো ফল করবে সপা এবং কংগ্রেস। কতটা ভালো করবে তা জানতে অবশ্য আমাদের ১০ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।