আজ ২৬ জানুয়ারি। প্রজাতন্ত্র দিবস যেমন, তেমনই দিনটিকে সংবিধান দিবসও বলা যায়। আমাদের সংবিধান একবার খুব বড় সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিল জরুরি অবস্থার সময়। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তবে কিছু দিনের মধ্যেই ইন্দিরা নিজেই মানুষের রায় চাইলেন ভোট ঘোষণা করে। ভোটে মানুষ তাঁর দল এবং তাঁকে পরাজিত করে জানিয়ে দিয়েছিল, সংবিধানে তিনি যে সব অন্যায় পরিবর্তন করেছিলেন, তাতে ভারতবাসীর সায় নেই।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক, জ্ঞান প্রকাশ, তাঁর ‘ইমার্জেন্সি ক্রনিকলস’ বইয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জমানার সঙ্গে ইমার্জেন্সির সময়ের ইন্দিরা গান্ধীর একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় তিনি বলেছেন, এখন আমাদের দেশে কোনও আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। কোনও সেন্সরশিপ চালু নেই। আইনসম্মত ভাবে মৌলিক আধিকার সংক্রান্ত আইনগুলিকে অকেজো করে রাখা হয়নি, যেমন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নরেন্দ্র মোদিকে এমন এক জায়গায় সফল ভাবে পৌঁছে দিয়েছে, যে জায়গায় ইন্দিরাকে যেতে হয়েছিল জরুরি অবস্থা জারি করে। যখন সাংবিধানিক গণতন্ত্র ইন্দিরার কাছে নতজানু হয়নি, তিনি তখন গণতান্ত্রিক শক্তিকে নত করতে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আজ আদালত, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতি দল কেউই দৃশ্যত আক্রান্ত নয়, কিন্তু দেখে মনে হয় যেন প্রায় সেই অবস্থায় ফিরে গিয়েছে দেশ। গণতন্ত্রের পাহারাদের ভূমিকায় তাঁরা যেন সক্রিয় হতে ইচ্ছুক নন। ইন্দিরার মতোই নরেন্দ্র মোদিও দলের এক এবং অদ্বিতীয় নেতা। বিজেপির মতো একটা রাজনৈতিক দল, যে দলে এক সময় দেশ জুড়ে একগুচ্ছ জাতীয় স্তরের নেতা ছিলেন, সেই দলটা এখন একজন সুপার হিরোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে । জরুরি অবস্থায় যেমন ইন্দিরা ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী, এখন ঠিক তেমনই নরেন্দ্র মোদি সর্বময় কর্তা। তাঁরই ছবিতেই ছেয়ে গেছে দেশ। শুধু তাঁরই নামে স্লোগান। শুধু তাঁরই লাইভ অনুষ্ঠান টিভি জুড়ে। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। কোনও প্রশ্নের উত্তর দেন না। তিনি সরাসরি কথা বলেন রেডিওর মধ্যে দিয়ে, টিভির মাধ্যমে। ঘন ঘন টুইট করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো। ইন্দিরার মতোই এক্জিকিউটিভ পাওয়ার এখন তাঁর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তার সঙ্গে রয়েছে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা এবং বিরোধী মতকে দেগে দেওয়া দেশদ্রোহী বলে। তাঁর বইয়ে এমনই লিখেছেন জ্ঞান প্রকাশ।
কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির শেষ দিনে, ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর বাবাসাহেব আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘একটা চিন্তা আমার মনে আসছে! ভারতের এই গণতান্ত্রিক সংবিধানের ভবিষ্যৎ কী হবে? দেশ কী পারবে তাকে রক্ষা করতে, না কি সে পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলবে? অতীতেও বার বার দেখা গিয়েছে ভারতের ভিতরের কোনও শক্তির সহায়তায়ই বাইরের শক্তি ভারতের স্বাধীনতা হরণ করেছে। আম্বেদকার বক্তব্যের বিষয় ছিল, তিনি ভয় পাচ্ছেন, ভারতেও এত রকমের রাজনৈতিক সংগঠন আছে যাদের অনেকের বিশ্বাস-ধারণা গণতন্ত্রের ধারণার বিপরীতমুখী। এই যে গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী বিশ্বাস তারা কি তাদের সেই বিশ্বাসকে, তাদের সেই রাজনেতিক আদর্শকে দেশের আগে, সংবিধানের আগে স্থান দেবে? যদি ভবিষ্যতে কোনও পরিস্থিতিতে দেশের আগে, সংবিধানের আগে তারা তাদের বিশ্বাসকে, আদর্শকে স্থান দেয়, তাহলে তারা একনায়কতন্ত্রকেই রাস্তা করে দেবে। ভারতের সংবিধান হেরে যাবে।
আরও পড়ুন: পলিটিকালবিট: বিবেকানন্দ নিরাপদ নন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে
জন স্টুয়ার্ট মিলকে উদ্ধৃত করে আম্বেদকার সেদিন বলেছিলেন, কোনও তথাকথিত মহান নেতার পায়ের কাছে যেন কেউ নিজের স্বাধীনতাবোধকে সমর্পণ না-করে। মহান নেতার প্রতি অনুগত হও, কিন্তু সেই আনুগত্যের সীমা যেন থাকে। এরপর আম্বেদকার বলেছিলেন, ভারতে ভক্তি, বীরপূজার একটা সংস্কৃতি আছে। ধর্মে ভক্তি নিয়ে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু রাজনীতিতে ভক্তি, বীরপূজা, একনায়কতন্ত্রকে ডেকে আনে। আজ আমরা ভয়ে ভয়ে আম্বেদকারের এই লেখা পড়ি আর ভাবি, তাহলে কি আমরা ধীরে ধীরে ভক্ত যুগের দিকে এগোচ্ছি?
এক সময় চিলির প্রেসিডেন্ট সমাজতন্ত্রী নেতা সালভাদর আলেন্দেকে খুন করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল সিআইয়ের বিরুদ্ধে। সেই চিলিতে ফের পরিবর্তন। বামপন্থী নেতা ৩৫ বছরের গ্যাব্রিয়েল বোরিকের নেতৃত্বে। তিনিই হচ্ছেন নতুন প্রেসিডেন্ট। তাঁর ২৪ জনের নতুন মন্ত্রিসভায় ১৪ জনই মহিলা। এটা মন্ত্রিসভায় মহিলাদের উপস্থিতির বিশ্ব রেকর্ড । মন্ত্রিসভার গড় বয়স ৪৯। মন্ত্রিসভায় আছেন আলেন্দের নাতনি মায়া ফার্নানডেজ। ২০২০ তে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, ৩৭ বছরের জাসিন্ডা আর্ডেন যে ২০ জনের মন্ত্রিসভা গড়ে ছিলেন, যেখানে উপ প্রধানমন্ত্রী সহ তিন জন ছিলেন সমকামী, মোট ৮ জন মহিলা, সেটাকে একটা বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হয়েছিল। চিলি এই পথে আরও বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। ভারত, যে দেশ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও একটা মহিলা সংরক্ষণ বিল পাস করাতে ব্যর্থ হয়, তারা কি কিছু শিখবেন চিলি বা নিউজিল্যান্ড থেকে?
গিরীন্দ্রশেখর বসুর জন্ম ১৮৮৭ সালে। মনোবিদ্যা বিষয়ে পণ্ডিত, ভারতের অন্যতম এক সাইকোঅ্যানালিস্ট ছিলেন গিরীন্দ্রশেখর। ফ্রয়েডের সঙ্গে তাঁর ছিল নিত্য চিঠি চলাচালি। গিরীন্দ্রশেখরের লেখা ছোটদের বই লালকালো, কেল্টুগুল্টু আজও শিশুরা মুগ্ধ হয়ে শোনে। তবে তাঁর লেখা পুরাণ প্রবেশ বই তত পরিচিত নয়। ভারতীয় পুরাণ নিয়ে এই বইয়ে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করেছেন গিরীন্দ্রশেখর। খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন পুরাণের সত্য। এই বই পড়তে গিয়ে দেখলাম, ইংরেজি ‘abbreviation’-এর তিনি বাংলা করেছেন, ‘কুঞ্চিকা’। এখানে পৌরাণিক কাল নিয়ে আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন ‘নিমেষ’ আর ‘মুহূর্তের’ মধ্যে কত ফারাক। ১ নিমেষ = ১/৫ সেকেন্ড। আর এক মুহূর্ত= ৪৮ মিনিট। প্রায় এক ঘণ্টার কাছাকাছি। রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক/ তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি…সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি কখন পিছু পিছু/ এসেছে মোর চির পথের সাথী। ফলে নিমেষের অর্থ বোঝা গেল। কিন্তু আমরা তো এটাও বলি, লোকটা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল! আবার, এক নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল, তাও বলি। অথচ নিমেষ আর মুহূর্তের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিরাট ফারাক। এখন থেকে তাহলে বলতে হবে, এক মুহূর্তে বেলেঘাটা থেকে পোদ্দার কোর্ট চলে এলাম, না না উড়ে নয়, অটোতে! আগামী ৩০ জানুয়ারি গিরীন্দ্রশেখরের জন্মদিন।
শেষ