নরেন্দ্র মোদিকে আজকাল দেখলে হীরক রাজার দেশের সেই জাদুকরের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে, হাতে আগুন ছড়ানো যন্ত্র নিয়ে উনি চিৎকার করে বলছেন আমি একা, আমি একক, আমি একমেবাদ্বিতীয়ম গবেষক! দেশে আর কেউ থাকবে না, সবটা কেবল ওনাকে ঘিরে হবে। উনি যেটাকে দুর্নীতি বলবেন সেটা দুর্নীতি, উনি যেটাকে সমাজসেবা বলবেন সেটা সমাজসেবা, উনি যেটাকে উন্নয়ন বা বিকাশ বলবেন, সেটাই বিকাশ, উনি যাকে দেশদ্রোহী বলবেন সে-ই দেশদ্রোহী। এটাই এখন চল হয়ে গেছে। উনি সুরটা বেঁধে দিচ্ছেন, বাকিরা সেই সুরে সুর মেলাচ্ছেন। পারকালা প্রভাকর একজন অর্থনীতিবিদ, যিনি আবার আমাদের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের স্বামীও বটে, তিনি মাত্র গতকাল বলেছেন, এই ভারতের নয়, এই শতাব্দীর নয়, এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় স্ক্যাম, সবচেয়ে বড় ঘোটালা, সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধ উঠে আসছে এই নির্বাচনী বন্ডের কাহিনি থেকে। প্রথমত দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েই দিয়েছে এই নির্বাচনী বন্ড অসাংবিধানিক। মানে এই নির্বাচনী বন্ড থেকে যার যা আমদানি হয়েছে, যে রাজনৈতিক দলের কাছে যে টাকা গেছে তার পুরোটাই বেআইনি।
প্রথমে এই বন্ডের যাবতীয় তথ্য চেপে রেখেছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, তাদের বলার পরেও তারা জানিয়েছিল যে তারা সব তথ্য জমা করতে পারবে না। আবার ধমক খেয়ে তারা তথ্য জমা করল কিন্তু সেই তথ্য ছিল অসম্পূর্ণ। তা থেকে কোন কোম্পানি, কোন শিল্পপতি কাকে কত টাকা দান করেছে তা জানা যাচ্ছিল না। ওই বন্ডে একটা ইউনিক নাম্বার আছে, যা এমনিতে চোখে পড়বে না কিন্তু বন্ডটা ইউভি আলোর তলাতে রাখলে দেখা যাবে। সেই নম্বরটা চেপে গিয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। আবার ধমক খেয়ে সেটাও বের করে দিল সুড়সুড় করে, যা দেখে পরিষ্কার যে এক খুল্লমখুল্লা লুঠতরাজ চলছিল দেশজুড়ে, বিজেপির নেতৃত্বে চলছিল এক তোলাবাজি। তো নির্মলা সীতারামন কী করছিলেন? আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমাদের অর্থমন্ত্রী কিছুই জানতেন না, ওনার অজান্তেই এসব ঘটে গেছে, ওনার অজান্তেই তোলাবাজি চলছিল, ওনার নির্দেশ ছাড়াই যাবতীয় তথ্য চেপে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, সুপ্রিম কোর্ট থেকে আসা নির্দেশের পরেও? এর সম্ভাবনা তখনই থাকে যখন আমাদের অর্থমন্ত্রী আসলে এক কাঠপুতুল, তাঁকে যেটুকু কাগজ দেওয়া হয়, যা দেখতে বলা হয় উনি তাই বলেন, যা করতে বলা হয় উনি তাই করেন। এক জেএনইউ-র মেধাবী ছাত্রী দেশের অর্থমন্ত্রী একজন কাঠপুতুল? এটা মেনে নিতে হবে?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | টিকিট না পাওয়া এ বাংলার অভিমানী ও অভিমানিনীরা?
সেই তাঁর স্বামী বলছেন, আচ্ছা তাঁর স্বামী এই তকমাটাও বাদই দিলাম, দেশের একজন অর্থনীতিবিদ, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত যিনি বিজেপিরই স্পোকসপার্সন ছিলেন সেই পারাকালা প্রভাকর বলছেন, এই নির্বাচনী বন্ড দুনিয়ার সবথেকে বড় স্ক্যাম, সবচেয়ে বড় ঘোটালা। এদিকে আমাদের মোদিজি যত্রতত্র বিরোধীদের দুর্নীতিবাজ, বিরোধী প্রত্যেক নেতাদের লুঠেরা বলেই চলেছেন এবং এক্কেবারে ওনার নির্দেশেই বিরোধী নেতাদের, সমাজকর্মীদের, সাংবাদিক, লেখক প্রতিবাদীদের জেলে পোরা হচ্ছে। এখন তো সব হিসেব সামনে, কীভাবে শিল্পপতিদের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে ইডি বা সিবিআই, তারপর তাঁরা কোটি কোটি টাকা ডোনেট করেছেন বিজেপির ফান্ডে। হ্যাঁ, অন্যদের অ্যাকাউন্টেও গেছে, কিন্তু এটা কি হলফ করে বলা যায় যে সেটাও বিজেপির পরিকল্পনার অঙ্গ নয়। তা না হলে লটারি কিং ভুয়ো কোম্পানি সবথেকে বেশি ৫৪০ কোটি টাকা তৃণমূলকে, ৫০০ কোটি টাকা ডিএমকে-কে দেবে কেন? তৃণমূল এই লটারি কিং-কে কোনও ব্যবসা দিতে পেরেছে? কোনও ব্যবসা দেওয়া সম্ভব? সারা রাজ্যে লটারি বিক্রির ব্যবস্থা? যারা ওই লটারি বিক্রি করছেন তাঁরা সব বিনা পয়সায় করছেন নাকি? তাঁদের অফিস ঘরদোর সরকার করে দিয়েছে নাকি? এর আগে আমাদের রাজ্যে লটারি বিক্রি হত না? তাহলে একটা সরল কথা তো মাথাতে আসবেই যে মমতা ব্যানার্জির সরকার ওই লটারি কিং-কে কোন এমন সুবিধে দিয়েছিল যার জন্য সে দেশের দুই বিরোধী দলকে সব মিলিয়ে প্রায় ১১০০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড দিয়ে দিল? বিজেপি তো ভালো করেই জানে তামিলনাড়ু আর বাংলাতে তাদের এখনও তেমন জায়গা হচ্ছে না, কাজেই এর পিছনে পাকা মাথার পরিকল্পনা থাকাটা কি অসম্ভব?
বিজেপির মোডাস অপারেন্ডি, কাজ করার ধরনও পরিষ্কার, তাদের মোটিভ, কেন এই কাজ করছে? কী লাভ হবে এই কাজ করে সেটাও খুব পরিষ্কার। ধরুন কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি, কেজরিওয়ালের দলের ভিত্তিই ছিল ফাইট এগেনস্ট করাপশন, কাজেই সেই দলের ক’টা মাথা এবং স্বয়ং কেজরিওয়ালকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করলে গোটা দলটাকেই ছারখার করে দেওয়া যাবে। জানা গেছে পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি নামের একজনের বয়ানের ভিত্তিতে ওনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসুন দেখা যাক এই রত্নটি কে? দিল্লি লিকার মামলায় গত নভেম্বর ২০২২-এ এই ভদ্রলোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ইনি অরবিন্দ ফার্মা নামের এক কোম্পানির ডিরেক্টর, এনার মদ বিক্রির লাইসেন্স আছে, আরও কিছু ব্যবসা আছে। তো এনাকে গ্রেফতার করেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে এই মামলাতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কোনও ভূমিকা আছে কি না? আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন কি না? উনি বলেছিলেন না, এই মামলার সঙ্গে কেজরিওয়ালের কোনও যোগাযোগ নেই। কিছুদিন পরেই তিনি স্বীকার করেন যে হ্যাঁ উনি কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করে লিকার পলিসি নিয়ে কথাও বলেছেন। এবং হাতেনাতে ফল, তারপরেই তিনি মে ২০২৩-এ অসুস্থতার জন্য জামিন পেয়ে যান। গল্প এখানেই শেষ নয়, এই পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি ২০২২-এ জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে ৪.৫ কোটি টাকা করে দু’বার বন্ড কিনেছেন এবং বলাই বাহুল্য যে তা গিয়েছে বিজেপির অ্যাকাউন্টে। এখানেই শেষ নয়, গ্রেফতার হবার পরে অরবিন্দ ফার্মা, ওনার ওষুধের কোম্পানি ৫ কোটি টাকার ইলেকশন বন্ড দিয়েছে বিজেপিকে। নভেম্বর ২০২৩-এ ছাড়া পাওয়ার পরে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ওনার কোম্পানি মাত্র ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপিকে দিয়েছে। এবং এইসব তথ্য তো এখন পাবলিক ডোমেনে আছে। তার মানে কেবল ফান্ডে টাকা নেওয়া নয়, এই বন্ডকে ইডিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী নেতাদেরও জেলে পোরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা কিছু তথ্য পাচ্ছি, কে দিচ্ছে এসব তথ্য? ইডি থেকে এসব তথ্যর সত্যতা কতটা? নাকি পুরোটাই মিথ্যে। এই যে অনুব্রত মন্ডল জেলে? কার লাভ? কার ক্ষতি? এখনও ঠিক কী পাওয়া গেছে, যা পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে চার্জশিট দিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন? নাকি আসলে সবটাই আইওয়াশ? খবর এল পিনারাই ভিজয়নের মেয়েকেও ইডি সমন পাঠিয়েছে, ঠিক নির্বাচনের আগে।
যে দলের নামে সেভাবে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই, সেই দলের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, এটাই তো কেরালাতে প্রচার করা হবে? লাভ কার? ওদিকে মাত্র ২৮ জুন ২০২৩-এ ভোপালে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, এনসিপি-র পাঁচজন নেতা, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজবল, হাসান মুসরিফ, ধনঞ্জয় মুন্ডের উপর যে দুর্নীতিবাজ, তাদের দুর্নীতির পরিমাণ ৭০ হাজার কোটির চেয়ে কিছু বেশিই হবে। চার দিন পরে মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার আর তার অনুগামীরা এনসিপি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিজেপি শিবসেনা জোটে যোগ দিলেন। চারদিন আগে প্রধানমন্ত্রী আসলে ধমকি দিচ্ছিলেন, প্রকাশ্য ধমকি, আরে ও গাঁওবালো, গব্বর সে তুঝে এক হি আদমি বঁচা সকতা হ্যায়, আউর ও হ্যায় খুদ গব্বর। উনি আসলে গ্যারান্টি দিচ্ছিলেন, আমাদের দিকে এসো, তারপর যত পারো টাকা কামাও, ইডি, সিবিআই তো বিরোধীদের জন্য, আমাদের দিকে চলে এলে ওদের সাহস কি তোমার দিকে চোখ তুলেও তাকাবে। কী কী মামলা চলছিল অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে? মানি লন্ডারিং, ব্যাঙ্ক ফ্রড, বেআইনি জমির হস্তান্তর এবং এমনকী ড্রাগ স্মাগলার ইকবাল মির্চির সঙ্গে ওনার লেনদেনের কথাও ওই অভিযোগের মধ্যেই আছে। একই অভিযোগ আছে প্রফুল্ল প্যাটেলের ওপরে, উনি নাকি দাউদের কিছু গ্যাংস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। হাসান মুসরিফ, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল যে কোনওদিন গ্রেফতার হতে পারতেন, কিন্তু ওঁরা সোজা ঢুকে গেলেন বিজেপির ওয়াশিং মেশিনে। যাঁদের বিরুদ্ধে দেশের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগ আনলেন, তাঁরা এখন মহারাষ্ট্র সরকারের ক্যাবিনেট মিনিস্টার। অজিত পাওয়ার উপমুখ্যমন্ত্রী, হাসান মুসরিফ শিক্ষামন্ত্রী, ধনঞ্জয় মুন্ডে কৃষিমন্ত্রী, ছগন ভুজবল ফুড অ্যান্ড সিভিল সাপ্লাই আর কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স-এর মন্ত্রী, প্রফুল্ল প্যাটেল রাজ্যসভার সাংসদ। তৃণমূলের কাউকে কাউকে কি ম্যানেজ করা গেছে? কেউ কেউ বলছেন হ্যাঁ, কিছু বৃদ্ধ নেতা আর জেলে যেতে চান না, তাঁরা যোগাযোগ রাখছেন, কিন্তু মহুয়া মৈত্র? না, বলিয়ে কইয়ে এই মহিলা যখন তখন সংসদের ভেতরে ধুয়ে ছেড়ে দেন, আড়ং ধোলাই যাকে বলে, সে সব বক্তৃতা ভাইরাল হয়ে যায়, এবার একে সামলাতে হবে। পাওয়া গেল কিছু ব্যক্তিগত জীবনের শত্রু তাঁদেরকে দিয়ে নানান মামলা, সংসদ থেকে বহিষ্কারও করা হল, কিন্তু সেই মহুয়া আবার জিতে আসবেন, এটা সহ্য হচ্ছে না। মহারানি সামলাতে পারবেন বলে মনেও হচ্ছে না, কাজেই পারলে নির্বাচনের আগেই জেলে পোরো। ১৬০০০ কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা দল আর তাদের নেতা অন্যদের দিকে আঙুল তুলছে, আসলে তাদের দুর্নীতি ঢাকতেই বিরোধীদের জেলে পুরতে চাইছে, তাই নির্বাচনের আগেই মহুয়া মৈত্রকে জেলে পোরার নীল নকশা রেডি, জানিয়ে রাখলাম, মিলিয়ে নেবেন।