২০২৪-এর সেমিফাইনালের রায় আপাতত ইভিএমে কয়েদ হয়ে রয়েছে, তিন তারিখে বের হবে এবং তার বিরাট প্রভাব পড়বে ভারতীয় রাজনীতিতে। দলের ভেতরে, জোটের সম্পর্কে, আগামী নির্বাচনের উপর বিরাট প্রভাব পড়বে। প্রথমেই মাথার ভেতর থেকে ওই হাজার বার বলা ও শোনা মিথটাকে সরিয়ে দিন। বহুবার শুনেছেন রাজ্যের ভোট আলাদা, কেন্দ্রের ভোট আলাদা, মানুষ রাজ্যে একরকম ভোট দিলেও কেন্দ্রে তা বদলে যায়। হ্যাঁ, ২০১৮তে বা তার আগেও ক’বার এরকম হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল এক ব্যতিক্রম এবং তার স্পষ্ট কারণ ছিল। ২০১৮তে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিজেপির হার সারা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধেই গিয়েছিল, তার প্রভাব, সুস্পষ্ট প্রভাব দেখাই যেত। কিন্তু মধ্যে পুলওয়ামা ঘটে গেল, ঘটানো হল বা ঘটনার সুযোগ নেওয়া হল। জঙ্গি জাতীয়তাবাদের উপর ভর করে বিজেপি আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু সেই ঘটনা বার বার ঘটানোর সম্ভাবনা নেই বা সেই সম্ভাবনার কথা পরে আলোচনা করা যাবে। এতগুলো কথা বলার কারণ হল এটা বোঝানো যে বিধানসভায় যে মানুষেরা ভোট দিলেন, যে কারণে দিলেন, তা তিন মাসের জন্য উবে যাবে না। বিশেষ করে নির্বাচনে বিজেপির সামনের চেহারা তো প্রধানমন্ত্রীই, তিনি তো ওনার নাম করে, ওনার সরকারের কাজের কথা বলেই ভোট চেয়েছেন। কাজেই যে মানুষ তাঁকে ভোট দিল না, অবস্থা একই থাকলে, আবার পুলওয়ামা জাতীয় কিছু না হলে তিন মাস পরে সেই মানুষ ওনাকেই আবার ভোট দেবেন কেন? কাজেই এই পাঁচ রাজ্যের প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে।
কীভাবে সেই প্রভাব পড়বে, কোন ফলাফল হলে কেমন প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আলোচনায় আসছি। কিন্তু বলে রাখা দরকার যে কেবল সামনের নির্বাচনেও নয়, আপাতত দেশের দুই নির্বাচনী জোট, এনডিএ আর ইন্ডিয়া জোটের উপরেও বিরাট প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে দলের ভেতরে, বিজেপি এবং কংগ্রেস দলের ভেতরেও বিরাট প্রভাব পড়বে। প্রথমে আসুন এক সাধারণ ফলাফল যা ওপিনিয়ন পোল বা সাংবাদিকদের গ্রাউন্ড রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে সেটা বলে নেওয়া যাক। মিজোরামের ওপিনিয়ন পোল বা সাংবাদিকদের ইনপুট বলছে ওখানে এবারে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট একটু হলেও ব্যাকফুটে। সেখানে নতুন উঠে আসা জোরাম পিপলস মুভমেন্ট বেশ কিছুটা এগিয়ে হলেও তারা সম্ভবত গরিষ্ঠতা পাবে না, এর আগে এমএনএফ এনডিএ-তে ছিল, মণিপুর এপিসোডের পরে তারা একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে, বিজেপির সঙ্গে রাজ্যে জোট নয় জানিয়েই নির্বাচনে নেমেছে। কংগ্রেসও লড়ছে, মুখোমুখি কংগ্রেস আর এমএনএফ-এর লড়াই হলে এবার কংগ্রেস জিতে যেত, কিন্তু জোরাম পিপলস ফ্রন্ট আসায় সেটা হবে না। রাজীব গান্ধীর প্রাক্তন দেহরক্ষী লালডুহোমার এই দলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট সম্ভব এবং ওই জোটের হাতেই ক্ষমতা যাবে। বিজেপি একটা আসন পেলেও পেতে পারে। মধ্যপ্রদেশ, শিবরাজ সিং চৌহান যদি রাজ্যের ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মাঠে নামতেন, তাহলে ছবিই পাল্টে যেত। তবুও, মানে মুখ্যমন্ত্রী মুখ না হয়েও তিনি শেষ মুহূর্তে কংগ্রেসের একেবারে কেকওয়াক রুখেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কান পেতে শোনো হাতুড়ি এখনও শ্রমিকের গান গায়
মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস জিতবে, কিন্তু সেটা কর্নাটকের মতো বিরাট গরিষ্ঠতা নিয়ে নয়। ২৩০ বিধানসভার ১১৮-১২৫ এর মধ্যেই কংগ্রেস আটকে যাবে, কিন্তু হারবে বিজেপি। ছত্তিশগড়ে বিজেপি নেতারাও জিতবেন এমন দাবি করছেন না, কিন্তু আগেরবারের চেয়ে কিছু বেশি আসন তো পাবেন। এখানে এবং মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল আর কমল নাথ। দুজনেই দলের হাল ধরেছেন। ছত্তিশগড়ে ভূপেশ বাঘেলের সুবিধে হল তাঁর ৫ বছরের কাজ। রাজস্থান পেন্ডুলামের মতো দোলে, একবার কংগ্রেস জেতে অন্যবার বিজেপি। এবারেও তেমনটাই হবে বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু দু’ তিনটে বিষয় এই পেন্ডুলাম দোলনকে আটকে দিলেও দিতে পারে। প্রথম ফ্যাক্টর বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, তাঁকে প্রায় সরিয়ে রেখেই বিজেপি মাঠে নেমেছে, বসুন্ধরার অনুগামী বা ওনাকে টিকিট দেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু মহারানিকে সন্মান দেওয়া হচ্ছে না এই খবর মুখে মুখে। দু’ নম্বর ফ্যাক্টর হল অশোক গেহলতের চিরঞ্জীবী প্রকল্প, এত ভালো স্বাস্থ্য প্রকল্প দেশে আর নেই। আর গেহেলত ওল্ড পেনশন স্কিম লাগু করার কথা বলেছেন। বিজেপি এ নিয়ে চুপ, অশোক গেহলত নিজেও বেশ পপুলার, সব মিলিয়ে তিনি ওই পেন্ডুলামকে রুখে দিতে পারেন বলেই লড়াই জমে গেছে। কিন্তু অ্যাডভানটেজ বিজেপি। তেলঙ্গানার রাজনীতি আজ থেকে এক বছর আগে বিজেপি বনাম বিআরএস মনে হচ্ছিল, কে চন্দ্রশেখর রাও সেটা মনে করেই দেশের বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে এক বিজেপি বিরোধী জোট তৈরির কথা বলে বেড়াচ্ছিলেন। নীতীশ কুমার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন, কিন্তু হঠাৎ হাওয়া ঘুরতে শুরু করে আর তেলঙ্গানা লাগোয়া কর্নাটকে বিপুল জয় সেই হাওয়াকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে তেলঙ্গানাতে বিজেপি কমতে থাকে, কংগ্রেস বাড়তে থাকে, বিপদ বুঝেই বিআরএস-এর কে চন্দ্রশেখর রাও বিজেপি বিরোধী জোট ইত্যাদির কথা বলা বন্ধ করেছেন। এখন যে কোনওভাবে গদি বাঁচাতে নির্বাচনের পরে প্রয়োজনে বিজেপির সমর্থন নিতে তাঁর কোনও অসুবিধে নেই এবং বিজেপিও সেটাই বুঝে কংগ্রেসকেই তাদের মূল শত্রু হিসেবে ধরে নিয়েই প্রচার চালাচ্ছে। তেলঙ্গানাতে শাসকদল সম্পর্কে দুটো কথা বলার পরেই প্রধানমন্ত্রী দশ মিনিট খরচ করছেন কংগ্রেসকে নিয়ে।
কিন্তু যে হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছিল তা এখন প্রবল, কংগ্রেস জিতবে, এটাই এখন সাধারণ পার্সেপশন। শেষের দিকে কিছু ওপিনিয়ন পোলও সেই কথাই বলছে, আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা যাঁরা সরেজমিনে আছেন, তাঁরাও বলছেন হাওয়া কংগ্রেসের দিকে। তার মানে এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির খাতায় যেতে পারে একমাত্র রাজস্থান। কংগ্রেস সরকার তৈরি করতে পারে তিন রাজ্যের সরকার, মিজোরামে জোরাম পিপলস ফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট সরকার হতে পারে। যদি এরকম হয় তাহলে জগৎ প্রকাশ নাড্ডাকে সামনে রেখে অমিত শাহের নির্বাচনী রণকৌশল নিয়ে বিরাট প্রশ্ন উঠবে। কর্নাটকে লিঙ্গায়েত নেতা ভি এস ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরিয়ে রেখে অমিত শাহ যা করতে চেয়েছিলেন তা ব্যাকফায়ার করেছে। ক’দিন আগে সেই কাজের ক্ষতিপূরণ হিসেবেই ওনার ছেলেকে রাজ্যের সভাপতি করতে হয়েছে। একই পরিবারের একজন বিজেপি সংসদীয় কমিটি, রাজ্যের সভাপতি, এবং সাংসদ তিনটে পদ গেছে, যা বিজেপিতে অবাক করার মতো ব্যাপার। এই তিন রাজ্যে হারলে মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান, ছত্তিশগড়ে রমন সিং, তেলঙ্গানাতে বন্দি সঞ্জয় কুমারেরা কি চুপ করে বসে থাকবেন? দিল্লিতে যাঁরা নিজেদেরকে বঞ্চিত বলেই মনে করছেন, তাঁরা মুখ খুলবেন না? রাজস্থানে জয় এলেও তা তো বিরাট জয় আসবে না, তখন বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া কোন খেলা দেখাবেন? তাঁকে বাদ দিয়ে সরকার তৈরি হবে? বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া এবারের নির্বাচনে খুব নির্দিষ্ট করে জনা ৫০ বিধায়ক, যাঁরা তাঁর অনুগত তাঁদের আসনেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এই ৫০ জন অনুগামীকে নিয়ে বসুন্ধরা তাঁর পাউন্ড অফ ফ্লেস দাবি করবেন না? ক’দিন পরেই লোকসভার নির্বাচন, যে ক’জন সাংসদকে রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে দাঁড় করানো হয়েছে, তার ৮০ শতাংশ হারবে, তাঁরাই ক’দিন পরে আবার নির্বাচনে দাঁড়াবেন? কোন মুখে দাঁড়াবেন? মধ্যপ্রদেশ চলে গেলে, গোয়ালিয়র চম্বলে খারাপ রেজাল্ট হলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া আর তাঁর অনুগামীদের কী হবে?
এতদিন চুপ করে মোদি-শাহের সব কথা, সব নির্দেশ মেনে নিয়েছে আরএসএস, সেখানেও মোদি বিরোধী এক বিরাট লবি তৈরি হয়েছে, তাঁরা মুখ খুলবেন। আর যদি রাজস্থানেও হেরে যায় বিজেপি, তাহলে দলের বেশ কিছু নেতা একসঙ্গে বিরোধিতা শুরু করবে, জানেন অমিত শাহ। কী দিয়ে সামলাবেন? ইডি? সিবিআই? উত্তর পূর্বাঞ্চলে বেশ এগোচ্ছিল, মণিপুরের ঘটনা বিজেপিকে সারা উত্তরপূর্বেই কোণঠাসা করেছে, মিজোরামের হার বিজেপির কাছে বিরাট ধাক্কা হবে। তিপ্রা মথা আদিবাসী মনোভাব বুঝে সরে গেলে ত্রিপুরাতেও হারবে বিজেপি। অন্যদিকে ধরুন মিজোরামে এমএনএফ জিতল, মধ্যপ্রদেশ রাজস্থানে বিজেপি জিতে গেল, তেলঙ্গানাতে চন্দ্র শেখর রাওয়ের বিআরএস জিতল, তাহলে তিনজন নেতার কথা কেউ আর মুখেও আনবে না। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান, বয়স ৬৪। ছত্তিশগড়ে রমণ সিং, বয়স ৭১। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, বয়স ৭০। এনারা কি এই সহজ তথ্যটা জানেন না, জেনে চুপ করে বসে আছেন, রাজনীতিতে ৬৪, ৭০, ৭১ কোনও বয়সই নয়, আর দেহত্যাগ করার আগে পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা, আসন ছেড়ে দেবার উদাহরণ নেই বললেই চলে। ক্ষমতা আবার ফিরে আসতে পারে এই কথা মনে করার পরে আমরা এক রাজনীতিবিদের অ্যাকিউট ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম সেরে যেতে দেখেছি, আর এখানে রমন সিং, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া বা শিবরাজ সিং চৌহান তো রীতিমতো কর্মক্ষম। অতএব দর্শকবৃন্দ, ৩ তারিখে ফলাফল বের হবে, কিন্তু তার প্রভাব থাকবে লোকসভার নির্বাচন জুড়ে, মিলিয়ে নেবেন।