বেশ কিছু বছর আগে এক নামকরা কাগজের বাঙালি মালিকের হা-হুতাশ এখনও বহু মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। তাঁর দুই গাবলুস গুবলুস পুত্র সক্কালবেলায় মর্নিং ওয়াকের পরে বাড়ি ফেরার পথে পেটপুরে জিলিপি সিঙাড়া খেয়ে ফিরতেন। সেই মালিকের আক্ষেপ ছিল, বলতেন, দেখেছ দেখেছ, মর্নিং ওয়াকের পরে এসব কেউ খায়। কংগ্রেসের ব্যাপারটা খানিক সেই রকম। হঠাৎ জি-জান লগাকর দৌড়তে শুরু করে, তারপর এসি হোটেলের বিছানায় নাক ডেকে ঘুম। এদিকে দেশে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নরেন্দ্র মোদি টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন থাকেন ইলেকশন মোডে। দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুন ওনার একটা চোখ দেশের নির্বাচনের উপরে থাকে। তিনি দেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি এক কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রচার করেছেন, হায়দরাবাদ কর্পোরেশনে জিতে উঠতে পারেননি, কিন্তু বিজেপির ভোট আর আসন দুই বেড়েছে। সেই মোদিজির বিরুদ্ধে কংগ্রেস? সেই গব্বরের ডায়ালগ, বহত না ইনসাফি হ্যায়। টাইম মেশিনে চড়ুন, খানিক পিছিয়ে যান, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন, বিজেপি ডাক দিয়েছে অব কি বার ৪০০ পার, মাঝারি সারির নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন এবারে সংবিধানটাই বদলে দেব। দিতেনও নিশ্চিত, কপ করে লুফে নিয়েছিল বিরোধীরা সেই স্লোগান। ওদের সম্মিলিত স্লোগান, সংবিধান খতরে মে হ্যায়। সংবিধান বিপন্ন, হাতে সংবিধান নিয়ে রাহুলের জনসভাতে ভিড়। মানুষ, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জাতি, দলিত মানুষ বুঝলেন ৪০০ আসন পেলে সংবিধান বিপন্ন, আটকে গেল বিজেপি, থমকে গেল। ৪০০ পার তো দূরস্থান, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেও বহুদূরে। কিন্তু সেদিন থেকেই বিজেপি, তাদের নেতারা নতুন স্ট্রাটেজির কথা ভেবেছেন, নতুন স্লোগান, আরও মারাত্মক পোলারাইজেশন, নতুন স্লোগান এসে হাজির হয়ে গেল মারাঠাভূমিতে, বটেঙ্গে তো কটেঙ্গে। হিন্দুত্বের পোস্টার বয় আদিত্যনাথ যোগীর স্লোগান মুখে মুখে ঘুরছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার উপরেই সিলমোহর দিলেন, এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়।
পেঁয়াজের সাপোর্ট প্রাইস না থাকার ফলে বিদর্ভে ধস নেমেছিল, ভোটের আগেই সয়াবিন সাপোর্ট প্রাইস এল, টাকা বাড়ল। ওদিকে লাডকি বহিন এসে গেছে, মধ্যপ্রদেশে কাজে দিয়েছে, অতএব মহারাষ্ট্রেও, ওসব রেওড়ি ইত্যাদির বাওয়াল তো বাংলার জন্য রাখা আছে। এবং তিন দলের মসৃণ আসন সমঝোতা। এসব ছিল আইসিং অন দ্য কেক, আসল খেলাটার কন্ট্রোল নিতে মাঠে নামল নাগপুরের আরএসএস হেডকোয়ার্টার। এবারে তারা মাস ছয় আগে থেকেই শহর এলাকা টার্গেট করে নামল। ওদিকে রাহুল গান্ধীর হাতে সেই সংবিধানের কপি, সংবিধান খতরে মে হ্যায়, হচ্ছে বিধানসভার নির্বাচন, উনি হাতে সংবিধান নিয়ে ঘুরছেন। অন্য ইস্যু হল ধারাভিতে আদানিদের দখলদারি। নির্বাচন চলাকালীন শরদ পওয়ার জানিয়ে দিলেন, হ্যাঁ, আদানির ঘরেই তাঁর সঙ্গে বিজেপির মিটিং হয়েছিল। উদ্ধব ঠাকরে মুম্বইতে লড়ছেন, তাঁর ছেলে লড়ছে, তাঁরা আদানি নিয়ে কথা বলছে না। কংগ্রেস কোন নতুন ইস্যু নিয়ে নামল? কোন নতুন স্লোগান দিল? একটাও না। রাহুল গান্ধী ক’টা প্রচারে এলেন মহারাষ্ট্রে? নামমাত্র। ক’টা জনসভাতে উদ্ধব, শরদ, রাহুলকে দেখা গেল? একটা। এর আগের, মানে লোকসভার নির্বাচনের পরেই বোঝা গিয়েছিল যে বঞ্চিত বহুজন আগাড়ি কিন্তু প্রত্যেক আসনে ভোট কাটছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে জোট করার জন্য যে উদারতা দেখানোর দরকার ছিল তা দেখা গেল না। আমি বলছি না যে প্রকাশ আম্বেদকরের এই দলের সঙ্গে জোট হলে জয় আসত, তা হত না, কিন্তু পরাজয়টা এমনও হত না। আজ তিন দলের এমন অবস্থা যে টেকনিক্যালি বিধানসভাতে বিরোধী দলনেতা হওয়ার সংখ্যাও তিন দলের কারও কাছে নেই। লোকসভাতে দুই গান্ধী, রাজ্যসভাতে একজন, ওদিকে বিজেপির প্রচারের প্রথম অস্ত্রই হল কংগ্রেস বংশানুক্রমিক শাসনে চলছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar । আদানি তো কেয়ারটেকার, রিং মাস্টার তো মোদিজি
তো মানুষ কী দেখছে? মানুষ তো দেখছে সংসদে তিন গান্ধী। রাজ্যসভাতে কানহাইয়া কুমারকে পাঠালে রাজ্যসভায় একজন বলিয়ে কইয়ে মানুষ যেত, সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ, কিন্তু তিনিই যাবেন, কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে। কংগ্রেস তার নিজের জোরে এক ওই তেলঙ্গানা আর কর্নাটক ছাড়া কোথায় আছে? হরিয়ানাতে দলের ভিতরের লড়াই সামাল দিতে পারল না, নির্বাচনের ফলাফল তো সেই কথাই বলছে, শৈলজা কুমারী আর ভূপিন্দর সিং হুডা লড়েই যাচ্ছেন, দলের কেউ নেই, অন্তত কেউ ছিল না দেখার। এই বিবাদ আগেই মেটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ওনাদের মাথায় তখন লোকসভার রেজাল্ট, জিতেই গেছি, জিতে তো যাবই, বিজেপি অনায়াসে জিতে গেল, তারা নিজেদের সংগঠন সামলেছে, এবং আবার তাদের পুরনো পারফরম্যান্সে ফিরে এসেছে। ঝাড়খণ্ডে জয় এসেছে, কিন্তু এই জয় সম্পূর্ণ হেমন্ত সোরেনের জয়। তাঁর মহিলা ভোটারদের জন্য স্কিম মাইয়া সম্মান, আদিবাসীদের ৪০০ টাকার বিদ্যুৎ বিল মুকুব, এসব বিরাট কাজ করেছে, কাজ করেছে তাঁর জেলে যাওয়া এবং জেল থেকে বের হয়ে আসা, কাজ করেছে কল্পনা সোরেনের লড়াকু ইমেজ। মেগাস্টার ক্যাম্পেনার হয়ে উঠেছিলেন তিনি, কংগ্রেসের প্রার্থীরা লাইন দিয়ে বসে ছিলেন কল্পনা সোরেনকে দিয়ে একটা জনসভা করানোর জন্য, কংগ্রেস নেতাদের ডাকও পড়েনি, অধীর চৌধুরীর ওই জোকার মার্কা হিন্দি ভাষণে ভোট আসেনি, ভোট পেয়েছে জেএমএম, সঙ্গে জোট ছিল বলে আসন পেয়েছে কংগ্রেস। সেই তুলনায় আরজেডির পারফরম্যান্স অনেক ভালো।
আসলে কংগ্রেস তার জলসাঘরের জমিদারের চেহারা থেকে, সেই খোলস থেকে বের হতে পারছে না। কংগ্রেস তার চরিত্র বদল করার চেষ্টা করছে কিন্তু মাটিতে সেই চরিত্র বদলের জমিই সে হারিয়েছে বহু যুগ আগে। কংগ্রেসের একটা বাম চেহারা ছিল নেহরুর সময়ে, সেই চেহারা আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে ইন্দিরার সময়ে। ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন, কয়লাখনি জাতীয়করণ, প্রিভি পার্স বাতিল, এসব ছিল সেই বাম চিন্তার প্রয়োগ, সঙ্গে রাশিয়ার সমর্থন, সিপিআই তো জুড়েই গিয়েছিল ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে। তারপর কংগ্রেসের এমার্জেন্সি, বাম, ডানের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের পরে বিশাল হার। কিন্তু এবারে যখন ফিরে দাঁড়ালেন, ঘুরে দাঁড়ালেন ইন্দিরা গান্ধী তখন ওই বাম ভাবনা চিন্তা বাদ পড়তে শুরু করেছিল, রাজীব গান্ধী এসে সেই কাজ আরও বড় করে শুরু করলেন, মুক্ত অর্থনীতি আর বাজারের কাজের প্রথম ধাপ ছিল কমিউনিকেশন বিপ্লব। এরপরে এক ধাক্কায় কংগ্রেসের যাবতীয় বামপন্থার কাঁথায় আগুন দিয়ে নরসিমহা রাওয়ের খোলা বাজার গ্রাস করল কংগ্রেসের বাম ঘেঁষা যাবতীয় উপাদান। এবং কী আশ্চর্য, প্রায় এই সময় থেকে বিজেপির উত্থান আর তাকে আটকাতে সদ্য বাম মতাদর্শ আর তার প্রয়োগের বাইরে বেরিয়ে আসা একদা ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক ইত্যাদির অ্যাডভাইজর মনমোহন সিংয়ের সরকারের সমর্থনে দাঁড়াল বামেরা। মানে কংগ্রেস যখন বাম চিন্তা আর প্রয়োগে নেমেছিল, তখন ওরা কংগ্রেস বিরোধী, আর যখন কংগ্রেস খোলাবাজার আর উদার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন নিয়ে মাঠে তখন সমর্থনে বামেরা। কিন্তু ততদিনে কংগ্রেসের ক্ষয় শুরু হয়েই গেছে, তার কাছ থেকে সরে গেছে তফশিলি জাতির সমর্থন, সরে গেছেন দলিত মানুষজন, ভোট শেয়ার কমছে, দল ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছেন অনেকে, আঞ্চলিক দল কংগ্রেসের ভোট কেড়ে নিচ্ছে, বাংলাতে তো কংগ্রেস মুছে যাওয়ার কারণই সেটা। এবং বিজেপিকে আটকানোর জন্য সমাজবাদী দল বা কমিউনিস্টরা বা আঞ্চলিক দল পাশে এসে দাঁড়ালেও কংগ্রেসের মনে হয়েছে এটা তারা বাধ্যবাধকতা থেকেই করছে, টেকেন ফর গ্র্যান্টেড গোছের ব্যাপার। কাজেই সেটাও এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় স্তরে কমিউনিস্টদের শর্তহীন সমর্থন আছে কিন্তু সেই কমিউনিস্টরাই তাদের শেষ দুর্গ সামলাচ্ছেন ওই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ে, সব মিলিয়ে সেখানেও জট। এবং তেমন এক সময়ে কংগ্রেস এক কঠোর বাম অবস্থান নিয়ে চলার চেষ্টা করছে। সংবিধান বিপন্ন, আরএসএস-সাভারকর বিরোধী অবস্থান, ক্রোনি ক্যাপিটাল বিরোধী কঠোরতম অবস্থান।
কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা দেখুন, সংবিধানের প্রশ্ন আছে, বিরোধীরাও একমত, কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে তা থাকতেই পারে এক ইস্যু, প্রধান ইস্যু নয়। সাভারকর বিরোধী, হিন্দুত্ব বিরোধী অবস্থান, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা উদ্ধব ঠাকরে গ্রুপ এই অবস্থানের সঙ্গে এক্কেবারেই একমত নয়, বারবার সেটা তারা জানিয়েছে, ইন ফ্যাক্ট দ্রাবিড় সংস্কৃতির আবহে তামিলনাড়ুর স্তালিন বা ডিএমকে ছাড়া ইন্ডিয়া জোটের অন্য কোনও শরিকের এই ইস্যুতে তেমন সায় নেই। বাংলাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নন, এমনকী কংগ্রেসের মধ্যে এক বিরাট অংশ এই প্রচারে গলা মেলায়নি, কর্নাটকে এই প্রচার কোথায়? এরপরে পড়ে থাকল তীব্র আদানি বিরোধী বা কর্পোরেট ক্যাপিটাল বিরোধী কংগ্রেসের অবস্থান, যা শরদ পওয়ার থেকে স্তালিন থেকে মমতা, কেউই সেভাবে তুলে ধরার বিরোধী, বাংলার শিল্প সামিটে আম্বানি প্রতিবার নিমন্ত্রিত, তাদের ইনভেস্টমেন্ট আছে, তামিলনাড়ুতেও। এমনকী আদানির এই ঘাপলা নিয়ে বহু দল সরব হলেও তা যখন সাধারণ নির্বাচনে ইস্যু হয় তখন তেমন সরব হন না বেশিরভাগ ইন্ডিয়া জোটের নেতা। তাকিয়ে দেখুন ডি শিবকুমার বা রেবন্ত রেড্ডির দিকে, কোথা থেকে টাকা আসছে কংগ্রেসের? আদানিকে বাদ দিলে বাকিরা কি সব গঙ্গা জলে ধোওয়া পবিত্র? তাও নয়। সবথেকে বড় হল দেশের মানুষের কাছে অনেক বড় সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি, সমস্যা বেকারত্বের, সমস্যা আদিবাসীদের জল, জঙ্গল জমিনের, সমস্যা দলিত গরিব মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের, সেসব হয়েই উঠতে পারে এই বিধানসভাতে বড় ইস্যু, সয়াবিনের সাপোর্ট প্রাইস, কৃষক আত্মহত্যা, মারাঠা স্বাভিমান, তুলো চাষিদের রোজগার কমে যাওয়া, শিল্প কেন্দ্র গুজরাতে সরিয়ে নেওয়া। তার বদলে হাতে সংবিধান নিয়ে এক পবিত্র লড়াইয়ে নামলেন রাহুল গান্ধী, মানুষ তার রোজকার জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেল না। আর ওই যে বললাম, ঘণ্টাখানেক মর্নিং ওয়াকের পরে চাড্ডি জিলিপি সিঙাড়া খেলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, কংগ্রেসের মেদ ঝরছে না, একটা ছোট্ট দৌড়ের পরে জলসাঘরের জমিদার রাবড়ি খেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছেন। নির্বাচনে জেতা ছেড়ে দিন, আপাতত দেহে মনে স্ফূর্তি আনার জন্য কংগ্রেসের উচিত সকালে উঠে রোজ দু’ তিন গ্লাস বোনভিটা খাওয়া, তারপর দেখো আমি বাড়ছি মামি বলে নিজের সাইজ মাপা।
The post Fourth Pillar | কংগ্রেস রোজ সকালে বোনভিটা খাওয়া প্র্যাকটিস করুক first appeared on KolkataTV.
The post Fourth Pillar | কংগ্রেস রোজ সকালে বোনভিটা খাওয়া প্র্যাকটিস করুক appeared first on KolkataTV.