বিজেপি গতবারে পেয়েছিল ৩০৩টা আসন, এবারে তাদের দাবি ৩৭০টা আসন, মানে তাদের লক্ষ্য আরও ৬৭টা অতিরিক্ত আসন। নির্বাচনী পণ্ডিতদের মাথায় এই চিন্তাই ঘুরছে, কোথা থেকে আসবে ৩৭০ মানে ওই অতিরিক্ত ৬৭টা আসন। আর সাধারণ তত্ত্ব মেনে যে ক’টা আসন গতবারে বিজেপি জিতেছিল, তার সবক’টাও তো তাকে জিততে হবে, সেটাও তো একটু বাড়াবাড়ি দাবি। এবং এ কথা মানে এই দাবির কথা বিজেপির চাণক্য বলেননি, বলেছেন স্বয়ং নরেন্দ্র ভাই দামোদর দাস মোদি, তাও আবার সংসদে দাঁড়িয়ে এবং তারপর থেকে তিনি অবরে সবরে এই একই দাবির কথা জানিয়েই যাচ্ছেন। কাজেই ভেঁপু মিডিয়ার দল ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া নিয়ে নেমে পড়েছে। তাদের আবার দুই তরিকা আছে। একদলের বক্তব্য হল মোদিজি নিজেই নিজেকে আন্ডার এস্টিমেট করছেন, বিরোধীদের যা অবস্থা তাতে বিজেপি কমসম করেও নিজেরাই ৪০০র কাছাকাছি তো যাবেই, ৪০০ পার হলে অবাক হব না। কিছু ইংরিজি মিডিয়ার আবার লোকলজ্জা আছে, ইংরিজিতে যাকে বলে ফিয়ার অফ পাবলিক ওপিনিয়ন, তাই সংখ্যাটাকে কমিয়ে ওই ৩০৩-এর ধারে কাছে রাখা হয়েছে যদিও সেসব সমীক্ষাতে এরর, মানে গলতির সম্ভাবনা নাকি ৫ শতাংশ। ভাবুন একবার, যে দল ৩০২খানা আসন পাবে ৪৪ শতাংশ ভোট নিয়ে, অন্তত এটাই যে সমীক্ষার দাবি। সেই সমীক্ষাতে আসল ফলাফলের সময় ভোট ৫ শতাংশ কম বা বেশিও হতে পারে, মানে সেই ভোট শতাংশ ৪৯ শতাংশ হতে পারে, ৩৯ শতাংশও হতে পারে। তো এই ৪৯ শতাংশ ভোট পেলে ৪০০ পার হয়ে যাবে আর ৩৯ শতাংশ হলে আসন সংখ্যা কমে ২৫৫-২৬০ এর মধ্যে আটকে যাবে, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। না, খোলসা করে এমন কথা কিন্তু ওই সমীক্ষাতে লেখা নেই। তো ওই ভেঁপু মিডিয়ার কথা থাক আপাতত দল হিসেবেই আমরা একটু হিসেব করে দেখি যে এরকম সম্ভাবনা কতটুকু? বা বোঝার চেষ্টা করি যে এই লক্ষ্যপূরণের জন্য বিজেপি ঠিক কী করতে চলেছে। আজকের এই বিজেপিকে দেখে আগের বিজেপির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না, এ হল অনেকটা আশির দশকের কংগ্রেসের মতো, এক প্রবল হাই কমান্ড পরিচালিত দল। ধরুন বিজেপির কার্যকারিণী, মানে এগজিকিউটিভ কমিটির বৈঠক হয়ে গেল, তো কার্যকারিণী সদস্যদের একজনেরও কি মোদি শাহের বিরুদ্ধে একটা কথা বলারও ক্ষমতা আছে? বিজেপির দলীয় সংবিধান বলছে দলের সভাপতি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হতে পারেন, তো নাড্ডাজির সময় সীমা পার, হিসেব মতো আর কারও দায়িত্ব নেওয়া উচিত। কিন্তু মোদিজি এখনও এর চেয়েও ভালো পুতুল পাননি, তাই ওই এগজিকিউটিভ কমিটির মিটিং এক প্রস্তাব পাশ করিয়ে এক জরুরি ক্ষমতা দেওয়া হল মোদি-শাহের হাতে, তাঁরা এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতেই পারেন। তো তাঁরাই এক প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিলেন যে ওই জগৎ প্রকাশ নাড্ডা অন্তত জুন মাস পর্যন্ত দলের সভাপতি থাকবেন। কেউ আপত্তি করেনি।
কংগ্রেসে এমনটা আকছার হত। দলের সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধী এক কমিটি তৈরি করে দিলেন যে কমিটি দলের সভাপতি সোনিয়াজির হাতেই আরও কিছু ক্ষমতা দিল, কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিল, এমন নৌটঙ্কি তো কংগ্রেস দলে সেই ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে বার বার হয়েছে। কিন্তু বিজেপিতে ছিল না, এটা নতুন বিজেপি, এক হাই কমান্ডের বিজেপি। আগে বিজেপির বহু নেতা ভয়ঙ্কর রকমের নীতিনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন, নির্বাচনে জিততে হবে বলেই যা খুশি তাই করব এরকম ছিল না, হ্যাঁ বাবরি মসজিদ ভাঙব, রথযাত্রা করব, তাতে দাঙ্গা লাগলে লাগবে, মানুষ মরলে মরবে, তা নিয়ে বিজেপির কোনও নেতার কোনও দ্বিধা কোনওদিনও ছিল না। কিন্তু অন্য দলের দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের অবলীলায় দলে নিয়ে নেব, যেন তেন প্রকারেণ কোনও রাজ্য সরকার ভেঙে নিজেরা ক্ষমতাতে আসব, এ ধরনের নীতিহীনতা বিজেপিতে ছিল না। এখন সে সবের বালাই উঠে তো গেছেই, বরং এই ভাঙানোর খেলায়, যে করে হোক ক্ষমতা দখল নেওয়ার যাবতীয় গোলমেলে ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে তাঁদের এতটুকু লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণও তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। দেখুন না চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের কথা, ক্যামেরার সামনে বসে আটখানা বিরোধী ভোটে কালি দিয়ে দাগ কেটে তাকে বাতিল ঘোষণা করে মেয়র পদ দখল করেছিল বিজেপি। সুপ্রিম কোর্ট কেবল ওই আটখানা ভোটকে সঠিক বলে গণ্য করে মেয়র পদ আপ-এর প্রার্থীর হাতে তুলে দিয়েছেন তাই নয়, জোচ্চুরির মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছেন হরিয়ানা সরকারকে, সেই অফিসারের বিরুদ্ধে যিনি এই কাণ্ডটা নিজেই ঘটিয়েছিলেন। আগের বিজেপির কোনও নেতা, গোবিন্দাচার্য বা আদবানি, জোশি, বাজপেয়ী এমনকী প্রমোদ মহাজনও মণিপুরে ওরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে অথচ সেখানে মুখ্যমন্ত্রী পদে এক অকর্মণ্যকে রেখে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন? অসম্ভব। কিন্তু এখন? সন্দেশখালিতে অবশ্যই অসংখ্য অভিযোগ এসেছে, অসংখ্য মহিলারা অভিযোগ আনছেন। তা দেখার জন্য জাতীয় মহিলা কমিশনের তো আসাই উচিত, কিন্তু সেই মহিলা কমিশন সেই মানবাধিকার কমিশন সেই শিশু রক্ষা ও অধিকার কমিশনের একজনও একবারের জন্যও তো মণিপুর গেলেন না, কার নির্দেশে তাঁরা সন্দেশখালিতে আসছেন আর কার নির্দেশে তাঁরা মণিপুরে যাচ্ছেন না? সব্বাই জানে। কিন্তু বিজেপির তাতে বিন্দুমাত্র হেলদোল দেখেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২১শে দিল ডাক, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান
একটা দল প্রথমে বলেছিল অযোধ্যা চাই, আস্থার বিষয়। অযোধ্যার মন্দির হবে আমরা আর অন্য কোনও দাবি নিয়ে মাঠে নামব না। অযোধ্যা শেষ, এখন বলছেন অন্তত কাশী মথুরা তো চাইই চাই। মানে আবার দাঙ্গা, আবার মৃত্যু, আবার এক নতুন ক্ষত। কিন্তু ওনাদের আইন কানুন, নীতি নিয়মের কোনও তোয়াক্কা নেই। এ এক অন্য বিজেপি, ২০১৪-র পরে এই বিজেপির ইতিহাস অন্য পথে চলেছে, যেদিন এই ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হবে, সেদিন প্রত্যেকে বলবে সেই ২০১৪ থেকেই আসলে পতনের বীজ বপন শুরু হয়েছিল। সেই বিজেপি যখন ৩৭০টা আসনের কথা বলছে তা কেবল কথার কথা নয়, তার পিছনে তাদের এক পরিকল্পনা আছে, এক সুচিন্তিত গেম প্ল্যান আছে। তারা খুব ভালো করেই জানে তাদের গড় থেকে তাদের আর আসন বাড়ানো সম্ভব নয়। গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে বিজেপি প্রায় সব আসনই জিতেছিল, তার থেকে তো বেশি পাবে না। উত্তরপ্রদেশে তাদের কিছু আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে, অন্তত গোটা ৬/৭/৮ টা আসন। কীভাবে আসবে? এখনই যা অবস্থা তাতে সম্ভব নয়, অতএব রাষ্ট্রীয় লোকদলকে ভাঙানো হল, এর আগেই মায়াবতীকে সাফ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ইডিও আছে, সিবিআইও আছে, কাজেই লড়বেন লড়ুন, জোট ইত্যাদিতে নয়, উনি মেনেই নিয়েছেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জাঠ ভোট সঙ্গে পেলে কিছু আসন বেশি হতেই পারে, কাজেই জয়ন্ত চৌধুরিকে ভাঙানো হয়েছে। অন্ধ্রের হিসেব খুব জটিল, কিন্তু সমীক্ষা বলছে চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে থাকলে গোটা দুই আসন পেলেও পেতে পারে, কিন্তু তাই বলে জগন রেড্ডিকে বিরোধীদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, কাজেই সেখানে নতুন করে জগন রেড্ডির মামলাগুলো খোলা শুরু হয়েছে, জগন রেড্ডিও দরকষাকষির জায়গাতে নেই। তেলঙ্গানাতে কে সি আর কন্যা কবিতা মাত্র কালই ইডির ডাক পেয়েছেন, অর্থাৎ এমনিতে ওখানে গতবারের চারটে আসন এবারে আবার পাওয়া খুব কঠিন কিন্তু তার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। অসমে শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস আরও ভাঙতে পারে, চেষ্টা চলছে, সেক্ষেত্রে আরও এক আধটা আসন।
বিহারে নীতীশকে ভাঙা হয়েছে কিন্তু তাতেও খুব লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না, কংগ্রেস এবং আরজেডির কিছু নেতাদের দিকে নজর রাখা হয়েছে, কিছু পুরনো মামলা আবার নতুন করে খোলা হচ্ছে, কিছু পারিবারিক সমীকরণ আবার নতুন চেহারা নিচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিহারে আরজেডির দু’ একজন নেতা, কংগ্রেসের বেশ কিছ নেতা বিজেপিতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ভেঙে সুবিধে হচ্ছিল না, এনসিপিকে ভাঙা হয়েছে, কিন্তু আরও কিছু আসনের লক্ষ্যে এবার কংগ্রেসকেও ভাঙা হচ্ছে, কিছুটা ভেঙেছে, মিলিন্দ দেওরা বা অশোক চব্যন কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গেছেন, আরও কিছু নেতা গেলে অবাক হবার কিছু নেই। ওড়িশাতে কংগ্রেসকে ভাঙা হচ্ছে, বিজু জনতা দলেরও একজন বড় নেতা বিজেপিতে যেতে পারেন, অন্তত ওড়িশার খবর তো তাই বলছে। মানে ওখানেও কংগ্রেসের ছিল একটা আসন, সেটাও থাকার সম্ভাবনা কম, বিজেপির ৬টা আসন ছিল এবার বেড়ে ৬-৭ হতেই পারে। কর্নাটক, বিজেপির গেমপ্ল্যানটা কত বড় সেটা এই কর্নাটক দেখলে বোঝা যায়। বিজেপি ওখানে কেবলমাত্র কংগ্রেসকে আটকানোর জন্য জেডিএস-এর সঙ্গে জোট করেছে, বিজেপি তাদের জেতা আসনও জেডিএসকে ছেড়ে দেবে, কারণ তারা জানে কংগ্রেসকে মুছে ফেলতে হবে। কিন্তু কর্নাটকে বিজেপির আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা তো নেই, বরং তারা জেতা আসন জেডিএসকে ছেড়ে দিচ্ছে।। তামিলনাড়ুতে তাদের সঙ্গী নেই, বহু চেষ্টার পরেও সেখানে বিজেপির কোনও আশা এবারেও নেই। কেরালাতে কিন্তু এবারে অন্তত দুটো আসনে বিজেপি জিতে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই, বিজেপি হিন্দু আর খ্রিস্টান ভোটকে নিজেদের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার সব করেছে, কংগ্রেস সিপিএম-এর লড়াইয়ের সুযোগেই এই প্রথম বিজেপি কেরালা থেকে দুটো আসন জেতার স্বপ্ন দেখছে।
বাকি বড় রাজ্য হল বাংলা, এখানে কঠিন ঠাঁই, ইডি আর সিবিআই দিয়েও হচ্ছে না আপাতত স্ট্রাটেজি রাজ্যের অন্তত পাঁচ ছটা জায়গাতে সন্দেশখালি তৈরি করা, রাজ্যের বুদ্ধিজীবী, টলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীদের এক বড় অংশকে নিজেদের প্রচারে নামানো আর সংখ্যালঘুদের এক অংশকে মমতার বিরুদ্ধে নামানো। হ্যাঁ, এ কাজ শুরু হয়ে গেছে, একদা মমতা ঘনিষ্ঠ প্রযোজক এখন বিজেপির আড়কাঠি হয়ে কাজ শুরু করেছেন। ওদিকে বিরাট টাকা পয়সা নিয়ে কিছু সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী পাঁচতারা হোটেলে চিন্তন বৈঠক ডাকছেন, বলছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আর কংগ্রেসের মধ্যের এক অংশকে তীব্র মমতা বিরোধী করে তোলার চেষ্টাও জারি আছে, পরে সময় মতো তাঁদের পুনর্বাসনের আশ্বাস তাঁরা পেয়েছেন, কাজেও নেমেছেন। কিন্তু এত শত করার পরে এখানে দু’ তিনটে, সেখানে তিন চারটে আসন বাড়ালেও ৬৭টা আসন বাড়ানো অসম্ভব, সেটা বিজেপি নেতারা জানেন, মোদি–শাহও জানেন। এবং খেয়াল করুন দেশজুড়ে বিজেপি নেতাদের আসন বাড়ানোর প্ল্যানে কোথাও বিকাশ উন্নয়ন, দেশ এগিয়ে চলেছে এসব নেই, তারা জানে ইন্ডিয়া শাইনিং ইত্যাদি বলার পরে অটলবিহারী হেরেছিলেন। কাজেই তাদের ভরসা ওই দল ভাঙানোয়, ভরসা ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই-এর উপর। কিন্তু তাতেও স্বস্তি মিলছে না। আসলে ৩৭০-এর স্লোগান এক প্রচার, সেটা এক সাইকোলজিকাল ওয়ার। এবং এটাও সত্যি যে নির্বাচনের আগে অন্তত এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে বিজেপি, ৩৭০-এর বিরাট বাওয়ালের পিছনে সেটাই আসল কারণ।