আগেই বলেছি, ভুলে যাওয়া আর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া এক ধরনের রোগ, অসুস্থতা, যদি ডিটেলে জানতে চান তাহলে গজনী সিনেমা টা দেখে নিতে পারেন, অবশ্য ওটা ছাড়াও বহু হিন্দি সিনেমার শেষে যে ভাবে ভিলেনের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে নিরুপা রায়ের জ্ঞান চলে যেত, ক্লাইম্যাক্সে আবার সেই ভিলেন, সেরকমই ধাক্কা, এবং গিলি গিলি হোকাস ফোকাস, নিরুপা রায়ের জ্ঞান ফিরে আসা, ফিরে আসার পরের ডায়ালগ হলো, উসে ছোড়না মত, ওহ তেরা বাপ কা কাতিল হ্যায়, ব্যস, দে দমাদ্দম, দে দমাদ্দম। ১৯ বছর ২৫ বছর পরে মা আর ছেলের জড়িয়ে ধরার ওপর নেমে আসত, এন্ড স্ক্রোল, চরিত্র লিপি।
এ গল্প এরকম ভাবেই মেলে, মানে মেলাতে হয়, না হলে গল্প শেষ হবার কোনও চান্সই নেই, কারণ একমাত্র মা ই তো ভিলেন কে বাবাকে গুলি করে মারতে দেখেছে, ছেলে তো তখন আর এক ছোট ভিলেন, মেসো, কি কাকার সঙ্গে আইসক্রিম খেতে গ্যাছে, এদিকে মায়ের স্মৃতি গায়েব, গল্পে স্মৃতি না ফিরে এলে প্রযোজক মাঠে বসবে, তাই স্মৃতি ফিরে আসা। লেটেস্ট গজনী তেও তাই।
আমাদের সমাজ জীবন তার ব্যতিক্রম নয়, বই নিয়ে গেছে ৩ মাস, উচ্চবাচ্চ নেই, আপনি যেদিন রেগেমেগে বাড়িতে হানা দিলেন, সেদিন ব্যালকনি থেকে আপনাকে দেখেই শর্ট টার্ম মেমোরি ফিরে এলো, এইরে তোর বই টা না সেই কবে থেকে, কিছু মনে করিস না রে, কাজের চাপে ইত্যাদি, ইত্যাদি। টাকা পয়সার ক্ষেত্রে তো মেমোরি ফিরেই আসতে চায় না, পাতলি গলি দিয়ে কেটে পড়ে, টাকা, বই, জামা, ব্যাগ মায় জুতো পর্যন্ত এই শর্ট টার্ম মেমোরির শিকার।
কিন্তু এই শর্ট টার্ম মেমোরি লশের সবথেকে বড় জায়গা হল এ দেশের রাজনীতি। রাজনীতি তে তো অহরহ সুইচ টিপে মেমোরি আসে এবং সুইচ টিপলেই লক্ষ্মী ছেলের মত চলে যায়, জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার এর মত, সোনালি চিলের মত স্মৃতি সময় সুযোগ বুঝে উড়ে যায়, উবে যায়। আবার কোনও এক পরম লগনে তা ঝড়াৎ করে ফিরে আসে, আজ সেই স্মৃতি ফিরে আসা, মানে রাজনৈতিক স্মৃতি র আসা যাওয়া নিয়ে দু চার কথা।
এই স্মৃতি আসার ব্যাপার টা আলোচনা করার আগে, স্বপন কুমারের ঐ কী থেকে কী হইয়া যায় টাও মাথায় রাখতে হবে, তা না হলে খেই হারিয়ে যাবে। তা না হলে ধাক্কা খেয়ে জলে পড়া কানন পরের পাঁচ বছর চুপ থাকার পর, হঠাৎ নিজের সন্মান নিয়ে এতটা সংবেদনশীল কেন হয়ে পড়েছিলেন, সেটা বোঝা যাবে না। সুইমিং পুলের উদ্বোধন, বিশিষ্ট অতিথি, প্রেস সবার সামনে আলতো ধাক্কা এবং জলে হাবুডুবু, কিন্তু মুখে প্রায় স্বাভাবিক হাসি, নো হার্ড ফিলিংস, নো অপমান ইত্যাদি ইত্যাদি, কলকাতা শহরের প্রথম নাগরিকের সন্মান? কার এত সাহস? কে কাড়বে? কিন্তু অজান্তে কাড়িয়াছিল, সেই সন্মানহীনতা ২০২০ তে কার্বাঙ্কল ফোঁড়ার মত গজিয়ে উঠল, তারপর আবার কালিঘাটে ভাইফোঁটা, হয় এমন হয়। হঠাৎই স্মৃতি ফিরে আসে। দিলুদা বলেছিলেন, শোভন বৈশাখি তো ডাল ভাতের মত, গোঁসা করেছিলেন, তারপর গলাগলি হয়ে গেছে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে, এখন ঝগড়া? কেউ জানে না। কিন্তু অপমান? সে কি কোথাও লুকাইয়া আছে? সময় সুযোগ বুঝে তা কি আবার বের হবে? ২০২১ বা ২০২২ এ বের হয়নি, ২০২৪ এ বের হবে না? হতে পারে? সুযোগ সুবিধে বরকরার থাকলে নাও বের হতে পারে, সবটাই তো ঐ কী হইতে কী হইয়া যায়, তাই না।
ধরুন মুকুল রায়, শতাব্দী দিদির পায়রা হলে ইনি দিদির কী ছিলেন আপনারাই জানেন, বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক, সেকুলার ভারতবর্ষে যে তার ঠাঁই হওয়া টা উচিত নয়, সে বিষয়ে তিনি ইয়া ইয়া বক্তিমে করেছেন। তারপর কী হইতে কী হইয়া গ্যালো, সব ভুলে গেলেন, মনে পড়বে না মনে করছিলেন? প্রয়োজনে ঠিক মনে পড়ে গেছে যে বিজেপি আদতে এক সাম্প্রদায়িক দল, মনে পড়তেই হয়েছে, কিন্তু ওনার সুইচ জ্বলছে নিভছে, একটাই মাথা তো কত আর চাপ নেবেন বলুন। ধরুন শঙ্কুদেব পন্ডা, পিসির কথা আর মনে নাই, পুরো গজনী, এখন মোটাভাই এর কথায় আছেন। ধরুন, অর্জুন সিং, অহো কি মুখের ভাষা ছিল সেদিন, বিজেপির গুন্ডাদের বিরুদ্ধে একা অর্জুন, মাঝখানে ভুলে মেরেছেন, আবার ফিরে এসেছেন আপন কুলায় ঢুকে পড়েছেন। হলদিয়ার মুখ্যমন্ত্রী লক্ষণ শেঠ, কতবার যে কত কিছু ভুলে যাচ্ছেন, পারফেক্ট গজনী, এই ভোলেন এই মনে পড়ে। কী থেকে যে কী হইয়া যায়। আরও কতজন। তা গবেষণা করে দেখলাম, নির্বাচন আসার আগে এই স্মৃতি, অনুভূতি ফিরে আসার ব্যাপারটা খুব কমন, এই সময়ে একসঙ্গে অনেকের জ্ঞান ফিরে আসে, অনুভূতি ফিরে আসে। অন্যসময় টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন রাজনৈতিক, নির্বাচন যত এগিয়ে আসে ততই অরাজনৈতিক কর্মসূচী বাড়তে থাকে, অরাজনৈতিক মানে? ঐ ধরুন বিজয়া সম্মিলনী, দোল, আবির মাখানো, মুর্তি, লাইব্রেরি, ক্লাবের নতুন গৃহ উদ্বোধন। এসব অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যান, গিয়ে কত কথা বলেন, ঐ যে কী হইতে কী হইয়া গ্যালোর শুরুয়াত টা এখান থেকেই, রাজনৈতিক নেতা তো নন, যেন বুদ্ধের প্রতিমূর্তি, ঠোঁটে হালকা হাসি, চোখ সামনে, মুখে নজরুল রবীন্দ্রনাথ, পেছনে অনুগামী। ইয়েস, তারা তখন দলীয় কর্মী নন, এক্কেবারেই নন। তারা তখন অনুগামী, আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি তো পথ চিনি না। সাড়ে চার বছর মন্ত্রী, কাউন্সিলর, জেলা পরিষদ, মেন্টর ইত্যাদি ইত্যাদি। হুস করে স্কর্পিও চেপে ৮ গাড়ির কনভয়, হা হু হা হু হুটার বাজছে, জণগণের হাহুতাশ যেন, দলীয় কর্মীরা গাঁদা ফুলের পাপড়ি ছড়াচ্ছেন, গাঁদা ফুলের মালা। দলের হাই কমান্ডের গুণকেত্তন, প্রতি দু লাইনে একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণার কথা মনে করিয়ে দেওয়া, দলীয় কর্মীদের এটা, ওটা, সেটার ব্যবস্থা করে দেওয়া, তারপর আবার হুটার বাজিয়ে ক্লাব, দোকান, রবীন্দ্রজয়ন্তী, হরিনাম সংকীর্তন এর আসরে চলে যাওয়া, নিরবিচ্ছিন্ন, প্রতিদিন। রাতে অন্য আসর, ইত্যাদি। কারোর কারোর সংস্কৃতিচর্চা। সাড়ে চার বছর এই রুটিন ছিল ধরা বাঁধা, দলীয় সভা, দলীয় কর্মী, দলীয় ফ্ল্যাগ, দলীয় নেত্রী। এক দলময় জীবন যাকে বলে আর কি! কিন্তু নির্বাচন কাছে এসেছে, পায়ে হাত দিয়ে শুভেন্দু প্রণাম করেছেন অমিত শাহ কে, আমরা জেনেছি এ যোগাযোগ বেশ কিছু দিনের, ফুল শর্ট টার্ম মেমরি লস। মেমোরি ফিরিবে না? গ্যারান্টি দিতে পারবো না। অনুপম হাজরার মেমোরি ফিরলো বলে। প্রতি মুহুর্তে হিসেব নিকেশ, কাছের, অত্যন্ত কাছের সাংবাদিক কে বারবার জিজ্ঞাসা, কী খবর? দিদি কটা? রোজ রিপাবলিক থেকে এন ডি টিভি, কলকাতা টিভিও খুলে বোঝার চেষ্টা, হাওয়া কোন দিকে বয়? খর বায়ু? না কি মৃদু মন্দ বায়ু? সিট থাকিবে? ন্যাপলা বাগাবে না তো? যদি বাগিয়ে নেয়? সিট থাকিল, জিতিলাম, মন্ত্রীত্ব থাকিবে? ব্লাড প্রেসার পেঁয়াজ আর পেট্রলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকে, বারবার চোখ চলে যায় হুটারের দিকে, মন হু হু করতে থাকে। এবং ক্যালকুলেশন করে হঠাৎ গজনী, সন্মান কই? সন্মান কই? আত্মসন্মান? একজন পাশ থেকে বলে, টাইটেল টা বলো না দাদা, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবো, তুমি ডাকছো, সে আসছে না, ছেনো, চল তো। তারা তো জানে না, দাদা এখন গজনী, শর্ট টার্ম মেমোরি। প্রথম কাজ দলীয় কর্মীদের, যাদের এটা ওটা সেটার ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদের কে দলীয় কর্মী থেকে অনুগামী বানিয়ে ফেলা, তারা আর দলের কর্মী নন, তারা এখন দাদার অনুগামী। তারপর নেত্রীর নাম নেওয়া বন্ধ, অনুপ্রেরণা? ওহ কোন চিড়িয়া হ্যায়? দাদা তো তখন গজনী। সমানে খুঁজে যাচ্ছেন সন্মান আর আত্মসন্মান, কিন্তু এই দুই যমজ ভাই কোথায় লুকিয়ে আছে তা জানা নেই, আমরা কিন্তু জানি, ওনার দলীয় কার্যালয়ে সে দুভাই নেই, এটা সিওর, অন্য কোনও দলের কার্যালয়ে হয়তো লুকিয়ে আছে, সেই নেতা সন্মান আর আত্ম সন্মান কে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে গিয়ে দামে দরে, আলাপে আলোচনায়, কি পেলাম, কি দিলাম, ডেবিট ক্রেডিটের হিসেব মিলিয়ে নিতে পারলেই, সন্মান আর আত্মসন্মান পেয়ে যাবেন, এবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি, এক অন্য স্বরূপ, আগে যা যা বলেছিলেন করেছিলেন, সব লং টার্ম মেমোরি লস, ভাগ মুকুল ভাগ, ভাগ মুকুল ভাগ তখন স্মৃতির অতল জলে হারিয়ে গেছে, নরেন্দ্র মোদীজী কি প্রেরণা, অমিত শাহ জী কি পথনির্দেশ, চাড্ডা জী কি নেতৃত্ব নিয়ে তিনি এক অন্যপুরুষ, ইনি তিনি নন। ওদিকে এটা ওটা সেটা পাওয়া অনুগামীরা ঝন্ডা বদলে আবার দলীয় কর্মী, কেবল দল বদলে গেছে। সন্মান আর আত্মসন্মান ধাপার মাঠে আবর্জনার সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে, ঘাস্ফুল থেকে কমল ফুল, হাত থেকে ঘাস্ফুল, কাস্তে হাতুড়ি থেকে কমল, কমল থেকে ঘাস্ফুল, এভরিথিং ইজ পসিবল, সব সম্ভব। কেবল দরকার ভুলতে পারা। এক নির্বাচনী সভার শেষে দলীয় কার্যালয়ে হাজির ছিলাম, রিঙ্কু নস্কর, মথুরাপুর থেকে সিপিএম প্রার্থী, আটপৌরে চেহারা, মুড়ি চপ এসেছে, সারা দিনের পর এটুকুই, দলের কর্মীরা গান গাইছেন, সাথীদের খুনে রাঙা পথে দ্যাখো, হায়নার আনাগোনা, হলফ করে বলছি, এই গানটাই তাঁরা গাইছিলেন। তিনি গজনী, হাতে গেরুয়া ঝান্ডা, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে রামমন্দিরে যাত্রা। নির্বাচন এলো, আসছে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল, এ দলে থেকে কাজ করা যায় না, অনুগামীদের নিয়ে সটান যে দলে কাজ করা যায়, সে দলে চলে গেলেন। তার মানে এই যে সভায় সভায়, দল, তার আদর্শ, তার নীতি, তার কর্মসূচী, তার নেতা নেত্রীর ওপর আস্থা, এসব কিচ্ছু না, কোনও মানেই নেই। আমরা আম জনতা এই নাটক আর কতদিন সহ্য করবো? এই নেতা নামক এক আদন্ত্য ধান্দাবাজ, নীতিহীন মানুষটা সন্মান পাচ্ছিনা, আত্মসন্মান নেই দলে, এ দলে থেকে মানুষের কাজ করতে পারছি নার মত ডাহা মিথ্যে কথা বলে, সাড়ে চার বছর ধরে দলের যাবতীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার পর, দল ছেড়ে অন্য দলে যাবেন, আর আমরা তাকিয়ে দেখবো? দেখবো, কারণ আম আদমীর ঐ সন্মান আর আত্ম সন্মান কবেই খোয়া গেছে, আম আদমির মেমোরি, তার স্মৃতি শক্তি গজনির চেয়েও কম। আর মাত্র ক মাস, আসছে নির্বাচন। হঠাৎ ভুলে যাওয়া বা মনে পড়ে যাওয়া, শর্ট টার্ম মেমোরি লস ওলা এইসব নীতিহীন মানুষদের ওপর নজর রাখুন, কারণ শীতকাল এসে গেছে সূপর্ণা, নির্বাচনও এসে গেছে।