মাঝেমধ্যে ইতিহাস চর্চা করা ভালো, দুটো কারণে। ১) ইতিহাস ভুলে গেলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই, THOSE WHO FORGET THE HISTORY ARE CONDEMNED TO REPEAT IT, ২) কিছু মানুষ আছেন যারা ইতিহাসের নামে তাদের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই বোঝাতে থাকেন, সেটা বিপজ্জনক। সেই মিথ্যে ইতিহাসের কথা মানুষকে বলতেই হবে। তাই আজ একটু ইতিহাস ঘাঁটা যাক। মাঝেমধ্যেই দেখবেন আরএসএস-বিজেপির লোকজন, সম্বিত পাত্র থেকে দিলীপ ঘোষ বা আদিত্যনাথ যোগী বলেন ইসলাম কী হিংস্র, তাদের রাজারা সম্রাটরা কী হিংস্র, কী অত্যাচারই না চালিয়েছে, হিন্দু দেখেছে আর মাথা কেটেছে। এবং এসব বলতে গিয়ে সবচেয়ে আগে যার নাম বলে সে হল চেঙ্গিজ খান। ওরেব্বাবা, ভারতে এসে হিন্দুদের কচুকাটা করেছিল। মাই নেম ইজ খান, চেঙ্গিজ খান। খান মানেই মুসলমান আর মুসলমান মানেই অত্যাচারী, অশিক্ষিত, জ্ঞানবিজ্ঞানের ধার ধারে না, আল্লার নির্দেশে কেবল কাফেরদের মারা এই হল তাদের কাজ, এবং সেই খানেদের অন্যতম হল চেঙ্গিজ খান। আইটি সেল থেকে এ তথ্য পৌঁছে দেওয়া হয়, তারপর সত্যিকারের অশিক্ষিত ভক্তের দল বা ধান্দাবাজি করার জন্য জুটে যাওয়া পাবলিক এই তথ্য গোলগোল চোখ করে এমন বর্ণনা করবে যে মনে হবে উরিব্বাস, সে নিজেই হাজির ছিল, চেঙ্গিজ খানের সঙ্গে সেলফিও তুলেছিল। এবার তথ্যটা দেখা যাক। চেঙ্গিজ খান মুসলমান ছিলেন না, তিনি ছিলেন টেংরিস্ট, এশীয়-ইউরোপীয় স্তেপি অঞ্চলে আকাশ দেবতা টেংরির পুজো করতেন। কেবল তাই নয়, তিনি হালাল মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তাঁর বংশধর কুবলাই খান বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি ছুন্নত এবং হালাল, দুইয়ের উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। চেঙ্গিজ খান ভারতবর্ষের ধারেকাছেও আসেননি, আফগানিস্তানে এসেছিলেন তাঁর ছেলে। অতএব চেঙ্গিজ খান দিল্লিতে লাশের পাহাড় বানিয়েছিলেন এ তথ্য ভুল। হ্যাঁ, তিনি কিছু জায়গায় লাশের পাহাড় বানিয়েছিলেন তা ছিল মুসলমানদের, মধ্য এশিয়ার শাহ বংশের সম্রাট শাহ আলা উদ্দিন মহম্মদকে আক্রমণ করেছিলেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যের মুসলমান প্রজা আর সামরিক বাহিনীদের কচুকাটা করেছিলেন, এবং তাঁরা ছিলেন মুসলমান। শোনা যায় সেই সময়ে তিন দিনে তিনি দেড় লক্ষ মুসলমান হত্যা করেছিলেন, মুসলমান বলে নয়, তারা তাঁকে বাধা দিতে এসেছিল তাই। এই হল চেঙ্গিজ খান প্রসঙ্গ।
এবারে আসা যাক তৈমুর লং প্রসঙ্গে। তৈমুর সুন্নি মুসলমান ছিলেন, নক্সবন্দ ধারার, সুফি ধারার মুসলমান। কিন্তু সম্রাট, যিনি তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াতে চান, ঘোড়ার পিঠে চেপে দুর্ধর্ষ সৈন্যবাহিনী নিয়ে ছুটেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে, সামনে যারা এসেছে সে মুসলমানই হোক, ক্রিস্টান হোক, শিয়া হোক সুন্নি হোক তাকেই মেরেছেন, লাশের পাহাড় তৈরি হয়েছে, লুঠপাট করে ঘোড়া, উট, হাতি, সোনা গয়না নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কোথায় না গেছেন, ওধারে চীন এধারে পারস্য, ওধারে রাশিয়া। আর নিজের রুক্ষ শুষ্ক দেশকে সাজিয়েছেন, বিরাট বিরাট মাদ্রাসা তৈরি করিয়েছেন, তৈরি হয়েছে মসজিদ। এখনও উজবেকিস্তানে গেলে সে সব মাদ্রাসা মসজিদ দেখা যাবে, না, তাদের প্রাসাদ দেখা যাবে না, আসলে তেমন বড় প্রাসাদ তৈরিই করাননি। আসি ভারতবর্ষ অভিযানের কথায়। আবার বিজেপি-আরএসএস এর ইতিহাস বলবে, কীভাবে হিন্দু রাজাদের মেরেকেটে তৈমুর লাশের পাহাড় তৈরি করেছিল। তথ্য বলছে, দিল্লি শহরের ঠিক বাইরে তৈমুর বাহিনীর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল ১৩৯৮ সালের লড়াই ছিল তুঘলক বংশের শেষ সম্রাট নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শা-এর। তুঘলক বংশের এই রাজাকে হারিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন আমির তৈমুর, বিশাল ধন সম্পত্তি লুঠ করে চলে গিয়েছিলেন যেমন অন্য বহু রাজা সম্রাটরা করতেন। এইজন্যই তাঁরা তাঁদের দেশে নায়ক। উজবেকিস্তানে আমির তৈমুর, মঙ্গোলিয়াতে চেঙ্গিজ খান আমাদের দেশের গান্ধীজির মতো, টাকা থেকে সংসদ সর্বত্র আমির তৈমুর, চেঙ্গিজ। তো সেই তৈমুর লং ভারতে এসে লড়লেন কিন্তু মুসলমান রাজা নবাব সম্রাটদের সঙ্গে। বিজেপির হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে বলা হয় তিনি কাফের মারতে বেরিয়েছিলেন। আসলে মধ্যযুগের ইতিহাসের যে কোনও সম্রাট নবাবের মতো তিনিও ছিলেন সাম্রাজ্যলোভী নিষ্ঠুর। মারাঠাদের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না, খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল বর্গি এল দেশে, এই বর্গিরা কারা? এরা তো হিন্দু, ভবানী পাঠক কে ছিলেন? কাকে পুজো করতেন? এই বর্গিরা লুঠপাট করত, মহিলাদের অপহরণ করতে এসেছিল এই বাংলায়। কে আটকাল? আলিবর্দি খান। একজন মুসলমান রাজা কাকে আটকাচ্ছে? হিন্দু লুঠেরাদের, কাকে বাঁচাচ্ছে? তার হিন্দু প্রজাদের। এমনি এমনি নাকি? হিন্দু প্রজারা খাজনা দিত, তাই। এর সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ বিজেপি-আরএসএস বোঝাচ্ছে মুসলমান রাজত্বে কী অত্যাচারই না হয়েছে। হয়ছেই তো, হিন্দু রাজারাও অত্যাচার করেছে, মুসলমান নবাবরাও করেছে, যে কোনও শাসক যেমন করে থাকে। আবার তাদের মধ্যে ভাল শাসকও ছিলেন। সম্রাট অশোকের দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল ধর্মের শাসন, আকবর শুরু থেকেই ছিলেন কল্যাণকারী রাজা, শের শাহ সুরি, যাঁর আসল নাম ছিল ফরিদ খান ছিলেন একজন প্রজা বৎসল সম্রাট। তৈরি করেছিলেন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন, মারা গেলেন কালিঞ্জরের যুদ্ধে, কাদের বিরুদ্ধে? মাহোবার রাজপুতদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে, মাহোবার রাজপুত মানে হিন্দু। আকবর লড়াই করছেন হলদিঘাটিতে মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে, তাঁর সেনাপতি কে ছিলেন? অম্বরের রাজা মান সিং, অন্যদিকে মহারানা প্রতাপের সেনাপতি? দুর্ধর্ষ বীর হাকিম খান। তাহলে কী দাঁড়াল? ইতিহাসের রাজা সম্রাট নবাব সুলতানদের লড়াই হিন্দু মুসলমান দেখে হয়নি, তাদের যুদ্ধ হয়েছে পররাজ্য গ্রাস করার জন্য, সম্পদ আহরণ করার জন্য। আর কোনও কারণ ছিল না। সেই সময়ের মন্দির ছিল ধনরত্নে ভরা, যেমনটা এখনকার তিরুপতি ইত্যাদির মতো। মুসলমান নবাব সম্রাটরা সেগুলোও লুঠপাট করেছিল ওই সম্পদের জন্য। সোমনাথের মন্দিরও সেই জন্যই লুঠ করেছিল নাদির শাহ। খবর ছিল, মন্দিরের গর্ভগৃহে তাল তাল সোনা আছে। শ্রীরঙ্গপত্তনমের কাছে মন্দির লুঠ করেছিল মারাঠারা, বাংলার বেশ কিছু এমন মন্দির লুঠ করেছিল মারাঠারা, আসলে চেয়েছিল সম্পদ আহরণ করতে। কিন্তু যে ঘটনাগুলোকে আজ এতদিন পরে তুলে ধরছে আরএসএস-বিজেপি, তা দিয়ে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে কেবল মুসলমান রাজারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করত।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নারী পাপের উৎস? পুরুষদের দূষিত করা স্ত্রীলোকেদের স্বভাব?
আচ্ছা আসুন তাহলে আর একটা তথ্য দেখা যাক। ১১৯২-এ পৃথ্বীরাজ চৌহানকে যুদ্ধে হারিয়ে মহম্মদ ঘোরি দিল্লি দখল করলেন। এরপর ১৮৫৭, সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা আসে। ৬৬৫ বছর ধরে চলেছিল বিভিন্ন বংশের হলেও ইসলামিক শাসন, মানে সম্রাট বা নবাব বা সুলতানের ধর্ম ছিল মুসলমান। এবং এই যে বিজেপি রোজ বলে যায় মুসলমানরা আর ৫০ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে, যদিও এখনও তারা ওই ১৫ শতাংশেই দাঁড়িয়ে। গত ৬ বছর বিজেপির শাসনে সবথেকে বেশি যে কথা তারা বোঝাবার চেষ্টা করেছে তা হলো হিন্দু খতরে মে হ্যায়, অথচ এই হিন্দুরা অনায়াসে পার করেছে ৬৬৫ বছরের ইসলামিক শাসন। ভারতবর্ষের এই বিশাল এলাকাতে ক’টা মন্দির ভাঙার ইতিহাস পাওয়া যায়? ৬৬৫ বছরে কেউ যদি চাইত তাহলে কি এই ভূখণ্ডে একজনও হিন্দু অবশিষ্ট থাকত? কোথাও কেউ কোনও ধার্মিক অত্যাচার করেনি? কোনও মন্দির ভাঙেনি? আলবাত অত্যাচার হয়েছে, ধর্মীয় কারণেও অত্যাচার হয়েছে, আলবাত মন্দির ভাঙা হয়েছে কিন্তু তা ছিল না সারা দেশের, সারা সমাজের কথা। আর সব রাজা সব সম্রাট সব নবাব সব সুলতানরাও একইভাবে ভাঙার কাজ করে গেছেন, তাও নয়। ধরুন ঔরঙ্গজেবের কথা, যে কথা বিজেপি আরএসএস সবথেকে বেশি বলে, আসুন দেখা যাক সত্যিটা কী। ঔরঙ্গজেব নাকি কাশী বিশ্বনাথের মন্দির ভেঙেছিলেন, ঠিকই বলছে, ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছিল, কিন্তু উনিই আবার কামাখ্যা মন্দিরের জন্য জমি দান করেন, উজ্জয়নীর মহাকাল মন্দিরের জন্য জমি দান করেছিলেন, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মন্দিরের জন্য দান করেছিলেন। তাহলে কী দাঁড়াল, উনি মন্দির ভেঙেছেন, আবার মন্দিরের জন্য দানও করেছেন। উনি ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন, মসজিদের জন্য প্রচুর দানধ্যান করতেন, স্বাভাবিক, কিন্তু গোলকুন্ডার রাজা তানা শাহ তাঁকে খাজনা দিচ্ছিলেন না, ওদিকে প্রচুর ধনরত্ন এক মসজিদের ভেতরে জমা করেছিলেন, ঔরঙ্গজেব সেই মসজিদ ভেঙে ওই ধনরত্ন লুঠ করেন। অন্তত একটা মসজিদ ভাঙার কথা তো ইতিহাসেই আছে। আবার তিনি শেষ জীবনে ছিলেন নিরামিশাষী, মাথার ফেজ তৈরি করে, কোরান লিখে সেই রোজগারের টাকায় খেতেন, এটাও ইতিহাস। আসলে আমরা নবাব সম্রাট সুলতানদের নৈতিক ধার্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছি, নবাব সম্রাট সুলতানরা অর্থ প্রতিপত্তি ক্ষমতার জন্য শাসন করতেন, ধর্ম ন্যায়নিষ্ঠার জন্য নয়। আসলে এটা এক ধরনের ইতিহাসের বিকৃতি, ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা। যা শুরু হয়েছিল ১৮৫৭তে, সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে। বাহাদুর শাহ জাফরকে সামনে রেখে কারা লড়ছিলেন? লক্ষ্মীবাই, তাঁতিয়া টোপি, মঙ্গল পাণ্ডে, কুঁয়র সিং, হিন্দু মুসলমান মিলে লড়ছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা তখন থেকেই DIVIDE AND RULE পলিসি নিতে শুরু করে, তারাই প্রথমে ইতিহাসকে বিকৃত করার, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য ইতিহাস লেখা শুরু করে। সেই ইতিহাস আজ বিজেপি-আরএসএস আমাদের শেখাতে চাইছে, এটাই সত্যি। আসুন আমরা ইতিহাস দেখি।
দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস কিন্তু খুব পুরনো নয়, এমনকী দেশভাগের সেই দিনগুলোতেও দিল্লি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত, মুসলমান মানুষজন তাঁদের ঘর ছেড়ে পালাচ্ছিলেন, হিন্দুরা সেসব সম্পত্তি দখল করছিল, গান্ধীর কথায় সেই সব সম্পত্তির কিছু অংশ আবার মুসলমানেরা ফিরে পান, পলায়ন বন্ধ হয়। হায়দরাবাদ, সেখানে তো নিজামের শাসন ছিল, কিন্তু সেখান থেকেও মানুষজন পাকিস্তান গেছে, স্বাধীনতার বহু পরেও এসব যাতায়াত হয়েছে, হায়দরাবাদ টিমের হয়ে রনজি ট্রফির ম্যাচ খেলেছেন আসিফ ইকবাল, পরে পাকিস্তানে গেলেন, ক্যাপ্টেনও হয়েছিলেন। দিল্লিতে ১৯৭৪ সদরবাজার এলাকায় একটা দাঙ্গা হয়, ১০ জনের মৃত্যু হয়, ৪৪ দিন কারফিউ জারি ছিল। এরপর ১৯৮৭ হসখাস এলাকাতে ১৫ জন মারা গেছিল, কিন্তু তারমধ্যেও ১০ জন পুলিশের গুলিতে, মানে পুলিশ শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ভাঙার ঠিক পরেই সিলমপুরে দাঙ্গা হয়, ৩০ জন মারা গেছিল। বিজেপি এর পর থেকে দিল্লিতে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার আগে পর্যন্ত দিল্লি কংগ্রেসের দখলেই ছিল। অবশ্যই ১৯৮৪-র শিখ হত্যার কথা উঠবে, কিন্তু সেটা তো দাঙ্গা ছিল না, সেটা ছিল গণহত্যা, কংগ্রেসের নেতাদের নেতৃত্বে গণহত্যা, যার জন্য তাদের কয়েকজন শাস্তি পেয়েছে, কংগ্রেস দল হিসেবেই ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এই কংগ্রেস দলই আজকের এই নতুন দিল্লির চেহারা তৈরি করেছে। আগে দিল্লির ঠিক মধ্যিখানে ছিল মুসলমান মানুষজনের বাস, বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ, আসিফা আলি মার্গের উল্টোদিকে তুর্কমান গেটের পাশেই ছিল বিরাট বস্তি এলাকা। দেশভাগের সময় পয়সাওলা মুসলমানরা চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তান, পড়ে ছিলেন গরিব মুসলমান মানুষেরা। তাঁরাই থাকতেন ওই বস্তিতে। সঞ্জয় গান্ধী আর তাঁর সাকরেদ বলা যায়, জগমোহনকে নিয়ে ওই তুর্কমান গেটের পাশের বস্তি ভাঙেন, বুলডোজার দিয়ে ভাঙেন, উৎখাত হন লক্ষ লক্ষ মুসলমান গরিব মানুষ। সঞ্জয় গান্ধী তখন দিল্লি সাজাচ্ছিলেন। ওই উৎখাত হওয়া মানুষেরা চলে গেলেন দিল্লির উত্তর পূর্বে, সেখানে তৈরি হল জুগগি ঝোপড়ি। মজার কথা হল বেআইনি ভাবে ওইসব জুগগি ঝুপড়ি তৈরি করতে সাহায্য করলেন কিন্তু ওই কংগ্রেসি নেতারাই। তাই এখনও ওইসব কলোনিগুলোর নাম হল ইন্দিরা নগর, জওহরলাল নগর, সঞ্জয় নগর। এখনও বাস যায়, লেখা থাকে জে জে কলোনি, জানেন সেটা কী? জুগগি ঝোপড়ি কলোনি। সে সব বেআইনি কলোনিকে আইনি করা হবে বলে প্রতিশ্রুতিও সেই কবেকার। এই তুর্কমান গেটের পাশ থেকে সরে গিয়ে যমুনা পারে কিছু মুসলিম ঘেটো তৈরি হল, সেখানে দেশের অন্য প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এলেন, ৭১-এ বাংলাদেশ থেকেও এলেন। কিন্তু সব মিলিয়ে ওই ঘেটোর মতোই হয়ে রইল, হিন্দু মুসলমান এলাকা হল না, হিন্দু এলাকা হল, মুসলমান এলাকা হল। এবং এই অঞ্চলে কমিউনাল টেনশন লেগেই রইল, হিন্দু এলাকাগুলো ১৯৯২ থেকে বিজেপির এলাকা হয়ে উঠল আর মুসলিম এলাকা কংগ্রেসের। অবশ্য ২০১৫ থেকে এই এলাকাগুলো চলে গেছে আপ-এর কাছে, কংগ্রেস ক্রমশ শক্তি হারিয়েছে। কিছুদিন আগে দিল্লির দাঙ্গাকে এই পটভূমিকায় দেখলে বুঝতে সুবিধে হবে যে কেন দিল্লির উত্তরপূর্বেই দাঙ্গা হল, কেন ওই এলাকাগুলোতে বিজেপি এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একইভাবে দেশের যেখানে যেখানে মিক্সড পপুলেশন, হিন্দু মুসলমানরা একসঙ্গে থাকে তার থেকে যেখানে হিন্দুরা এক এলাকায় মুসলমানরা তার পাশের এলাকায় থাকে সেখানে কেন বিজেপি জিতছে, বিজেপির সমর্থন বাড়ছে। বাংলাতে ৬-৭ থেকে এখন ৪০-৪১ শতাংশ ভোট এমনি এমনি হয়নি, বাম কংগ্রেস শাসিত কেরালাতে ওই একই কারণে বিজেপি বাড়ছে। আপাতত ভোট ১৫ শতাংশ, এবারে সেটা বেড়ে ২২-২৩ শতাংশ হলে অবাক হবার কিছু নেই, একটা দুটো আসনও পেতেই পারে। আসলে বিজেপির প্রচারের কায়দাটা খুব চেনা, মুসলিম ঘেটোগুলোকে দেখিয়ে বলা খুব সোজা যে ওরা সংখ্যায় বাড়ছে, ওরা সকাল-সন্ধে মাইকে আজান দেয়, ওরা ৫টা বিয়ে করে, আসলে ওরা পাকিস্তানের চর, আসলে ওরা জঙ্গি। এবং এর ফলে হিন্দু এলাকায় এক ধরনের পোলারাইজেশন হবে যেটা বিজেপি চায়, সেই পোলারাইজেশন থেকেই স্লোগান উঠবে দেশ কে গদ্দারো কো গোলি মারো শালো কো। তাই তাদের ৩০৩ জন সংসদের এক জনও মুসলমান নয়, উত্তরপ্রদেশে তারা একজন মুসলমানকে এমএলএ-র টিকিটও দেয়নি, তাদের দরকার নেই। তারা মুসলিমদের ঘেটোয় রাখতে চায় উল্টোদিকে হিন্দুদের তাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মেরুকরণ চায়। এটাই তাদের ঘোষিত রাজনীতি, তাই তারা দিল্লি থেকে কলকাতা স্লোগান দিতে পারে দেশ কে গদ্দারো কো গোলি মারো শালো কো। গদ্দার কারা? উত্তর পরিষ্কার, কেন ওই তো পোশাক দেখেই চেনা যাচ্ছে, এবং যাঁরা তাদের হয়ে কথা বলছেন, তাঁরা দেশদ্রোহী তারাই গদ্দার। যেখানে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে থাকবে সেখানে মেরুকরণ করা কঠিন, সেখানে আঙুল তুলে গুজব ছড়ানো কঠিন, ওরা রোজ গরুর মাংস খায় বললেই কেউ বলবে ধুস, চাচার তো ইউরিক অ্যাসিড, মাছ মাংস কিছুই তো খায় না। গুজব ছড়ানো হল ওরা রোজ কাফেরদের মারবে বলে নমাজ পড়ে, তখন কেউ বলবে ধ্যাৎ তাই হয় নাকি, এই তো সেদিন বুলুপিসিকে রক্ত দিল ওসমান ভাই। তাই ওরা চায় আলাদা করতে, বিজেপি-আরএসএস চায় মুসলমানরা খিদিরপুর আর পার্ক সার্কাসেই থাকুক, গুজব ছড়াতে সুবিধে হবে হিন্দু ভোট মেরুকরণে সুবিধে হবে। এটাই তাদের রাজনীতি, এই রাজনীতির বিরুদ্ধেই কথা বলতে হবে। এইজন্যই আনা হয়েছে নাগরিকত্ব বিল, এইজন্যই তা ভোটের আগে লাগু করা হল, এইজন্যই বিজেপির প্রচারে সিএএ আসছে প্রবলভাবে, আসবেও।
এটাই হল বিজেপি। দাঙ্গা বাঁধাবে, মানুষ মরবে, ওদের রাজনৈতিক ফায়দা হবে, মেরুকরণ হবে ওনারা ভোট বেশি পাবেন। এটাই ছক। নির্বাচন এসে গেল, দিল্লি থেকে বিষ ছড়াতে আসবেন নেতারা, ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে আসবেন, উত্তেজনা ছড়াবেন। এই সময় তাই আরও বেশি বেঁধে বেঁধে থাকার, সতর্ক দৃষ্টি রাখার, লোহার বাসরঘর জানি কিন্তু তারই মধ্যে বিষাক্ত সাপ ঢুকেছিল, আবার ঢুকবে। রাম রহিমের চেতনায় আনতে হবে রবীন্দ্রনাথ নজরুল, সামনে নির্বাচন আটকাতেই হবে বিভেদকামী শত্রুদের।