মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা বা মিজোরামে বিজেপি জিতে যেতে পারে এটা বিজেপি নেতারাও বিশ্বাস করেন না, এরকম কথা জনসভাতে বললেও ওয়ান টু ওয়ান আলাপচারিতায় সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, ঐ চার রাজ্যে বিজেপির জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই। মিজোরামে ১টা আসন বা তেলেঙ্গানাতে ৭/৮ তার বেশি আসনের স্বপ্নও দেখছে না বিজেপি। ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশে ভালভাবেই জিতে আসবে কংগ্রেস। কিন্তু তারা রাজস্থান নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল, এমন কি শুরুর দিকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ওপিনিয়ন পোল গুলোতে বিজেপি জিতছেই এমন একটা ছবি ভাসছিল, গোদি মিডিয়া সেই কারণেই বাকি চার রাজ্যের নির্বাচনের কথা ছেড়ে রাজস্থান মে কেয়া হোনে জা রহা হ্যায়, সেটাই আলোচনা করে চলেছিলেন। এমনিতেই রাজস্থান পেন্ডুলাম স্টেট, একবার কংগ্রেস জেতে তো অন্যবার বিজেপি, সেই হিসেব ধরলেও এবারটা ছিল বিজেপির পালা। অনায়াসে জিতে যাবো এই হিসেব মাথায় রেখেই রাজস্থানেও বিজেপি এই প্রথম কোনও মূখ্যমন্ত্রী মুখ ছাড়াই নেমে পড়েছেন রাজস্থান নির্বাচনে। ইউনুস খান গতবারে বিজেপির টিকিটে জেতা একমাত্র মুসলমান প্রার্থী, বসুন্ধরা অনুগত, বসুন্ধরা রাজে মন্ত্রী সভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন, এবারে তাঁকে টিকিট দেওয়াই হয় নি, তিনি টঙ্ক থেকে দু দুবার জিতেছেন। কাজেই তিনি এবার বাগী। কিন্তু জেতা আসনে বিজেপি প্রার্থী বদলালো কেন? কেন তারা বসুন্ধরা কে ছেড়েই দিন, কোনও একজনও রাজস্থানের নেতাকে মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে না সামনে রেখেই মোদিজীর নামে ভোট জোগাড় করতে মাঠে নামলেন?
আসলে বিজেপির তিনটে নির্বাচনী মডেল আছে, প্রথমটা হল অয়ানায়াসে জিতে যাবেন এমন রাজ্যগুলোর জন্য, অন্যটা হল কাঁটে কা টক্কর, মানে যে রাজ্যে জিতেও আসতে পারেন, হারও হতেই পারে, তারজন্য দ্বিতীয় মডেল। আর তিন নম্বর হল যে রাজ্যে বিজেপির জেতা অসম্ভব, তার জন্য তিন নম্বরের মডেল। তিন নম্বর মডেল টা হল নেতারা গিয়ে সাফ হিন্দু মুসলমান মেরুকরণের জন্য বিষ ছড়াবেন, কিন্তু তার সঙ্গেই নির্বাচনের পরের হিসেব, কোন দলের সঙ্গে জোট করা যায়, তিন কি চার কি ছ খানা আসন নিয়েও সমর্থন দিয়ে একটা সরকার বানানো যায়, আঞ্চলিক দলের একজন মূখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখে এক সরকারের শরিক হওয়া যায়, যে মূখ্যমন্ত্রীকে ৫ বছরের জন্য ঢালাও চুরি লুঠ করার সুযোগ দেওয়া হবে, প্রতিটা চুরির ওপর নজর রাখা হবে এবং ৫ বছরের শেষে সেই দলের নেতাদের হয় ইডি সিবি আই এর ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে আসা হবে না হলে জেলে পোরা হবে আর এই পাঁচ বছরের মধ্যেই বেশ কিছুটা সংগঠন বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। এই তৃতীয় মডেলে তাঁরা তাঁদের দলের স্থানীয় নেতাদের সামনে আসতেই দেন না, কারণ এটা করলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে থাকা আঞ্চলিক দলের নেতাকে খানিক তোয়াজ করার সুযোগ থাকে। দ্বিতীয় মডেল হল কাঁটে কা টক্কর, অন্তত যেটা কে ওনারা ভাবছেন ক্লোজ ফাইট, সেখানকার ফর্মুলা। শাসক দল থেকে নেতা ভাঙাও, শাসক দলকে মুসলমান তোষণকারী আর হিন্দু বিরোধী স্ট্যাম্প দাও আর ইডি, সি বি আই দিয়ে নাজেহাল করে দাও তাদের সরকারকে, সেখানে আরররণবের সন্তানেরা নতুন চ্যানেলের দায়িত্ব নিক, মানুষকে এইসব বোঝানোর দায়িত্ব নিক। আর প্রথম মডেল খুব পরিস্কার দলের পুরনো মুখদের বাতিল করে দাও, মোদি শাহের অনুগত টিম তৈরি করো আর তীব্র সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াও, কোনও রকমের ঢাক ঢাক গুড়গুড় নয়, সরাসরি খুলে আম বাবর কা আওলাদ, সরাসরি অব বদলা লেনা হ্যায়। এসব রাজ্যে তাঁরা জেনে বুঝেই একজনও মুসলমান প্রার্থীকে দাঁড় করান না। আর এই তিন মডেলের মিশ্রণই হল তাঁদের নির্বাচন জেতার জাতীয় মডেল, যা আর কিছুদিন পরেই আমাদের সামনে আসবে। তো এই রাজস্থান নিয়ে মোদি শাহ এততাই সিওর ছিলেন, সিওর আছেন যে এইরাজ্যের একমাত্র সর্বগ্রাহ্য মুখ বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে তাঁরা জনসভায় ডাকছেন না, সাংবাদিকদের সামনে অপমান করছেন, এবং মনে করছিলেন বসুন্ধরা রাজে ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি, তিনি আর কী করবেন। একঝাঁক মোদি অনুগত নেতাদের নামিয়েছিলেন রাজস্থানে।
কিন্তু দিন যত গেছে তত বোঝা গেছে রাজস্থানের লড়াই কিন্তু কাঁটে কা টক্করের দিকেই এগোচ্ছে, খেয়াল করে দেখুন শুরুর দিকে পোস্টারে সহাস্য মোদিজী, কেবল মোদিজী, জনসভায়, রাস্তায় ঘাটে মোদিজী। কিন্তু দিন ১৫ আগে থেকে সেখানে চার জনের মুখ, সেখানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার মুখও আছে, রাজ্যবর্ধন রাঠোরের নেই, এমন কি মোদিজীর পেয়ারের গিজেন্দ্র শেখায়ত এর ছবি নেই। আছে সি পি যোশী, সতীশ পুনিয়া আর বসুন্ধরা রাজের ছবি। হঠাৎ এই পোস্টারের পরিবর্তনই বলে দিচ্ছে ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়। এমনিতে রাজস্থান বিভিন্ন জাত ইত্যাদিতে বিভক্ত আজ নয় বহুকাল, রাজপুত দের সঙ্গে গুজ্জরদের, গুজ্জরদের সঙ্গে মিনাদের, বিভিন্ন গোষ্ঠির লড়াই সর্বত্র, আজও। আর রয়েছে স্থানীয় গ্রামের সরপঞ্চ, এঁরা গ্রামে এক প্যারালাল শাসন চালান, পুলিশ, প্রশাসন এঁদের কে বাবা বাছা করেই চলেন, সব জামানায়। পুনিয়া মানে জাঠ অধ্যুষিত এলাকাতে সিপিএম ও একজন পুনিয়াকেই দাঁড় করায়, কংগ্রেস বিজেপির কথা তো বাদই দিলাম। এই জাঠ, গুজ্জর, ব্রাহ্মণ, রাজপুতের যুগ যুগ ধরে চলে আসা লড়াই রাজস্থানের নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলে। যেমন ধরুন গুজ্জর রা গতবার উজাড় করে ভোট দিয়েছিল কংগ্রেস কে, কেন? কারণ তারা মনে করেছিল তাঁদের একজন জাঠ নেতা শচীন পাইলট মূখ্যমন্ত্রী হবেন। সাড়ে চার বছর লড়ে গিয়ে ভোটের আগে পাইলট, গেহেলত সমঝোতা হয়েছে বটে, কিন্তু গুজ্জররা কি কংগ্রেসকে ভোট দেবে, আবার ঢেলে দিত যদি পাইলটকে মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে রেখে কংগ্রেস ভোটে নামতো, কিন্তু তাহলে রাজপুতরা মুখ ফিরিয়ে নিত, কারণ অশোক গেহেলত রাজপুত। তো এসব জটিল জাতের লড়াই রাজস্থানের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয় কিন্তু রাজস্থানে হিন্দু মুসলমান বিষয়টা ছিলই না, এক্কেবারে ছিল না। জাঠ হিন্দু, জাঠ মুসলমানদের আলাদা করাই মুসকিল, ব্রাহ্মণদের বাড়িতে গণেশ পুজোর দিনে গণেশ বন্দনা করতে আসেন মুসলমান গায়কেরা, অজস্র মুসলমান গায়ক রাজস্থানের মন্দিরে, হিন্দুদের উৎসবে গান গাইতে আসেন। আসলে এক সময়ে রাজপুত শাসকদের বহু সৈনাধ্যক্ষই ছিলেন মুসলমান, একশ বছর ধরেও মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়েও এই রাজপুত, গুজ্জরেরা মুসলমান বিরোধী হয় নি। রাজস্থানে মাত্র ১০% এর মত মুসলমান আছে, কিছু আসনে তাঁরা নির্ণায়কও বটে, কিন্তু সেই মুসলমানেরা আসাউদ্দিন ওয়েইসির দলকে জামানত বাঁচানোর সুযোগও দেন নি, এবারেও ওয়েইসি মাঠে আছে। কিন্তু এবারের মত এত সাংঘাতিক কমিউনাল ক্যাম্পেইন আগে কখনও রাজস্থানের মানুষ দেখেন নি। শুধু ক্যাম্পেইন হয়েছে বললে ভুল হবে মানুষ বিশ্বাসও করেছেন, সারা রাজস্থান জুড়েই দুটো শ্লোগান, আয়েগা তো বিজেপি হি আর কানহাইয়া ইয়েরে খুন কা বদলা লেঙ্গে বদলা লেঙ্গে। প্রথম শ্লোগান নিয়ে পরে আলোচনা করবো আগে এই কানহাইয়া লাল এপিসোডটা মনে করিয়ে দিই। কানহাইয়া লাল উদয়পুরের একজন দরজি যাকে দুজন মুসলমান যুবক দোকানে ঢুকে খুন করেছিল ২৮ জুন ২০২২, তার আগেই দিল্লিতে বিজেপি নেত্রী নুপূর শর্মা মহম্মদ কে নিয়ে খুব বাজে মন্তব্য করেছিলেন, কানহাইয়া লাল নাকি সেই বক্তব্যকে সোশ্যাল মিডিয়াতে সমর্থন করেছিলেন, ব্যস, ছুরির কোপে প্রাণ নিল দুই মুসলমান যুবক। ঐ ২৮ তারিখেই ঐ দুই যুবক গ্রেপ্তার হয়, এখনও জেলে, এবং রাজ্য সরকার কানহাইয়া লালের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। ৬ জুলাই আরেক ঘোষনায় রাজ্য সরকার কানহাইয়া লালের দুই সন্তানকেই চাকরি দেবার কথা জানায়, তারা দুজনেই চাকরিও পেয়েছে। এরপরে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রা, বিজেপির সেই নেতা যিনি বলেছিলেন বিজেপি দিল্লি বিধানসভাতে হেরে গেলে পাকিস্থানে বাজি পোড়ানো হবে, এটা আসলে ভারত পাকিস্তানের লড়াই, সেই কপিল মিশ্রা এক কোটি টাকা দেন, সেই কানহাইয়ালাল এবারের নির্বাচনে সর্বত্র, বিজেপির হাতিয়ার। এই রাজস্থানে ভরতপুরের দুই ভাই নাসির আর জুনেইদ, হরিয়ানা থেকে বাড়ি ফিরছিল, রাস্তাতে গরু পাচারকারী বলে তাদের দুজনকে পিটিয়ে মারা হয়, অভিযুক্ত মানু মানেসর অনেক পরে ধরা পড়েছে, নুহ তে দাঙ্গার অভিযোগে ধরা পড়েছে, একটা একটা করে মামলায় বেল পাচ্ছে, এটাতেও পেয়ে যাবে এই বজরং দলের নেতা। না কংগ্রেস না বিজেপি এই দুই ভাই এর মৃত্যুর জন্য কিন্তু কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় নি। এটাই আপাতত রাজস্থানের রাজনীতি। এই প্রথম বার রাজস্থানের নির্বাচন এক আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক আবহে হতে চলেছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলছেন যখন ইভিএম বাটন এ হাত দেবেন তখন মনে করুন কানহাইয়ালালের হত্যাকারীদের ফাঁসি দিচ্ছেন, এই দেশের আর দুজন নাগরিক নিয়ে আমাদের চওকিদার একতা কথা বলেন নি, বলবেনও না। কিন্তু এত কিছু করার পরেও হাওয়া ঘুরেছে, লরাই যে কারোর দিকেই যেতে পারে। আমাদের বন্ধু সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন সম্ভবত নির্বাচনের পরে এম এল এ কিনে বেচেই এবারে রাজস্থানের সরকার তৈরি হবে, কারণ বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া জানেন বিজেপি ১০৫ এর ওপরে গেলে মূখ্যমন্ত্রী হবেন অন্য কেউ, উনি চেষ্টা করছেন ১০০ র তলায় রাখার, অন্যদিকে অশোক গেহেলতও জানেন ১১০/১১৫ কংগ্রেস পেলে উনি ফিরছেন না গদিতে অতএব ওনারও চেষ্টা কংগ্রেস কে ১০০র মধ্যেই রাখার। আমাদের ধারণা শেষমেষ দু চার জন বি এস পি, আর এল ডি, বেনিওয়ালের দলের বিধায়ক হয়ে যাবেন সেই ঘোড়া বা গাধা যা নির্বাচনের পরে কিনে বেচে সরকার তৈরি হবে।